সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

ঘুমন্ত সুন্দরী : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৪২

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৭

 

এক দেশে এক রাজা ছিলেন আর এক রানি। তাঁরা একে অন্যকে খুব ভালবাসতেন। কিন্তু তাঁদের মনে একটাই দুঃখ, তাঁদের কোনও সন্তান ছিল না।
একদিন নদীর পারে বেড়াতে বেড়াতে রানি ভাবছিলেন, আমার কোলে যদি একটা বাচ্চা থাকত, তা হলে আমি আর কিচ্ছু চাইতাম না৷
আর ঠিক তখনই জলের ভিতর থেকে লাফ দিয়ে একটা ব্যাঙ পাড়ে উঠে এল। রানির দিকে তাকিয়ে মানুষের গলায় বলল, তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে রানি। এক বছরের মধ্যেই তোমার একটি ফুটফুটে মেয়ে হবে।
ব্যাঙের কথা শুনে রানি তো মহাখুশি। আর সত্যি সত্যিই এক বছরের মধ্যে রানির একটা সুন্দর মেয়ে হল। যে দেখল, সে-ই বলল এমন সুন্দর বাচ্চা এর আগে তারা কখনও দেখেনি।
রাজামশাই তো আরও খুশি, তিনি ঠিক করলেন মেয়ের নামকরণ-উৎসবে একটা বিরাট ভোজ দেবেন। সেই মতো নানা রাজ্যের রাজা-রানি, রাজপুত্তুর-রাজকন্যাদের কাছে নেমন্তন্নের চিঠি পাঠানো হল। রাজ্যের জ্ঞানী পরীদেরও নেমন্তন্ন করা হল। কিন্তু জ্ঞানী পরিদের তো সোনার থালায় খেতে দিতে হয়। রাজ্যে ছিল মোট তেরোজন জ্ঞানী পরী। কিন্তু রাজার বাড়িতে ছিল মাত্র বারোখানা সোনার থালা। অথচ সব জ্ঞানী পরীকেই একসঙ্গে খেতে দেওয়ার নিয়ম। কাজেই, একজনকে বাদ দিয়ে বাকি বারো জন পরীকে নেমন্তন্ন করলেন রাজামশাই।
চমৎকার ভোজ সভা। সবাই ভাল ভাল পোশাক পরে এল। কত রকমের ভাল ভাল খাবার খেল সবাই। উপহারও পড়ল প্রচুর।
পরীদের প্রথা অনুযায়ী, প্রত্যেকটি পরী আশীর্বাদ করে রাজকন্যাকে একটি করে বর দিল। প্রথম পরী বর দিল, রাজকন্যা হবে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। দ্বিতীয় জন বলল, রাজকন্যার স্বভাব হবে খুব চমৎকার। তৃতীয় পরী বর দিল, রাজকন্যার গলার স্বর হবে অতি মধুর। সে নাইটিংগেল' পাখির মতো মধুর সুরে গান গাইতে পারবে। চতুর্থ পরী বলল, বাতাসে গাছের কচিপাতা যেমন করে নাচে, রাজকন্যা ঠিক তেমনি সুন্দর করে নাচতে পারবে।
এমনি করে এগারো নম্বর পরী যখন বর দিচ্ছিল তখন তেরো নম্বর পরী হঠাৎ সেখানে এসে হাজির হল। তাকে নেমন্তন্ন করা হয়নি দেখে সে রাগে কাঁপছিল। বাচ্চার মুখের কাছে আঙুল নেড়ে সে বলল, এই রাজকন্যার বয়স যখন পনেরো বছর হবে, তখন ওর আঙুলে সুতো কাটার টাকুর খোঁচা লাগবে। আর তাতেই ও মরে যাবে।
