সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

ঋষভ : কাইউম পারভেজ


প্রকাশিত:
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০০:২৬

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ০১:২৯

ছবিঃ কাইউম পারভেজ


।। ১ ।।
মাঝে মাঝে আমি ইউটিউবে Zee Tv-র সারেগামাপা অনুষ্ঠানটা দেখি। বিশেষ করে নতুন শিল্পীদের অডিশন অনুষ্ঠানগুলো। আমার খুব ভাল লাগে। অনেক কিছু শিখতেও পারি। বিচারকরা কেমন করে বিচার করেন। তাঁদের উপদেশমূলক মন্তব্য গুলো। আর উপভোগ করি গান গুলো – গানের ডেলিভারী গুলো। তো সেদিন দেখলাম ১০/১২ বছরের এক ছোট্ট বালকের পরিবেশনা। বালকটি যতখানি না বড় তার চেয়ে বড় ওর গলায় ঝোলানো গীটারখানি। একজন বিচারক তো বলেই ফেললেন – তুমি ও গীটার খানা কি বাজাবে? ও বললো হ্যাঁ এটা দিয়েই তো গান গাইবো। উপস্থাপক জিজ্ঞেস করলেন – তোর নাম কিরে? বললো ঋষভ দে। বিচারকদের মধ্যে আছেন শ্রীকান্ত আচার্য, ইমন চক্রবর্তী, কুমার শানু, মনোময় ভট্টাচার্যসহ আরো কয়েকজন গুণী শিল্পী। এবং বিশেষ অতিথি বিচারক হিসেবে সবচে’ সম্মানিত ছিলেন সেদিন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী।
উপস্থাপক আবীর চট্টোপাধ্যায় ঋষভকে শুধালেন কি গাইবি রে তুই। ঋষভ যেন খুব গর্বের সাথেই বললো ব্যান্ড গুরু আইউব বাচ্চুর গান - আমার খুব প্রিয় গান ‘ সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে’ । করতালিতে ছেয়ে গেল হল ঘর। ঋষভ গাইছে আর আমি দর্শকদের চোখে জল দেখছি। ঐটুকুন বাচ্চা যে কি সুন্দর করে অবিকল নকল করে গাইছে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। দেখছি বিচারকদের প্রতিক্রিয়া। পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন ঋষভের দিকে। মনে হচ্ছিলো তিনি বোধ হয় ওর ভেতরে ঢুকে গেছেন। ঋষভ মাতিয়ে দিলো। বিচারকরা আসন ছেড়ে এসে কেউ ঋষভকে জড়িয়ে ধরলেন, কেউ চুমু খেলেন ওর কপালে। শ্রীকান্ত আচার্য বললেন ঋষভ মহান শিল্পী আইউব বাচ্চু ওপার থেকে তোকে আশীর্বাদ করছেন। সবাই শান্ত হলে এবার পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী একটা মেডেল হাতে করে মঞ্চে এসে ঋষভের সামনে আসতেই ঋষভ তাঁকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ঋষভের গলায় মেডেলটা পরিয়ে দিয়ে এবার তিনিই ঋষভকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। ঋষভ হতবাক হয়ে একটু পিছিয়ে গেল। পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন – তিনি যে কথাটি বললেন সে কথাটি বলবার জন্যেই আমি এতক্ষন এই পুরো কথনের অবতারণা করেছি। যে কথাটি শুনে আমি আমার অশ্রুজল আর ঠেকিয়ে রাখতে পারিনি। তিনি ঋষভকে বললেন – আমি কাকে প্রণাম করেছি তুই জানিস? ঋষভ বললো না। তিনি বললেন তুই যতটুকু মানুষ তোর ভেতরে তারচে’ অনেক বড় একজন মানুষ বাস করছেন। অনেক প্রতিভাময় অনেক বড় শিল্পী। আমি তাঁকে প্রণাম করেছি। তোর নিজের বড় হবার সাথে সাথে তাঁকেও অনেক বড় করতে হবে। কথাটা মনে রাখবি। আমি এতো বড় এতো সুন্দর আশীর্বাদ আগে কখনো শুনিনি। এবার পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীকে আমার প্রণাম করার পালা। দূর থেকে তাই-ই করলাম মনে মনে।
