সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা সাহিত্যে নারী : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২২ ০৯:৩৬

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:২৫

ছবিঃ ড. শাহনাজ পারভীন

 

সভ্যতা এবং সৃষ্টির পরতে পরতে যেমন নারীর অবদান অনস্বীকার্য, ঠিক তেমনি বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতেও নারীর অবদান ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যে যেই সমস্ত নারী লেখকগণ লেখনীর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তাদের স্ফুরণ প্রভা ছড়িয়ে গেছেন, তাদের সকলেই রাষ্ট্র, সমাজ সর্বোপরি নারীর অধিকার ও প্রগতি নিয়ে কথা বলেছেন, লিখেছেন। বাংলার নারী সাহিত্যিকরা নারীর ন্যায্যতা এবং অধিকার নিয়ে লিখেছেন কারণ বাংলার নারী সবসময়ই অবহেলিত ও অত্যাচারিত। মূলত পুরুষদের দ্বারা এ সমাজ নিয়ন্ত্রিত। সাহিত্যও এর থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়। নারীর যে কোনো উজ্জ্বল সৃষ্টি ও মৌলিক অর্জনকে পুরুষ শাসিত এই সমাজ সহজে মেনে নেয় না। তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে অবমূল্যায়ন করে। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর থেকে একটু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যারা সত্যিকারের সাহিত্য সৃষ্টিতে অবদান রেখে চলেছেন, কাল তাদেরকে মূল্যায়ন করছে। কালের ঘাত কাটিয়ে তাদের সেই সব মনি মাণিক্য সাধারণের দুয়ারে পৌঁছে দিচ্ছে। শুধু বাংলা নয়, ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়।

আমরা জানি, মূলত: আঠারো শতকের মধ্যভাগে বাংলা সাহিত্যে নারী লেখকদের আবির্ভাব ঘটে। তবে বিশ শতকে এসে তাদের লেখনী হয়েছে তীক্ষœ, পরিণত, সমাজ সতর্ক ও বৈচিত্রময়। শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তারা তাদের দৈন্যদশা উপলব্ধি করেন এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সচেষ্ট হন। এ প্রকাশের অনুভূতি থেকেই তাদের মধ্যে জাগ্রত হয় লেখার স্পৃহা। তারা তাদের সাহিত্যের মাধ্যমে যাপিত জীবনের আনন্দ, সুখ, দুঃখ, বেদনা, প্রেম, বিরহ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান অসংগতি তুলে ধরেছেন। যেগুলো সাহিত্যের অমর সৃষ্টি হিসেবে আজও জ্বলজ্বল করছে। বাংলা সাহিত্যকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়। প্রাচিন যুগ (৬৫০-১২০০), মধ্যযুগ বা অন্ধকার যুগ (১২০০-১৮০০) এবং আধুনিক যুগ (১৮০০- বর্তমানের চলমান সময় পর্যন্ত)। সাহিত্যের প্রাচিন যুগ গুরুত্বপূর্ণ হলেও মধ্যযুগকে অনেকেই অন্ধকার যুগ বলে থাকেন। কারণ এই যুগে রচিত কোন উজ্জ্বল সাহিত্য কর্মের পরিচয় সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। আমাদের সাহিত্য রচনায় যেই সমস্ত নারীরা কালের ঘাত কাটিয়ে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন নিজের মেধা, প্রজ্ঞা এবং প্রভায় তাদের মধ্য থেকে কিছু আলোর ফুলকি ছড়ানো জীবনের অলীক সময়গুলো আমরা বিম্বিত আয়নার দেখবার চেষ্টা করবো। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গান, আত্মজীবনীসহ সাহিত্যের সমস্ত শাখায় তাঁরা লিখেছেন প্রাজ্ঞতায়।

চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬০০ খ্রি.):