তেরো নম্বর পরীর অভিশাপের কথা শুনে রাজা আর রানি দুঃখে ভেঙে পড়লেন।
এ বার বাচ্চার কাছে এগিয়ে এল বারো নম্বর পরী। বাচ্চার মুখের উপর ঝুঁকে সে বলল, আমি অভিশাপটাকে পুরোপুরি কাটিয়ে দিতে পারব না, তবে একটুখানি পালটে দিতে পারব। আমি বলছি, ওর আঙুলে যখন টাকুর খোঁচা লাগবে, তখন ও পুরোপুরি মারা যাবে না, গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়বে। আর সে ঘুম ভাঙবে একশো বছর পরে।
রাজামশাই ভাবলেন, তেরো নম্বর পরী বলেছে, সুতো কাটার টাকুর খোঁচা লেগে ও মরে যাবে। কিন্তু আমি যদি সমস্ত টাকুই ভেঙে ফেলি, তখন ওর হাতে আর টাকুর খোঁচাও লাগবে না। ও মারাও যাবে না। সুতরাং রাজামশাই তখনই আদেশ দিলেন, রাজ্যের সমস্ত সুতো কাটার টাকু এক্ষুনি ভেঙে ফেলো।
তাঁর আদেশে সমস্ত টাকু ভেঙে ফেলা হল। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই সে রাজ্যের প্রায় সমস্ত লোকই টাকু দিয়ে সুতো কাটতে ভুলে গেল।
এক বছর যায়... দু'বছর যায়... রাজকন্যা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগল। পরীদের আশীর্বাদও ফলতে শুরু করল। রাজকন্যা যেমনি সুন্দরী তেমন তার চমৎকার স্বভাব। সে গান গাইতে পারে নাইটিংগেল পাখির মতো। নাচতে পারে তিরতিরে কচিপাতার মতো।
দেখতে দেখতে রাজকন্যা পনেরো বছরে পা দিল। তার জন্মদিনের দিন রাজা আর রানিকে রাজ্যের অত্যন্ত জরুরি একটা কাজে কয়েক ঘণ্টার জন্য প্রাসাদের একটু বাইরে যেতে হল। রাজকন্যাকে দেখাশোনার জন্য প্রচুর লোক থাকলেও রাজবাড়িতে কিন্তু রাজকন্যা মনে মনে একেবারেই একা।
একা একাই রাজপ্রাসাদে ঘুরে বেড়াতে লাগল সে। ঘুরতে ঘুরতে প্রাসাদের মধ্যেই একটা সরু পথ দেখতে পেল। এই পথটা আগে সে কখনও দেখেনি। হঠাৎ দেখল, পথের শেষে একটা অন্ধকার ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের দিকে।
সেটা বেয়ে উপরে উঠতে লাগল রাজকন্যা। এ পথটা কেউ ব্যবহার করে না। তাই পরিষ্কারও হয় না। যত রাজ্যের ঝুল, মাকড়সার জাল আর জঞ্জাল জমে রয়েছে। রাজকন্যা মুখের উপর থেকে মাকড়সার জাল সরাতে সরাতে উঠতে লাগল।
সিঁড়ির মাথায় একটা দরজা। রাজকন্যা কৌতূহলী হয়ে সেই দরজাটা খুলে ফেলল। ভিতরে একখানা ঘর। সেখানে একটি বুড়ি বসে সুতো কাটছে।
রাজকন্যা আগে কখনও সুতো কাটা দেখেনি। ঘুরন্ত টাকু দেখে সে অবাক হয়ে গেল। বুড়িকে সে জিজ্ঞেস করল। কী ওটা?