তেমনি দূর থেকে মনে মনে সালাম করলাম গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে। গত ৪ সেপ্টেম্বর তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। উনআশি বছর বয়সে লোকান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৯৬৪ সাল থেকে ৫৮ বছর ধরে বিশ হাজারের অধিক সঙ্গীত রচনা করেছেন। ১৯৭১ সালে সাড়া জাগানো যে গান তিনি লিখেছেন ‘জয় বাংলা বাংলার জয় , হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়” এরপর আর হাজার হাজার গান না লিখলেও তিনি খ্যাতির যে শীর্ষে আছেন সেখানেই থাকতেন ওই এক গানের জন্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সিগনেচার টিউন ছিলো গান টি। বলা যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচে’ আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান এটি। বিবিসির জরীপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় গানটি স্থান পয়েছে। এ ছাড়া তাঁর আরো দুটি গান ঐ বিশটির মধ্যে আছে যার একটি হলো – ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ আর অন্যটি হলো ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’। একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত এ গীতিকার সুরকার চলচ্চিত্র নির্মাতা আমাদের সঙ্গীতের এই ভুবনটিকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়ে গেছেন।
একইভাবে সদ্য প্রয়াত একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত গীতিকবি, লেখক কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যদি ১৯৫২-র সেই একুশে কবিতাখানি লেখার পর আর কোনদিন কিছু না লিখতেন না করতেন তবুও তিনি আজকের এ অবস্থানেই থাকতেন। ঐ এক গানই আমাদের স্বাধীনতার বীজ বুনে দিয়েছিলো। এ গান অনন্তকাল অমর হয়ে থাকবে। তেমনি সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ ঐ গানের সুর করার পর যদি আর কোন গানের সুর না করতেন – যদি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ না হতেন তথাপি তিনি এমনই অমর হয়ে থাকতেন ’আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ বুক মোচড়ানো গানটির সুরের জন্য। সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া “অবুঝ মন” ছায়াছবির গান ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়”। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা এ গানটিও সুর করেছেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। আমরা ক’জনা জানি বা মনে রাখি সে কথা। সাবিনা ইয়াসমিনের আরেকটি সাড়া জাগানো গান নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা আর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর করা “সব কটা জানালা খুলে দাও না , আমি গাইবো বিজয়ের গান” – এ গানের পরে সাবিনা ইয়াসমিন আর কোন গান না গাইলেও তিনি আজকের অবস্থানে থাকতেন ঐ এক গান গেয়েই।
সাবিনা ইয়াসমিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ গানখানি তাঁর ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এই গান গাইবার আগে পর্যন্ত তিনি কেবল ছোটদের গান গাইতেন। টিভিতে খেলাঘরে ছোটদের জন্য নির্ধারিত গানই গাইতেন। এর মধ্যে শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্বপরিবারে তাঁদের পাশের বাড়ীতে নতুন ভাড়াটে হিসেবে উঠেছেন। সাবিনা ইয়াসমিনের পরিবার কোনভাবে জানতে পেরেছিলেন যে আলতাফ মাহমুদ সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। তো একদিন সাবিনা ইয়াসমিনের মা আলতাফ মাহমুদকে বললেন – আমার মেয়েটা ভালই গায় – কিন্তু ছোট বলে সবাই ওকে ছোটদের গান গাইতে বলে কিন্তু ও এখন দু একটা বড়দের জন্য গান গাইতে চায়। আপনি কি ওকে একটা বড়দের গান দেবেন। আলতাফ মাহমুদ রাজী হলেন। সাবিনাকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’। এরপর আর সাবিনা ইয়াসমিনকে ছোটদের গান গাইতে হয়নি – তেমন হয়নি আর পেছনে ফিরে তাকাতে।
পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী সেদিন ঋষভকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে যে কথাটি বললেন সেটি তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তেমনি একটি সুকুমার কাজ – একটি গান একটি কবিতা একটি সুর একটু ভালবাসা একজন মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে অনন্য উচ্চতায়। কারো জন্য হতে পারে টার্নিং পয়েন্ট। হয়তো সমাজও বদলে যেতে পারে। জীবন, দর্শনে পরিবর্তনও এনে দিতে পারে।