নদী হারায় কিন্তু কবি হারায় না। সময় শেষে হারিয়ে গেছে খর¯্রােতা ফুলেশ্বরী কিন্তু হারায় নি কবি চন্দ্রাবতী (জন্ম: ১৫৫০ মৃত্যু: ১৬০০)। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। কিংবদন্তি এই কবি মধ্যযুগের প্রখ্যাত ভাসান কবি মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা দ্বিজ বংশী দাসের কন্যা। তাঁর মাতার নাম সুলোচনা৷১৫৫০ সালের দিকে খরস্রোতা ফুলেশ্বরীর তীরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্ব উত্তর দিকে মাইজখান ইউনিয়নের কাচারিপাড়া গ্রামে চন্দ্রাবতীর মন্দির রয়েছে। ময়মনসিংহ গীতিকার পরতে পরতে মিশে আছে কবি চন্দ্রাবতীর অমর কাব্য, প্রেম আর বিরহের উপাখ্যান।
তাঁর নিজের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরছে৷ এছাড়াও ভাটি বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকা ও সুখ-দুঃখ নিয়ে চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণ, দস্যু কেনারামের পালা ও মলুয়া লোকপালা রচিত। দুঃখী এই কবির করুণ জীবনগাঁথা প্রাণ পেয়েছে তাঁর কাব্য, সুর আর কথায়। তার রচিত “রামায়ন” বিষয় বস্তুুর উপস্থাপনের গুণে এখনও আমাদেরকে চমকে দেয়। তার রচনায় রামের পরিবর্তে সীতা প্রাধান্য পেয়ে মূল চরিত্রে পরিণত হয়েছে এবং সীতার পাশে রাম একেবারে নিস্প্রভ চরিত্রে পরিণত হয়েছে। সীতা চরিত্র উপস্থাপনের এই নব রীতি এবং নির্মানে আধুনিক ভাবনার চন্দ্রাবতী নারীবাদের প্রবক্তা। তাই তার রচিত রামায়নকে এ কালের গবেষকরা নাম দিয়েছে “সীতায়ন”। সেটি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হয়। ফুলেশ্বরী নেই, চন্দ্রাবতী সদর্পে বেঁচে আছে, থাকবে। নদী মরে যায়, নারীরা মরে না। কবিরা বেঁচে থাকেন তাদের কর্মে, তাদের সৃজনে।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা (১৮৩৪--১৯০৩ খ্রি.):

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী এক প্রতিনিধির নাম জনাব নওয়াব ফয়জুন্নেসা (১৮৩৪--১৯০৩)। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব ও নারীশিক্ষার পথিকৃৎ। তিনি অনেকটা নিজের অদম্য ইচ্ছায় শিক্ষিত হন। শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী বর্তমান কুমিল্লা জেলার, লাকসাম উপজেলার অন্তর্গত পশ্চিমগাঁ, (সে সময়ের হোমনাবাদ পরগনা) ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা-জমিদার আহমদ আলী চৌধুরী এবং মায়ের নাম আরাফান্নেসা চৌধুরাণী। তিনি পেশায় ছিলেন জমিদার, সমাজকর্মী ও একজন লেখিকা। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও পারিবারিক গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে আরবি, ফার্সি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

রবীন্দ্রযুগে যে কয়জন বাংলা সাহিত্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন, নওয়াব ফয়জুন্নেসা তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে নওবাব ফয়জুন্নেসার নাম চিরস্মরণীয়। তার সাহিত্য সাধনার খুব অল্প সময়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক লেখক। তিনি প্রথম মুসলিম কবি ও কথাসাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা গিরিশচন্দ্র মুদ্রণ যন্ত্র থেকে তাঁর রচিত একমাত্র উপন্যাস ‘রূপজালাল' প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সময়ে মুসলিম সমাজে কুসংস্কারের বেড়াজালে বন্দী হয়েও ফয়জুন্নেসা সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে একটি গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছেন। 'রূপজালাল' ছাড়াও ফয়জুন্নেসার আরও দু'খানি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়- 'সঙ্গীত লহরী' ও 'সঙ্গীত সার'। এ গ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হলেও তা এখন দুষ্প্রাপ্য। তার জীবনের নানামুখী উল্লেখযোগ্য জনহিতকর অবদানের জন্য ১৮৮৯ সালে মহারাণী ভিক্টরিয়ার নির্দেশক্রমে 'নওয়াব' উপাধি লাভ করেন। তার স্বামী জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজী। তিনি ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। ফয়জুন্নেসার দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। জীবনের পরতে পরতে নানান রোগ, শোক ও জীবনের অশান্তিও তার সাহিত্য সাধনার অন্যতম অনুষঙ্গ।

স্বর্ণকুমারী দেবী ( ১৮৫৫Ñ ১৯৩২ খ্রি.):

বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য আধুনিক মহিলা কথাসাহিত্যিক স্বর্ণকুমারী দেবী (২৮ আগস্ট, ১৮৫৫ Ñ৩ জুলাই, ১৯৩২)। তিনি একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার ও সমাজ সংস্কারক এবং শিক্ষিত বাঙালি নারীসমাজের অন্যতম প্রতিনিধি। স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম ২৮ অগস্ট, ১৮৫৫, কলকাতা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। তাঁর মৃত্যু ৩ জুলাই, ১৯৩২,কলকাতা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। তিনি পেশায় ছিলেন একজন লেখক। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তিনি জন্মেছিলেন। তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতনি ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ মেয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন স্বর্ণকুমারী। সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বর্ণকুমারী দেবীর মতো নারী সাহিত্যিকের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাঁর দাম্পত্য সঙ্গী ছিলেন জানকীনাথ ঘোষাল। স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশ নিয়েছিলেন।

ঠাকুর বাড়ির পুরুষ সদস্যদের মতো তাঁকেও সৃষ্টিশীলতা স্পর্শ করেছিল। তিনিও সৃষ্টি করেন তার অমর কথাসাহিত্য। পরিবারের অন্য মেয়েদের মতো তাঁরও বিয়ে হয় অল্প বয়সে। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে তিনি দিন রাত সাহিত্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন। আর দশটা পুরুষ কবি সাহিত্যিকের মতো তিনিও তাঁর কাব্য সাধনায় ব্যস্ত সময় কাটাতেন। শুধুমাত্র রান্নাবান্না, সাজ গোজ, গল্প গুজব করে তাঁর মূল্যবান সময় তিনি নষ্ট করতেন না। তাঁর সম্পর্কে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায়,
"তাঁর স্বামী জানকীনাথ যখন ইংল্যান্ডে যান তখন স্বর্ণকুমারী অনেকদিন বাপের বাড়িতেই ছিলেন। ওই সময় স্বর্ণকুমারীর সঙ্গীত চর্চা, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা, ও ভালোভাবে ইংরেজি সাহিত্য পাঠের সুযোগ হয়েছিল।" তাছাড়া তিনিও তার দাদাদের সাথে কাব্য বিষয়ে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে ওঠেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যখন পরিবারের প্রাচীন প্রথাগুলিকে নারী স্বাধীনতার পথ হিসেবে প্রশস্ত করছিলেন তখন স্বর্ণকুমারী দেবী নিজের সাহিত্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন। স্বর্ণকুমারীর লেখক জীবন শুরু হয়েছিল বিয়ের আগে থেকেই। ছোট বেলা থেকেই তিনি তার দাদাদের মতো করে লিখতেন। এজন্যই বিয়ের পর তার কোনো সমস্যা হয় নি। বরং বিয়ের পর তার সাহিত্য প্রতিভা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়। স্বামী জানকীনাথের সহযোগিতায় স্বর্ণকুমারীর সাহিত্যচর্চা আরো গভীর ও প্রগাঢ় হতে থাকে।
১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়। গল্প কবিতা লেখার মাধ্যমে তার সাহিত্যে হাতে খড়ি হতে না হতেই মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ লেখা। জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এই উপন্যাস লিখেছেন। তৎকালীন সময়ে মানুষের নৈতিক অবনতি এবং আত্মকলহের সুযোগে বিদেশি শত্রু বারবার আমাদের দেশকে আক্রমণ করেছে, কেড়ে নিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। সেই গøানি আমাদেরকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে শুধুমাত্র নিজেদের কারণেই। স্বর্ণকুমারী দেবী এই কথাই বলেছেন তাঁর এই উপন্যাসে। এই বক্তব্যের ওজন যুগের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশের এক দশকের মধ্যে বাংলা ভাষাতে লেখা কোন মহিলার প্রথম উপন্যাস এটি।
'দীপনির্বাণ' এর পর স্বর্ণকুমারী দেবী ¯েœহলতা (১৮৯২ খ্রি.), কাহাকে (১৮৯৮ খ্রি.) মিবাররাজ (১৮৭৭ খ্রি,) বিদ্রোহ (১৮৯০) হুগলির ইমামবাড়া (১৮৯৪ খ্রি.) ফুলের মালা, ছিন্নমুকুল, বিচিত্রা (১৯২০ খ্রি.), স্বপ্নবাণী (১৯২১ খ্রি.) ও মিলনরাত্রি (১৯২৫ খ্রি.) প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও তিনি অনেক ছোটগল্প,, নাটক, কবিতা ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। সে যুগের প্রেক্ষিতে স্বর্ণকুমারী দেবী মহিলা সাহিত্যিক হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বের দাবীদার।