--- কোনটা? পাল্টা প্রশ্ন করল বুড়ি।
--- ওই যে ওটা। যেটা কেবল ঘুরে যাচ্ছে।
বুড়ি বলল, ওটাকে বলে টাকু। সুতো কাটে।
রাজকন্যা বলল, আমি সুতো কাটব।
--- বেশ তো কাটো না... বুড়ির মুখে বাঁকা হাসি।
রাজকন্যা টাকুটা ধরতেই তার আঙুলে খোঁচা লেগে গেল। বেরিয়ে এল একফোঁটা রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে দারুণ ঘুম পেল তার। ঘরের মধ্যে একটা বিছানা ছিল। গভীর ঘুমে সে ঢলে পড়ল সেখানে।
শুধু সে নয়, ঘুমপরী যেন ঘুমপাড়ানী গান গেয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
ঘুম... ঘুম... ঘুম... ঘুমিয়ে পড়লেন সেলাইয়ের কাজ করতে করতে প্রাসাদের অভিজাত মহিলারা। ঘুমিয়ে পড়ল প্রাসাদের দাসদাসীরা। হাতের ঝাঁটা আর ঝাড়ন হাতেই ধরা রইল। বাসন মাজা ছোকরা চাকরটার কান মলে দিতে যাচ্ছিল রাঁধুনী, সেই অবস্থাতেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। তার তোলা হাত তোলাই রইল। যেন ঘুম নয়, সবাই যে যে-অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাতেই স্ট্যাচু হয়ে গেল।
রাজামশাই আর রানিমা ফিরে এলেন প্রাসাদে। কিন্তু তাঁরা হলঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁদের জুড়িগাড়ির কোচম্যান ঘুমিয়ে পড়ল আঙিনায়। ঘোড়াও ঘুমাল। ঘুমিয়ে পড়ল সহিসেরাও। চুল্লির আগুনও নিভু নিভু হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
প্রাসাদের পশুপাখিরাও ঘুমের জাদুর হাত থেকে রেহাই পেল না। ছাদের উপরের পায়রারা বক্ বকম্ থামিয়ে ডানার ভিতর মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘোড়ারা ঘুমিয়ে পড়ল আস্তাবলে। পোষা বেড়ালটাকে একটা বাটি করে দুধ খেতে দেওয়া হয়েছিল। সে দুধ খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়ল। রাজবাড়ির কুকুরগুলো মাংসের হাড় চিবোতে চিবোতে ঢলে পড়ল ঘুমের কোলে।
ঘুম... ঘুম... ঘুম... গোটা রাজবাড়িই তার বাসিন্দাদের নিয়ে চলে গেল ঘুমের দেশে।
ক্রমে ঘুমন্ত রাজবাড়ির চারপাশে গজিয়ে উঠল কাঁটা ঝোপ আর বন-গোলাপের ঝাড়। ঝোপ-ঝাড় বাড়তে বাড়তে রাজবাড়িটাকে একেবারে ঢেকে ফেলল। জেগে রইল কেবল সবচেয়ে উঁচু মিনারের মাথাটা। সেখানে পতাকা দণ্ডের মাথায় শুধু দেখা যেতে লাগল রাজপতাকা। কিন্তু ঘুমের মায়ায় সে পতাকাও বুঝি একেবারে স্থির। হাজার বাতাসেও এতটুকু নড়ত না।
সমস্ত দেশে একটা গল্প চালু হয়ে গেল। সবাই বলত, কাঁটা ঝোপ আর বন-গোলাপের ঝাড়ের মধ্যে একটা প্রাসাদ আছে। সেই প্রাসাদের মধ্যে জাদুর মায়ায় ঘুমিয়ে রয়েছে এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যা। সবাই তাকে বলত ঘুমন্ত সুন্দরী। নানা দেশ থেকে কত রাজকুমার, কত বীরপুরুষ আসত কাঁটা-ঝোপের জঙ্গল পেরিয়ে রাজকন্যার কাছে যাবার জন্য। কিন্তু তাদের কেবল কষ্টই সার হত। কেউই জঙ্গল পেরোতে পারত না। মাঝখান থেকে তাদের পোশাক ছিঁড়ে যেত, হাত-পা ছড়ে যেত। রক্তপাত হত।
এমনি করেই কেটে গেল একশো বছর। শেষ হয়ে গেল পরীর অভিশাপের কাল।
দূর দেশের এক রাজকুমারও ঘুমন্ত সুন্দরীর গল্প শুনেছিল। সে ভাবল, একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী! দেখা যাক না ভাগ্যে কী আছে!
