সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

মা হলো সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়ামত : পারভীন আকতার


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৩৪

আপডেট:
১ মে ২০২৪ ০১:১৫

 

একজন মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে বড় কিছুই নেই। শত প্রতিকূল পরিবেশেও সন্তানের জন্য মায়েরা অটল পাহাড়। চোখের নোনা জল, হাড়ভাঙ্গা অমানবিক পরিশ্রম একজন মায়ের প্রকৃত মা স্বত্ত্বাকে মুচড়ে দিতে পারে না। এজন্যই পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে মায়ের স্থান সবার উপরে দেয়া হয়েছে। " মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত"হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছেন। মা মানে পুরো বিশ্ব,মা মানেই জাগ্রত পৃথিবীর পথে নিশ্চিন্তে হেঁটে চলা। তাঁর বুকে থাকে সন্তানের জন্য আর্তনাদ, সুখে দুঃখের রক্ষাকবজ। জেনো সে একজনই আশ্রয়স্থল 'মা'।
নেপোলিয়ন বানোপাট বলেছেন, "তোমরা আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব।" সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই কেবল সে মায়ের স্পর্শ, ঘ্রাণ অনুভব করে।অন্য কারো কোলে গেলেও সে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। সে এক অদ্ভুত নাড়ীর টান। মায়ের সাথে সন্তানের এই সম্পর্ক চিরকালের।কখনোই কোনো বাঁধা মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে আলাদা করতে পারে না। অনেক সময় মা সন্তানের মাঝে রাগ অভিমান, চরম সম্পর্কের অবনতি হয় পারিপার্শ্বিক অবস্থাভেদে। তবুও কোথাও ব্যথা পেলে প্রথমেই,ওফ!মাগো বলি অবচেতন মনে। মা স্বত্ত্বায় জড়িয়ে থাকা অনন্য ব্যক্তিত্ব।তাঁকে অর্থ মূল্যে কেনা যায় না,সেলুলার পর্দায়ও দেখা যায় না। মা -ই আমাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তাঁর হাত ধরেই আমাদের মুখের বুলি ফোটে। ভাষাজ্ঞান তাঁর কাছ থেকেই প্রথমে আমরা শিখি। দীর্ঘ জীবন মায়ের এই শিক্ষার শেষ থাকে না, কোন বিরতি নেই সন্তান যতই বড় হোক। মায়েরা সন্তানদের শিক্ষা দীক্ষার মাঝে শান্তির আয়ত্ত্বে রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন।