স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথমে উপন্যাসে লেখকের নামের জায়গায় লেখা ছিল জনৈক লেখিকা। এইদেশে যখন স্ত্রী শিক্ষার তেমন প্রসার ঘটেনি, শিক্ষার আলো থেকে তারা বি ত ছিল। তখন সেইদেশে নারী লেখকের আবির্ভাব ছিল অকল্পনীয়। তাছাড়া, তার লেখনীর ভাষা এবং তাৎপর্য দেখে তৎকালীন সময়ের বিদগ্ধজনেরা অবাক হয়েছিলেন। হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দ্যা ক্যালকাটা রিভিউতে তার লেখার আলোচনা প্রকাশ পায়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ইংল্যাÐে ছিলেন। তদুপরি তার কাছে সেই উপন্যাসের এক কপি পৌঁছালে তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি যে একজন নারী এই রকম একটি উপন্যাস লিখতে পারেন। তিনি ভেবেছিলেন, এই উপন্যাসটি ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছদ্মনাম ব্যবহার করে লিখেছেন। তিনি অভিনন্দন জানিয়ে তাকে চিঠি লিখেছিলেন “জ্যোতির জ্যোতি কি প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে?"

শুধু তাই নয় ১৮৭৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য বসন্ত উৎসব রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর অনুজ রবীন্দ্রনাথ ওই ধারাতেই একের পর এক গীতিনাট্য রচনায় সফল হয়েছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী একজন সম্পাদক ছিলেন।
উল্লেখ্য; ১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পারিবারিক পত্রিকা ভারতী চালু করেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর এগারো বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তাঁর সম্পাদনায় পত্রিকাটি স্বতন্ত্র চরিত্র পেয়েছিল এবং ভারতী প্রায় প াশ বছর ধরে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার চাহিদাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়মিত লিখতে বাধ্য করতো। স্বর্ণকুমারী সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

বেগম রোকেয়া (১৮৮০--১৯৩২ খ্রি.):

বাঙালি নারীবাদী লেখিকা ও সমাজ সংস্কারক। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সাধারণত বেগম রোকেয়া নামে পরিচিত। তিনি ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রক্ষণশীল পরিবারে সম্পূর্ণ প্রতিকূল এক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে নিজের চেষ্টায় তিনি ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। বেগম রোকেয়া একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক। তিনি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী লেখক। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসি বাংলার 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি' জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও শ্লেষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তার রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তার প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিজ্ঞান সম্পর্কেও তার অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায়। মতিচূর (১৯০৪) প্রবন্ধগ্রন্থে রোকেয়া নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় আহŸান জানিয়েছেন এবং শিক্ষার অভাবকেই নারীপশ্চাৎপদতার কারণ বলেছেন। তার সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫) নারীবাদী ইউরোপিয়ান সাহিত্যের ক্লাসিক নিদর্শন বলে বিবেচিত। পদ্মরাগ (১৯২৪) তার রচিত উপন্যাস। অবরোধ-বাসিনী (১৯৩১) তে তিনি অবরোধ প্রথাকে বিদ্রূপবাণে জর্জরিত করেছেন।

তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন জেলা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বিয়ের পর স্নেহশীল ও মুক্ত মনের অধিকারী স্বামীর সংস্পর্শে এসে তিনি লেখাপড়া করার ও চিত্ত বিকাশের সুযোগ পান। কিন্তু স্বামীর সান্নিধ্য সুখ তার বেশিদিন সৌভাগ্য হয়নি। বিয়ের মাত্র দশ বছর পরে তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের প্রতি সব আকর্ষণ হারিয়ে তিনি সমাজ সংস্কার ও গঠনমূলক কাজে নিজেকে উজাড় করে দেন। তিনি নারী শিক্ষা প্রসারে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং নারীদের স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন কর্ম মুখর। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যূ বরণ করেন। বেগম রোকেয়ার কর্ম ও আদর্শ উদযাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর ‘রোকেয়া দিবস’ উদযাপন করে এবং সমাজের বিভিন্ন নারীদের অনন্য অর্জনের জন্য ‘বেগম রোকেয়া পদক’ প্রদান করে।

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা (১৯০৬--১৯৭৭ খ্রি.):

