সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

টটোগ্রাম নিয়ে লেখক ইসমোনাক : কাজী খাদিজা আক্তার


প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০০:১৯

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৫২

 

বাংলা সাহিত্যে "টটোগ্রাম" শব্দটির সাথে আমরা সাধারণ পাঠকরা হয়তো অনেকেই অপরিচিত, কিংবা এসম্পর্কে একেবারেই জানিনা বললে হয়তো ভুল বলা হবেনা।স্পষ্ট করে বলতে গেলে টটোগ্রাম পদ্ধতিকে আশ্রয় করে লিখা সাহিত্য আমরা খুবই কম পড়েছি বা জেনেছি। তার কারণ একটাই, তাহলো এই সাহিত্যের রচয়িতা খুবই কম। আর সেই টটোগ্রাম - কে আশ্রয় করে দীর্ঘ বারো বছর ধরে দুই লক্ষেরও বেশি শব্দ সংগ্রহ করে লেখক ইকবাল সর্দার মোহাম্মদ নাজমুল কবির বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করলেন তাঁর দুইযুগের ফসল, ' কেষ্ট কবির কষ্টগুলো ', কেষ্ট কবির কনফারেন্স ' এবং ' কেষ্ট কবি' নামের এই তিনটি বই।এই তিনটি বই -এ তিনি প্রায় ২৭ হাজার 'ক' বর্ণ দিয়ে শুরু শব্দ ব্যবহার করেছেন।

এবার টটোগ্রাম সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। টটোগ্রাম হলো একটি পাঠ্য যেখানে প্রত্যেকটি শব্দ একই বর্ণ দিয়ে শুরু হয়।ঐতিহাসিকভাবে বেশিরভাগ টটোগ্রাম কাব্যিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।বাক্যের প্রতিটি শব্দ একই বর্ণ বা বর্ণগুলো পুনঃ পুনঃ ব্যবহার করাকে বলা হয় টটোগ্রাম। আর এজন্যই এই সাহিত্য ব্যতিক্রম এবং সংখ্যায় নগন্য। সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সংগীতেও টটোগ্রাম ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।অবশ্য সংগীত সাহিত্যেরই একটি অংশ। স্বাভাবিক ভাবেই একই বর্ণ দিয়ে শুরু শব্দ ব্যবহার করে সাহিত্য সৃষ্টি করা খুবই কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। আর সেজন্যই এপথের পথিক কম।আর সেই সাধনার কাজটি বাংলা সাহিত্যে যিনি করে দেখিয়েছেন তিনি ইকবাল সর্দার মোহাম্মদ নাজমুল কবির যাঁর ছদ্মনাম ইসমোনাক।

লেখকের সাথে আলাপচারিতায় জানতে চাইলাম, কেন তিনি এই ধারায় লিখতে চাইলেন।তিনি বললেন, ব্যতিক্রম কিছু করার আগ্রহ।তিনি যখন জানতে পারলেন যে, টটোগ্রাম নামের একটি সাহিত্য ধারার কথা তখন তিনি এই সাহিত্য রচনার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন।সেটা একধরনের নেশার আসক্ততা।আর আসক্তি থেকে ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে।ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছেন শব্দের খুঁজে। কিন্তু মুশকিল হলো একই বর্ণ দিয়ে শুরু এতো শব্দ সংগ্রহ করা, যা দিয়ে একটি গল্প কিংবা উপন্যাস লিখা যায়। অনেক অভিধান পড়ার পর তিনি নির্বাচন করলেন ' ক' বর্ণকে।তারপর শুরু হলো তাঁর ' ক' বর্ণ দিয়ে শব্দ খোঁজা।১৯৯৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত শুধু তিনি শব্দই সংগ্রহ করেছেন। ২ লক্ষ শব্দ সংগ্রহ করলেন।তিনি খুব উদাস ভাবেই বললেন," এরই মধ্যে কত চড়াই-উতরাই, কত ভাঙাগড়া,কত অভাব অনটন,কত না পাওয়ার দুঃখ,কত যে না খেয়ে রাত জাগা,আপন আত্মীয়দের অবহেলা, তিরস্কার, পাগল উন্মাদ বলে কটুক্তি করা ইত্যাদি আরও কতকিছুতে কাল কেটে গেলো"। তাঁর এই জীবনের কষ্ট এবং কেষ্ট কবির কষ্ট যেনো মিলেমিশে একাকার। আমি তাঁর তিনটি বই পড়েছি।পড়ে অবাকও হয়েছি, 'ক' দিয়ে এতো শব্দ তিনি কিভাবে সংগ্রহ করলেন! এ যেনো এক শব্দ যুদ্ধ। বাংলা এবং কিছু ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন দক্ষতার সাথে। যেমন,