এ কথা ভেবে সেই রাজকুমার ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেরিয়ে পড়ল ওই রাজপ্রাসাদের উদ্দেশে। অনেক পাহাড়, অনেক নদী পেরিয়ে ভিনদেশের রাজকুমার অবশেষে এসে পৌঁছল কাঁটা-ঝোপ আর বন-গোলাপের বনের সামনে। এ বার এ জঙ্গল পেরিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে।
রাজপুত্র কাছে আসতেই গোলাপ বনে হাজার হাজার সুগন্ধী ফুল ফুটে উঠল। কাঁটা-ঝোপগুলি ভরে গেল কচি কচি পাতায়। অত আগাছার মধ্যেও একটা সরু পথ দেখা গেল। সে ভাবল, নিশ্চয় এ পথ ধরে সহজেই সে ঘুমন্ত পুরীতে যেতে পারবে।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ধীরে ধীরে প্রাসাদের ভিতরে ঢুকল রাজপুত্র। বিরাট হল ঘরটার মধ্যে দিয়ে পা টিপে টিপে সে এগোল। রাজা ঘুমাচ্ছেন। রানি ঘুমাচ্ছেন। ঘুমাচ্ছেন সভাসদেরা।
সামনে একটা ঘোরানো সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। রাজকুমার উপরে উঠতে লাগল। ঘুমন্তপুরী একেবারে নিঝুম। কোথাও কোনও শব্দ নেই। সেই নীরবতাকে ভেঙে দিল রাজকুমারের পায়ের শব্দ আর তার প্রতিধ্বনি। রাজকুমারের বুকের ধুকধুকানিটুকু পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল।
রাজকন্যা যে ঘরে মরণঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিল, সেখানে এসে দাঁড়াল রাজপুত্র। ঘুমন্ত রাজকুমারীর দিকে তাকাল। এমন সুন্দর মেয়ে এর আগে সে কখনও দেখেনি। নিচু হয়ে সে রাজকন্যার মাথায় হাত রাখল আর হাত রাখতেই সঙ্গে সঙ্গে জাদুর মায়া কেটে গেল। রাজকন্যা জেগে উঠল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক টুকরো মিষ্টি হাসি।
তার পর রাজা জাগলেন... রানি জাগলেন... আগলেন সভাসদেরা। প্রাসাদের অভিজাত মহিলারা সেলাই করতে লাগল।
দাসদাসীরা ঝাঁটা আর ঝাড়ন দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল উঠোন, ঘরবাড়ি। বাসন-মাজা ছোকরা চাকরটা একলাফে সরে গিয়ে কান ধরতে আসা রাঁধুনির হাত এডাল।
আস্তাবলে ঘোড়াগুলি ডেকে উঠল। কুকুরগুলো মাংসের হাড় চিবোতে লাগল। ছাদের পায়রারা ডানার ভিতর থেকে মুখ তুলে বক বকম্ শুরু করল। বিড়ালটা আবার বাটি থেকে চুকচুক করে দুধ থেকে লাগল। নিভে যাওয়া চুল্লির আগুন আবার জ্বলে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ঘুমন্তপুরী আবার ভোগে উঠল। যেন মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া এই একশো বছরটাকে ইরেজার দিয়ে কেউ মুছে দিল। ফলে যে বয়সে যে থমকে গিয়েছিল, সেখান থেকেই ফের শুরু করল জীবন-যাত্রা।
আর যার জন্য এটা ঘটল, ভিনদেশের সেই রাজকুমারের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল ক'দিন পরেই। সে বিয়ে খুব ধুমধাম করেই হল। রাজা খুশি... রানি খুশি... খুশি রাজকুমার আর রাজকুমারীও। সেই খুশি থেকে বাদ গেল না ওই দেশের প্রজারাও।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top