।। ২।।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদ্য ভারত সফর করে এলেন। চার দিনের এই চাকচিক্য জৌলুস ফলপ্রসূ সফর অনেক আশা - নিরাশা, তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিয়েছে পত্র-পত্রিকায়, টক-শো মিডিয়ায়। তার মানেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়েছে না হলো তো এত সব হতো না। প্রথম বিতর্ক – প্রধানমন্ত্রী কেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে নিলেন না। দ্বিতীয় বিতর্ক – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা উচ্চ পর্যায়ের কোন মন্ত্রী দিল্লী বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে না গিয়ে তারা পাঠালেন ভারতের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা বিক্রম জারদোশ-কে। ২০১৭ তে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছেন তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তখন কিন্তু রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মানীয় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়নি যেটা এবার হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদীর উপস্থিতিতে। বিমান বন্দরে অতিথিকে অভ্যর্থনার প্রটোকলের নিয়ম যার যার দেশে তার তার। তবে এবারের ব্যপারটি অনেকের চোখেই বেমানান ঠেকেছে যেমন জর্দ্দা ছাড়া পান আর তবলা ছাড়া গান। আনন্দবাজার পত্রিকাসহ ভারতের আরো অনেক পত্রিকা এর নিন্দা করেছে। কিন্তু ঐ অভ্যর্থণা ছাড়া আর কোথাও কোন কিছু বেমানান ঠেকেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সদা স্বতঃস্ফূর্ত হাস্যজ্বোল দেখা গেছে এবং তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী আত্মপ্রত্যয়ী। সাম্প্রতিককালে দেশে বিদেশে একটা কথা চাউড় হয়েছিলো ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে এবং ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার দল ও সরকারকে আর আপার হ্যান্ড দেবে না। সেটা যে অসত্য সেটা প্রমানিত হয়েছে এ সফরে। তাইতো সফরের শেষাংশে তাঁর বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদী বললেন বাংলাদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য অনেকেই তৎপর রয়েছে কিন্তু ওরা যত তৎপর হয়েছে আমাদের বন্ধন তত অটুট হয়েছে এবংআগামীতে সেটা আরো গভীর হবে আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা আর কার্যক্রমের মাধ্যমে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ায় যোগ দিতে লন্ডন যাবেন – সেখান থেকে আমেরিকায়। সঙ্গে যাচ্ছেন সেই পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন। সেই আমেরিকায় যাচ্ছেন যে আমেরিকা পুলিশের আইজিসহ কতিপয় উর্দ্ধতন কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তা দেখে অনেকে আবার উৎফুল্ল হয়েছিলেন এই ভেবে – এবার বুঝি আমেরিকা হাসিনা সরকারকে ফেলে দেবে। যাহোক সে আশায় থাকতে থাকতে যদি আরো দুই এক যুগ কেটে যায় ক্ষতি কি?
ঋষভ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ মানুষরা তাঁদের কাজে শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকবেন – হয়তো বা জীবনের একটি মাত্র কাজ দিয়ে। আর আমরা পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর মত তাঁদের ভিতরের মানুষটাকে শ্রদ্ধা প্রণাম করে বলবো আরেকটু বেশী দিয়ে যান - পৃথিবীটায় শান্তি ফিরে আসুক।

 

ডঃ কাইউম পারভেজ
লেখক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top