সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

ছায়াবাণীতে দেখা চিত্রলেখার প্রেম : হাসান আলী


প্রকাশিত:
৩ আগস্ট ২০২২ ০১:১০

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৫১


মহিলা কলেজের সাতজন ছাত্রী কলেজের পোশাকে ছায়াবাণীতে সিনেমা দেখতে এসেছে। ম্যাটিনি শো। ড্রেস সার্কেলে সামনের সারিতে সাতজন বসেছেন। ছবির নাম 'সুজন সখী'। এই ছবিটি অনেক দিন 'হাউস ফুল' চলছিল। আমরা প্রায় ১০/১২ জন কলেজ ছাত্রীদের দুই সারি পরে বসার সুযোগ পেলাম। গভীর আগ্রহ নিয়ে মেয়েদের চেনার চেষ্টা করছিলাম। কাউকেই চিনতে পারলাম না। আমাদের চেনার কথাও না। কারণ আমরা গ্রাম থেকে শহরে এসেছি। ছাত্রীদের দু পাশে দুটি করে সিট ফাঁকা। হল অন্ধকার হয়ে গেলো। জাতীয় সংগীত বেজে উঠলো। জাতীয় পতাকা উড়তে লাগলো। আমরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানালাম। সিনেমা শুরু হলো। তীব্র আলোর ঝলকানিতে খেয়াল করলাম মেয়েদের দু পাশের সিট খালি নেই। দু পাশের ছেলে দুটি মেয়েদের গা ঘেঁষে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। আমাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হলো। মেয়েগুলো একা নয়, তাদের সাথে ছেলে বন্ধুরা রয়েছে। বিরতির সময় সেভেন-আপ খেতে গিয়ে মেয়েগুলোর সামনে পড়লাম। আমাদের কেউ তেমন পাত্তা দিলো বলে মনে হয়নি। খেয়াল করলাম একটা কালা মোটা বেঁটে মেয়ে বার কয়েক আমার দিকে তাকালো। সিনেমার শো ভাঙ্গলো। আমরা জিয়া হোস্টেলে ফিরে আসলাম।

পরদিন দুপুরে ওয়ান মিনিটে সেই কালো মোটা মেয়েটিকে দেখলাম। মেয়েটি দই-মিষ্টি খাচ্ছে আর সামনে বয়স্ক একজন মানুষ বসে আছেন। মেয়েটি আমাকে দেখে মিটমিট করে হাসলো। ওয়ান মিনিটের পাশেই মহিলা কলেজের মেয়েদের হোস্টেল। সেই বয়স্ক মানুষটি মেয়েটিকে হোস্টেল পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। কালীবাড়ী মোড়ে আসলে মাঝে মধ্যে মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে যেত। প্রতিবারই সাদা দাঁতের এক টুকরো হাসি পেতাম। তবে আমি কোনো আকর্ষণ বোধ করতাম না। তাকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে পড়তো না। বরং দেখা হওয়ার পরই হৃদয় শীতল হয়ে পড়তো। ভাবতাম এমন মেয়ে যার বউ হবে তার কত বড় কপাল! বেশ ক'দিন মেয়েটির সাথে দেখা হয়নি। মনটা কেমন জানি খচ খচ করতে লাগলো। মেয়েটি অসুস্থ কিনা ভাবছি। চিত্রলেখায় ছবি চলছে 'সারেং বউ'। বন্ধুরা মিলে ম্যাটিনি শোতে ছবি দেখতে গেলাম। ছবি শুরু হলো, পিছন থেকে কে যেন চুল টান দিল। পিছন ফিরে দেখি, একদল মহিলা ছবি দেখছেন। ভাবলাম, সিনেমা হলে কোনো মেয়ে এমন কাজ করবে না। এটা কি আমার ভুল? মনোযোগ দিয়ে ছবি দেখছি। এবার ঘাড়ে একটা চিমটি কাটলো। পিছন ফিরে দেখলাম সবাই ছবি দেখায় মশগুল। আমার মাথার ঠিক পিছনে তো মাঝ বয়সী এক মহিলা বসা। সে কি এমন করতে পারে? আমার বিশ্বাস হলো না। বিরতির সময় দেখলাম আমার পিছনের সারিতে সেই কালো মেয়েটি বসে আছে। কেন জানি মনটা বিষিয়ে উঠলো। ছবি শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পূর্বে আমার কোলের উপর এক টুকরা কাগজ পড়লো। কাগজটা হাতে নিলাম। ছবি শেষ হলে আলো জ্বলে উঠলো। কাগজটা খুলে দেখলাম। লেখা রয়েছে, কেয়া রুম নং- ০৬, মহিলা হোস্টেল। আমার সামনে দিয়ে কেয়া হেঁটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলে এই ভীড়ের মধ্যে একটা চিমটি দিতে পারতাম। ওয়ান মিনিটে বিকেলে আড্ডা দিতে গেলে মনে হতো মহিলা হোস্টেলে কেয়ার সাথে দেখা করি। এমন চেহারার একটা মেয়ের সাথে প্রেম করতে মন সাড়া দিতে চাইলো না। সপ্তাহ দুয়েক পর ভাবলাম, কেয়াকে একটা চিঠি লিখি। মহিলা হোস্টেলের ঠিকানায় একটা প্রেমপত্র পাঠালাম।