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ১৯০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাবনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খান বাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মান সিদ্দিক। বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন আধুনিক কবি। তিনিই প্রথম সনেট ও গদ্য ছন্দে বাংলা কবিতা লিখেছিলেন। এক সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করায় তার কাব্য প্রতিভা অতি শৈশব প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। মাত্র নয় বছর বয়সে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘আল ইসলাম’ পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তিরিশ বছর ধরে তার কবিতা সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায় ছাপা হয়। তার রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পসারিণী’ (১৯৩৮ খ্রি.) কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় মুসলমান মহিলা কবির এটাই প্রথম প্রকাশিত আধুনিক কবিতার বই। এছাড়াও মন ও মৃত্তিকা, অরণ্যের সুর তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।

শামসুন নাহার মাহমুদ (১৯০৮--১৯৬৪ খ্রি.):

১৯০৮ সালে নোয়াখালী জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বেগম মাহমুদের শিক্ষাজীবন অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি তিন বিষয়ে ডিস্টিংশন নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। বেগম মাহমুদ ১৯৩২ সালে বিএ এবং ১৯৪২ সালে এম এ পাস করেন। তিনিই বাংলাদেশের মুসলিম মেয়েদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট। শৈশবেই শামসুন নাহারের সাহিত্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত তৎকালীন কিশোর পত্র ‘আঙ্গুর’-এ তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি রচনা করেছেন রোকেয়া জীবনী, বেগম মহল, শিশুর শিক্ষা, আমার দেখা তুরস্ক ও সর্বশেষ রচনা নজরুলকে যেমন দেখেছি। শামসুর নাহার মাহমুদ ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১--১৯৯৯ খ্রি.):

বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি ১৯১১ সালে বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ পরগণায় মাতামহ সৈয়দ মুয়াজ্জম হোসেন চৌধুরীর ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন। সুফিয়া কামাল স্কুল কলেজে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি। এগারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। তবে স্বামীর সংস্পর্শে এসে তিনি ভাষা ও সাহিত্য চর্চার সুযোগ পান। সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতা বাসন্তী সে সময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথাও লিখেছেন। সাঁঝের মায়া ও উদাত্ত পৃথিবী তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। কামিনী রায়ের পর বাংলা সাহিত্যে অনেকদিন পর্যন্ত বিশিষ্ট কোনো নারী কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি। সুফিয়া কামালের কবিতায় সেই কণ্ঠস্বর যেন আবার নতুন করে বাংলা ভাষায় উচ্চারিত হলো। তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (১৯৬২ খ্রি.), একুশে পদক (১৯৭৬ খ্রি.) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরষ্কার (১৯৯৭ খ্রি.) লাভ করেন। এই নন্দিত কবি ঢাকায় ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর মৃত্যূবরণ করেন।

নূরজাহান বেগম (১৯২৫-২০১৬ খ্রি.):

বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত এবং সাহিত্যিক। নূরজাহান বেগম সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের মেয়ে। তিনি ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে সম্পাদনার কাজে জড়িত এবং ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন ছিলেন ‘মাসিক সওগাত’ এবং ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং মা ফাতেমা খাতুন।
বাবা নাসিরউদ্দীনের উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় যখন নূরজাহান বেগম বিএ পড়তেন। তাঁর বাবা প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। তিনি প্রথম চার মাস এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। শুরু থেকে নূরজাহান ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তিনি বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) কে।

মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-২০১৬ খ্রি.):
মহাশ্বেতা দেবী হিন্দু ধর্মের নিম্নজাত দলিতদের (যাদেরকে অছ্যুত বলে মনে করা হয়) অধিকার নিয়ে লেখালেখি করেন। তিনি অসম সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করেন। তবে দেবী নারীবাদিতার ব্যাপারে খুব বেশি উদার মনোভাব পোষণ করতেন না। তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাঁওতাল ও উপজাতিদের ওপর কাজ এবং লেখার জন্য বিখ্যাত। তাঁর লেখা শতাধিক বইয়ের মধ্যে হাজার চুরাশির মা, অরণ্যের অধিকার' অন্যতম।

রাজিয়া মজিদ (১৯৩০ খ্রি.):
রাজিয়া মজিদ ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুর গ্রামে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। ষাটের দশকে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত। রাজিয়া মজিদ রচনা করেছেন উপন্যাস, গল্প, রম্য রচনা, জীবনী, ভ্রমণ কাহিনী, শিশু সাহিত্য। তার উপন্যাসের নাম তমসা বলয় (১৯৬৬ খ্রি.), দিগন্তের স্বপ্ন (১৯৬৭ খ্রি.), মেঘের জল তরঙ্গ (১৯৮১ খ্রি.) ও নক্ষত্রের পতন (১৯৮২ খ্রি.)। তিনি ১৯৭৮ সালে উপন্যাসে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার লাভ করেন।

