সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

ভালোর ভালো কথা : ময়ূরী মিত্র


প্রকাশিত:
১৮ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৫২

আপডেট:
৭ মে ২০২৪ ২০:০৪

ছবিঃ : ময়ূরী মিত্র


রিকশাওয়ালা। দমদম স্টেশনের কাছে আমি যেখানে রিহার্সাল করি, সেই পাড়াতেই রিকশা চালান মানুষটি। বাকি সবার মত মোটরগতির রিকশা নেই তাঁর। পুরোনো চেহারা তাঁর রিকশার। তবু সতীর্থদের সমৃদ্ধি কখনো মলিন করেনি মানুষটিকে। অশ্বগতির রিকশার পাশে নিজের স্লো মোশনের রিকশাটি টানতে টানতে খোয়া যায়নি তাঁর রসবোধ, যা কিনা দারিদ্রের মাঝে অতি দুর্লভ।
এই রসবোধ সম্পর্কে দুটো ছোট ঘটনা বলব আজ। একবার হলো কী, রিহার্সাল রুমে পৌঁছে ভাড়া না দিয়ে সোজা ঢুকে যাচ্ছি ঘরে। ভাব হয়ে গেছে তো। তাই ঘাড় ঘুরিয়ে রোজই বাই দি তাঁকে। সেদিন বাই দিতে গিয়ে দেখলাম, উজ্জ্বল চোখ মেলে হাসছেন রিকশাকুমার। তখন মানে বুঝলাম না সে হাসির। পাল্টা হাসি ছুঁড়ে ঘরে ঢোকা মাত্তর জিভ কাটলাম। এই রে ভাড়া দিতে ভুলে গেছি যে !
ছুটছি রিকশার পিছু -" দাঁড়ান দাঁড়ান পয়সা নিয়ে যান।" এমন কিছু তাড়া বুঝলাম না তাঁর হাবভাবে। তাড়াহুড়ো করেনও না কখনো। অনেকদিনই দেখেছি ,নিবিষ্ট মনোযোগ দিয়ে যাত্রীকে তুলছেন -কখনো আমার মতো অগোছালো মহিলার শাড়ির কুঁচি গুছিয়ে দিচ্ছেন পাছে চাকায় ঘষে ছিঁড়ে না যায়। এইসব করতে গিয়ে যাত্রী পিছু অনেক সময় যায় তাঁর। অন্যান্যদের মত বেশি ভাড়া পাওয়ার স্বভাবজাত ত্বরা থাকে না তাঁর কখনোই। সেদিন কিন্তু ভাড়া না নিয়েই তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
পরের দিন হন্তদন্ত হয়ে বললাম -"এতবার ডাকলাম,পয়সা নিলেন না যে।"প্রশান্ত হাসি দিয়ে বললেন -"আর কখনো ভুল করবেন না বলে।" বললাম -"কীসের ভুল ? পয়সা না দেয়ার? ও তো আমি প্রায় করে থাকি।" অদ্ভুত এক উত্তর এলো তাঁর থেকে -ভুলটা পয়সা না দেয়ার নয় দিদি, ভুলটা পাশের লোকটাকে গ্রাহ্য না করার। আপনার পয়সার জন্য দাঁড়াতে পারি পরের পুজো অব্দি। উপেক্ষায় এক মিনিটও নয়। বুঝলাম এই প্রগাঢ় সম্মানবোধই মানুষটিকে আগাগোড়া নির্লোভ রাখছে।
আরেকদিন। রিকশায় অলরেডি তুলেছেন এক বিত্তবান মহিলাকে। হঠাৎ সামান্য নোংরা পোশাকে ছুট্টে এলেন এক বৃদ্ধা।" বাবা ওই রাস্তাতেই পরবে আমার বাড়ি। রোদ্দুরে এত বড় ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে পারছি না। ওঁর সাথে যদি তুলে নাও অর্ধেক ভাড়ায় চললে যেতে পারি।" সাজুগুজু মহিলা কিছুতেই রাজি না ওই দুঃস্থ বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিতে -জগতের কোনো বিত্তবান কোনো যেমন কোনো যুগেই রাজি হননি দরিদ্রকে একযানে নিতে। ঠিক তেমন করেই নারাজি ভাবটাকে চোখেমুখে ফোটাচ্ছিলেন সেদিনের ধনীবউ। রিক্সাওয়ালার গম্ভীর কন্ঠ -" আপনি নেমে যান। আমি বরং বুড়ো মানুষটাকেই বাড়ি দিয়ে আসি।" - পৌঁছে দিয়ে আপনমনে হাসি ?
হতভম্ব বড়লোকটার চোখের সামনে দিয়ে গরীব নিয়ে রিকশা ছোটালেন গরীব যানবাহক। যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেনও নেকিটাকে। ভাই পরিষ্কার দেখলাম, এবারও চোখে ডিপোজিট যত রাজ্যের মজা আর চুকচুকে এক হাসি। সেদিন থেকে আশা করে আছি - আগামীদিনে একটি দ্রুতগতি যান চালাবেন এই চালক। নিজের উপার্জনেই রাজপুত্র কিনবেন তাঁর ঘোড়ার বেগের যান। কিনবেনই।

অতিক্রান্ত হচ্ছে কিংবা just কেটে যাচ্ছে অতিমারির কাল। কৌতূহল হয় -কেমন করে কাটছে এমন সৎ মানুষের দিন। রাস্তায় আজকাল কম চলে লোক। তবু বিশ্বাস -এ চালক চাইবেন না অতিরিক্ত ভাড়া। কান্না চাপি - করুণায় খাটো হন যদি খাঁটিমানব !
চোখ মুদি।
দীঘি ভরা ঘাম।

 

 

ড. ময়ূরী মিত্র 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top