শ্রাবণের এক মেঘলা দুপুরে রিক্সা থেকে কেয়া নেমে ওয়ান মিনিটে ঢুকলো। আমি সম্পদ দার পাশেই বসে আছি। আমার পাশে বসেই দু কাপ চায়ের অর্ডার দিলো কেয়া। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 'তুমি ভাল আছ?' আমি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম। কেয়া বললো, 'চল কেবিনে বসি। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।' আমি তার সাথে কেবিনে বসলাম। কেয়া বললো, 'শোন, আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।' আমি কেয়ার এমন আকুতিতে ভড়কে গেলাম। ভেবেছিলাম ক'দিন প্রেম প্রেম খেলবো। সামনে ইন্টার পরীক্ষা। এসব মারাত্মক প্রেম সংক্রান্ত বিষয় আমাকে দিশেহারা করে তুললো। আমি চুপ করে কেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কেয়া বলতে লাগলো, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর ইচ্ছামত প্রেম করবো, ঘুরে বেড়াবো। চাঁদপুর শহরে একত্রে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো অনেক কঠিন কাজ।' বিদায় নেবার সময় কেয়া আলতো করে আমার হাত ছুঁয়ে দিল। আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ইন্টার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। তারপর কেয়ার কোনো খোঁজ নেই। আমি চাঁদপুর কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হলাম। বছর খানেক বাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অপরাজেয় বাংলা'র পাদদেশে ছাত্রলীগের সম্মেলনে হাজির হলাম। ঘামে ভিজে একাকার। তৃষ্ণায় কাতর। ডান হাতে কে যেন চাপ দিয়ে ধরলো। তাকাতেই দেখি কেয়া। জিজ্ঞেস করলাম, 'কিসে ভর্তি হয়েছো?' কেয়া বললো, 'অর্থনীতিতে ভর্তি হলাম। থাকি শামসুন নাহার হলের ৪০৮ নং রুমে। চল তোমাকে ঠাণ্ডা কিছু খাওয়াই।' একটা আইসক্রীম ভ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে দুজন দুটি আইসক্রীম কিনে খেতে শুরু করলাম। অনেক কথা হলো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেইনি বলে মন খারাপ করলো।

বার বছর পর। কেয়া আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থায় কাজ করে। পিএইচডি করেছে ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বেতন পায় লাখ টাকার উপর। আমি রাজনীতি করবো সেজন্যে বিয়ে করিনি। আমাকে বিয়ে করবে বলে কেয়া বিয়ে করেনি। এ কথাটি সত্যিও হতে পারে মিথ্যাও হতে পারে। আমরা দুজন তখনও অবিবাহিত। অফিস শেষে আগারগাঁ আইডিবি ভবন থেকে কেয়া গাড়িতে করে মগবাজার কাজী অফিসে এলো। সন্ধ্যে ছ'টায় কাবিন রেজিস্ট্রি হলো। মগবাজার আড়ং থেকে কেয়া আমার জন্য পাজামা পাঞ্জাবী স্যান্ডেল কিনে দিল। কেয়ার গাড়ি মগবাজার থেকে সরাসরি হোটেল সোনারগাঁতে আসলো। কেয়া আমাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে বললো, 'বিশ মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে পাজামা পাঞ্জাবী পরে রেডী হয়ে নাও।' আমি দ্রুত রেডি হয়ে নিলাম। কেয়া সালোয়ার কামিজ ছেড়ে শাড়ি পরেছে। কপালে সুন্দর করে একটা টিপ দিয়েছে। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি জনা বিশেক লোক। তারা আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালো এবং উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো। সংক্ষিপ্ত পরিচিতি শেষ হলে কেয়া উঠে দাঁড়ালো। বলতে শুরু করলো, 'প্রিয় বন্ধুগণ, কিছুক্ষণ আগে আমরা দু'জন বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। এই বিয়ের জন্য আমাকে এক যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে। যাকে বিয়ে করেছি তিনি বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত, সমাজ বদলাবেন। শোষণহীন সমাজ কায়েম করবেন এই স্বপ্নে বিভোর। শিক্ষাগত যোগ্যতা : বিএ ভর্তি হয়েছিলেন, পরীক্ষা দেয়া হয়নি। আপনারা জানেন আমরা হাজার বছর ধরে সাদা চামড়ার মানুষের হুকুম তামিল করেছি। সাদা চামড়া আমাদের শাসন করেছে। সাদা চামড়ার লোকজন আমাদের প্রভু। আমি কালো। সেজন্যে আমি আমার জন্যে ফর্সা প্রভু খুঁজেছি। ভাবতে ভাল লাগে আমি প্রভুকে পেয়েছি। যার পায়ের নিচে আমার বেহেশত। এক ঘন্টার নোটিসে আপনারা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন সেজন্যে

আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।' কেয়ার বক্তৃতা শুনে সবাই হাততালি দিল।

 

হাসান আলী
সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম
ট্রেজারার, বাংলাদেশ জেরাটলজিক্যাল (বিজিএ) অ্যাসোসিয়েশন

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top