ড. হালিমা খাতুন (১৯৩৩ খ্রি.Ñ২০১৮ খ্রি.):
ড. হালিমা খাতুন একজন অধ্যাপক ও সাহিত্যিক। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগষ্ট তিনি বাগেরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা ও শিশু সাহিত্য রচনার পাশাপাশি ভাষা আন্দোরনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের অনন্য অবদানের জন্য তিনি ২০১৯ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি একজন শিশু সাহিত্যিক। তাঁর শিশু সাহিত্য সোনা পুতুলের বিয়ে (১৯৬৩ খ্রি.), হরিণের চশমা (১৯৭০ খ্রি.), কুমিরের বাপের শ্রাদ্ধ (১৯৭২ খ্রি.), পশু পাখির ছড়া ( ১৯৭৬ খ্রি.) উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৮১ সালে শিশু সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার লাভ করেন। তিনি ২০১৮ সালের ৩ জুন ঢাকায় মৃতূবরণ করেন।

রাবেয়া খাতুন (১৯৩৫ খ্রি.Ñ২০২১ খ্রি.):
তিনি একজন জনপ্রিয় কবি ও কথাসাহিত্যিক ছিলেন। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার বিক্রমপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মধুমতী (১৯৬৩ খ্রি.), মন এক শে^ত কপতী (১৯৬৫ খ্রি.), অনন্ত অন্বেষা (১৯৬৭ খ্রি.), রাজাবাগ (১৯৬৭ খ্রি.), সাহেব বাজার (১৯৬৯ খ্রি.), ফেরারী সূর্য (১৯৭৫ খ্রি.), বায়ান্ন গলির এক গলি (১৯৮৪ খ্রি.) তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের কয়েকটি। তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে উপন্যাসে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার এবং ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকসহ অন্যান্য অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যূবরণ করেন।

রিজিয়া রহমান (১৯৩৯ খ্রি.Ñ ২০১৯ খ্রি.):
তিনি একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন। ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্য রচনা ও শিশু সাহিত্যে তাঁর বিচরণ। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ অগ্নি স্বাক্ষর। তাঁর বহু গ্রন্থের মধ্যে ঘর ভাঙা ঘর (১৯৮৪ খ্রি.), উত্তর পুরুষ (১৯৭৭ খ্রি.), রক্তের অক্ষর (১৯৭৮ খ্রি.), বং থেকে বাংলা (১৯৭৮ খ্রি.) অরণ্যের কাছে (১৯৭৯ খ্রি.), শিলায় শিলায় আগুন (১৯৭৯ খ্রি.), অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০ খ্রি.) উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৭৮ সালে উপন্যাসে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার এবং ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদক লাভ করেন।

সেলিনা হোসেন (১৯৪৭ খ্রি.):

সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখনীতে তিনি বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব সংকটের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একই সঙ্গে কথাসাহিত্যিক, গবেষক এবং প্রাবন্ধিক। জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশকে তিনি শুধু কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, শাণিত ও শক্তিশালী গদ্যের নির্মাণে প্রবন্ধের আকারেও উপস্থাপন করেছেন। তাঁর অসংখ্য লেখনীর মধ্যে হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, যাপিত জীবন, নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি, পোকা মাকড়ের ঘরবসতি ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে তার লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তাঁর লেখা গ্রন্থ ইংরেজি, রুশ, মেলে এবং কানাডী ভাষায় অনুদিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি উপন্যাসে তিনি বাংলার লোক-পুরাণের উজ্জ্বল চরিত্রগুলোকে নতুনভাবে এনেছেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমীর গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বিশ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমীর প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০১৪ সালে তিনি শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবেও দুই বছরের জন্য নিয়োগ পান। এটিও আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের একটি বিষয়। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (১৯৮০ খ্রি.), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার, একুশে পদক (২০০৯ খ্রি.) এবং স্বাধীনতা পদক (২০১৮ খ্রি.)। তাঁর সুস্থ ও সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা জ্ঞাপন করি।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক
সম্পাদক: দ্যোতনা, ছড়াঘর। ২২ জুলাই, ২০২১ খ্রি.।

অধ্যক্ষ, তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ, যশোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top