*"কথাটাকি কিরণ কুমার কারেক্ট কইছে কাকীমা?" -এখানে লেখক কারেক্ট শব্দটি ইংরেজি ভাষা থেকে নিয়ে ক এর অভাব পূরণ করেছেন।

* "কোশ্চেন করলাম, কেউ কর্ণপাত করোনি,ক্লাসের কর্মীরা কইলো করছি কর্তা।" - এখানে কর্মী মানে শিক্ষার্থী আর কর্তা মানে শিক্ষক।


"কেষ্ট কবির কনফারেন্স" এ তিনি লিখেছেন, "কার্তিকের কুড়িতে কবি কুঞ্জে কনফারেন্সের কাজারাম্ভ করলেন কবিগুরু কায়কোবাদ। কবি কুঞ্জের কোণায় কোণায় কাতারে কাতারে কবি।করুণাময়ীর কৃপায় কলেজ কর্মকর্তা কবি কায়কোবাদ কয়েকটা কবুতর করমুক্ত করে কনফারেন্সের কাজারম্ভ করলেন।" - এখানে "কবুতর করমুক্ত করে " এই শব্দগুলো খুব চমৎকার ভাবে ব্যবহার করেছেন,যেখানে কবুতর উড়িয়ে দিয়ে কাজ আরম্ভ হওয়ার বিষয়টি পাঠককুলের দৃশ্যপটে সহজেই ফুটে উঠেছে। তাঁর সাহিত্যে বা গল্পগুলোতে কেষ্ট কবি নামের চরিত্রটি মূলত নিপীড়িত সাধারণ মানুষেরই প্রতিচ্ছবি। তাঁর 'ক' বর্ণের শব্দগুলোতে ফুটে উঠে কেবল কেষ্টর কষ্টের কাহিনী, "কেষ্টরে, কষ্টের কথা কেউরে কইসনা।কইয়া কাম কি? কইলে কেবল করুণাই করবে।কটাক্ষ করে কথা কইবে।"

লেখক ইসমোনাক তাঁর এক জীবনের অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন যে সাহিত্য রচনায়, সেই সাহিত্য জগৎ থেকে তার প্রাপ্তি কতটুকু? সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কষ্ট সাধনার তুলনায় হয়তো তেমন কিছুই পাননি।তবে তিনি তাঁর সাধনায় সৃষ্টি করতে পেরেছেন যা তিনি চেয়েছিলেন, সেটাই বা কম কিসে।কিন্তু আমাদের সাহিত্য সমাজেরও কিছু দায় থেকে যায় তাঁর সৃষ্টিকে গ্রহণ করার, জানার এবং বাংলা ভাষাভাষী সকলকে জানানোর। দেশের প্রথম সারির বেশকিছু জাতীয় পত্রিকায় তাঁর এই বইগুলো নিয়ে লিখালিখি হয়েছে। এটিএন নিউজে ত্রিশ মিনিটের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়।এছাড়াও বাংলা নিউজ,মোহনা টেলিভিশনেও তাঁর সাহিত্য নিয়ে প্রচার হয়।তিনি পরিচিতি পেলেন।এদেশের মানুষ তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে জানলো।অনেকে অনেক ভাবে সম্মান ভালোবাসা জানালেন। তিনি সেজন্য সকলের নিকট কৃতজ্ঞ।লেখকের ইচ্ছে পৃথিবীর সকলে জানোক বাংলা ভাষাতেও টটোগ্রাম সাহিত্য রচিত হয়েছে তাঁরই হাত দিয়ে।ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার অন্তর্গত নোয়াগাঁও গ্রামের ইকবাল সর্দার মোহাম্মদ নাজমুল কবির - এর সৃষ্ট সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী হয়ে থাকুক, বিশ্বের সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাঁর এই সৃষ্টি সম্পর্কে জানুক এটাই কেবল লেখকের ইচ্ছে।

যতটুকু ইতিহাস বলে, তা হচ্ছে বাংলা সাহিত্যে এটিই টটোগ্রামের একক এবং বৃহৎ প্রচেষ্টা। তাঁর চব্বিশ বছরের সাধনার সৃষ্টির এই সাহিত্য যেন ইতিহাসে লিখা রয়। বাংলা সাহিত্যে প্রথম টটোগ্রাম পদ্ধতিতে কে 'ক' বর্ণ দিয়ে সাতাশ হাজার শব্দ ব্যবহার করে দীর্ঘতম সাহিত্য রচনা করেন? এ প্রশ্নের উত্তর যেন হয়, ইকবাল সর্দার মোহাম্মদ নাজমুল কবির যাঁর ছদ্মনাম ইসমোনাক।

 

কাজী খাদিজা আক্তার
প্রভাষক (ইংরেজি)
সরাইল সরকারি কলেজ

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top