মায়ের তুলনা কেবল মা নিজেই। পৃথিবীর কোনো কিছুই মায়ের সাথে তুলনা করা অসম্ভব। আর তা সমীচীনও নয়।মায়ের স্থান সর্বাগ্রে। শিশুকালে যখন খুব জ্বর হতো সারারাত মা বসে বসে জলপট্টি দিতেন,কত বার যে হালকা কুসুম গরম পানিতে শরীর মুখ মুছে দিন,মাথায় পানি ঢালতেন তার ইয়ত্তা নেই। আহা!কতই না যত্ম,সন্তানকে সুস্থ করতে জমের সাথে যুদ্ধ করেন একমাত্র মা। মায়েরা এমনি হন।প্রকৃত পক্ষে সত্যিকার মায়েদের মমতাময়ী রূপ এমনি।অনেকে হয়তো বলতে পারেন এখনকার মায়েরা খুব ফ্যাশনবল, বাইরের কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত।নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া। সন্তান এবং সংসারকে সময় তেমন দেন না।বিষয়টা হয়তো কারো কারো ক্ষেত্রে সঠিক।কিন্তু বর্তমানের অধিকাংশ মায়েরা সংগ্রামী যোদ্ধা। তাঁরা দুই হাতে ঘরে বাইরে সবদিক সামাল দিচ্ছেন আন্তরিকভাবে সফলতার সাথে। ঘরে বাইরে সমান তালে কাজকর্ম করে যাচ্ছেন। সন্তানের দেখাশোনা, পড়ালেখা ও নিজের ব্যবসা,চাকরী এবং নিজের চলার পথ তাঁরা ভালোভাবেই বুঝেন এবং নিয়মমাফিক সব দায়িত্ব পালন করেন। যাঁরা ছিটকে পড়েন তাঁদের কথা আলাদা। হয়তো তার ভিতর অনেক কারণ থাকতেই পারে।বাইরে থেকে যা সহজে অনুমেয় ভিতরে তার ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত। এমন ঘটনা রটনা অহরহ বিচার-বিবেচনায় খবরের কাগজে দেখা মিলে।
সময়টা বদলেছে।কিন্তু মাতৃ জঠর বদলায়নি এক ইঞ্চি পরিমাণ। সৃষ্টির আদিতে যা ছিল তা বর্তমান এখনো এবং ভবিষ্যতেও তা ঠিক একই রকম থাকবে। না বদলাবে মায়ের জাত আর না বদলাবে মায়ের দোয়া ও আশীর্বাদ। ক্ষণে ক্ষণে তাই আমরা কথায় কথায় 'মা'ডাক বলতে ভুলি না, মা যতই দূরে থাকুক না কেন।তিনি ঠিক বুঝতে পারেন তাঁর সন্তান তাঁকে স্মরণ করছে। "মা" আপাদমস্তক ব্যাপ্তি বিশাল এক অদ্ভুত রসায়ন। মহাজগতের অলীক সৃষ্টির বন্ধন মা - সন্তান স্নেহের রহস্যময় জুটি যা আজও কোনো সম্পর্ক উৎরে যেতে পারেনি এবং পারবেও না পৃথিবী ধ্বংসের শেষ দিন অবধি।
কবি বলেছেন,"মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই, ইহার চেয়ে নামটি মধুর ত্রিভুবনে নাই।"আসলেই" মা" শব্দটা এতটাই প্রশস্তিদায়ক,আরামের কিউটের ডিব্বার মতো পৃথিবীতে এর চেয়ে কোন ভালো শব্দ তেমন হৃদয় নাড়া দেয় না। সম্পর্কের বাঁধনে মা যে কতটা ত্যাগী শিশুকাল থেকেই তা দেখে দেখে আমরা বড় হয়েছি।লেখাপড়ার বিষয়ে একচুল পরিমাণ ছাড় দেননি।আজ তাই আমরা সদর্পে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারছি। সেই মাকে জানাই লাখো কোটি স্বশ্রদ্ধ সালাম। মায়ের মনে কষ্ট দিলে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। মায়ের দোয়া বা বদদোয়া বিদ্যুৎ বেগ থেকেও দ্রুত খোদার আরশে পৌঁছে। তাই সন্তানদের মাকে যথাথথ সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে পরিবারের সবার ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখা উচিত।
একটা সময় বাবা-মা, বৃদ্ধ -বৃদ্ধা হয়ে যান।অনেক সন্তান তখন মা বাবাকে তাদের ঘরের পুরানো আসবাবের মতো ছুঁড়ে ফেলতে চায়। অকেজো,রোগা,দিনরাত সেবাশুশ্রূষা করতে হয় বিধায় আপদ বিদায় করতে কোন বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে।তখন ভীষণ হতাশ হই যে, যখন সেই সন্তান বৃদ্ধ হবে তখন সেও তার মা বাবার সাথে নিষ্ঠুর আচরণের শিকার কি হবে না? নিশ্চিত হবে। দেশীয় একটি প্রবাদ আছে,"এই আইঁলের পানি ওই আঁইলে যায় না।" তার মানে হলো যে আইঁল (পানি যাওয়া আসা মাটির তৈরি নালা) পানি যাবে সে আইঁলই আজীবন পানি যাবে আসবে। অন্যকোন পথে নয়। সুতরাং মা বাবাকে কষ্ট দিলে একটা সময় সন্তানকেও তার কুফল ভোগ করে যেতে হবে এবং চাক্ষুষ অনেক প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। মায়ের পাশাপাশি বাবাও সংসারে সমান অংশীদার। বাবা না থাকলে মায়েরা এত সংগ্রাম একাকী করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। বাবাদের মনের খবরও সন্তানদের রাখতে হবে। এতে আর কেউ না হোক মা খুব খুশি হন।জন্মদাতা পিতা মায়ের সঙ্গে মিলেমিশে সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দানে উৎসর্গ করেন নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতা পরিহার করেন।

আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, "যার মা আছে সে কখনোই গরীব নয়।" আসলে সত্যিই তাই।মা হলো সুখ শান্তির ঐশ্বর্য। তাঁর কাছে পৃথিবীর দামী হীরে জহরতও পাশে স্থান পাবে না।
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন,"মা যেমন তাঁর নিজ পুত্রকে জীবন দিয়ে রক্ষা করেন তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে।" মা হলো সব থেকে খাঁটি সম্পদ ও সম্পত্তি। কোথাও যাওয়ার সময় মাকে বলে গেলে মা কতো খুশি হন! আবার ঘরে আসার সময় মায়ের জন্য একটি বিস্কুটের প্যাকেট আনলেও মা মহা খুশি! তিনিতো এসব একা কী খান না, সবাইকে নিয়ে খান।কেবল আনন্দ আর সম্মানটুকু দেখালেই মায়ের মন তৃপ্ত। তবে হালাল পথের রোজগারে মাকে দেখভাল করতে হবে।কখনোই অসৎ উপার্জন মায়ের মনকে শান্তি দেয় না। মায়েরা সর্বদা ভালো সচ্চরিত্রবান সন্তানের আয় রোজগার আশা করেন। হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন,"মায়ের অভিশাপ কখনো সন্তানের গায়ে লাগে না।দোয়া গায়ে লাগে।হাঁসের গায়ের পানির মতো অভিশাপ ঝরে পড়ে যায়।" মা কখনো সন্তানকে অন্তর থেকে অভিশাপ দেন না। হয়তো রাগ অভিমান হলে বকাবকি করেন অনেক সময় তা চরম আকার ধারণ করলেও প্রকৃতপক্ষে মা হৃদয় বিগলিত সন্তানের মমতা আশ্রয়ী।পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই সেই নিরাপদ ভালোবাসার আশ্রয়হারা করে সন্তানকে। তেমনি মায়ের জন্যও সন্তানের আছে বহু দায়িত্ব ও কর্তব্য। মাকে একা ছেড়ে কোথাও যেন না যায় সন্তান। এতে মায়েরা ভীষণ কষ্ট পান,একাকীত্বে ভোগেন। সন্তানের অভাব কেউ কখনো পূরণ করতে পারে না। সময়ের প্রয়োজনে সন্তান দূরে থাকলেও বছরে অন্ততঃ একটিবার সময় বের করে মাকে দর্শন দেয়া অনেক নেকীর কাজ। মরে গেলে মাকে দ্বিতীয়বার সচক্ষে দেখার সুযোগ হবে না আর কখনোই। ভুল বোঝা বুঝি হোক,মা সন্তান ভুল শুদ্ধ যা-ই করুক প্রকৃতপক্ষে একটি সময় সব শান্ত হয়,অতীত ভূগর্ভে চলে যায় সময়ের কৃত কার্যক্রম। মা সন্তানই রয়ে যায় অবশেষে সময়ের এগিয়ে যাওয়ায়।
পৃথিবীর সকল মায়েদের বুক সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়। আর সন্তানের জন্য বিপুল ঐশ্বর্যময় ঐশ্বরিক ভালোবাসার আশ্রয়স্থল "মা"।

 

পারভীন আকতার
শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top