সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

রমজানে কলকাতার স্বপ্নের জাকারিয়া স্ট্রিট : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৫৪

আপডেট:
১ মে ২০২৪ ০১:৫৭

 

করোনার ভয়াবহ প্রভাব মুক্ত কলকাতা। স্বপ্নের উৎসবে মেতে উঠতে চলেছেন কলকাতার মানুষ। দুঃসম কাটিয়ে পবিত্র মাস রমজান চলছে। গোটা এক মাস দিনভর রোজা বা উপোস রাখার পর পালিত হবে খুশির উৎসব ঈদ। প্রতি বছর এই সময়ে দেশের আরও অনেক শহরের মতোই কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট সেজে ওঠে নতুন এক সাজে। চারপাশ ভরে থাকে লোভনীয় সব খাবার। স্বাদে-গন্ধে খাবারের উৎসব চলে সারা রাত জুড়ে। কিন্তু এবারে করোনা আতঙ্ক নেই। বদলে গিয়েছে সব। ২৫০ বছরে তিহ্যবাহী ফুড স্ট্রিট জাকারিয়া।
বলা হয়, ভোজনরসিক বাঙালির কাছে যেন স্বর্গ কলকাতার জাকারিয়ার স্ট্রিট। রমজানের সময়ে এই স্ট্রিটটিতে কী না পাওয়া যায়! গোটা রাস্তা সেজে ওঠে শিক কাবাব, টেংরি কাবাব, নিহারি, হালিমে। মালপোয়া, জিলিপি, ফিরনিতে কিছু কম যায় না মিষ্টির তালিকাও। কাছেই নাখোদা মসজিদ।
মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এই রাস্তায়। খাবার প্লেটে ভাগ হয়ে যায় খুশি। সুস্বাদু ধোঁয়ায় উড়ে যায় ধর্মীয় বিভেদ।
এবারেও তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল। সারাদিন রোজা রেখে দিনের শেষে দল বেঁধে হাতে হাত রেখে ইফতার করার কথা ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। ভোজনরসিকদের তো বটেই, ভোজনরসিক মানুষের কাছেও এই স্ট্রিট খুবই প্রিয়। আবার কেবল ভালোবাসার।


দীর্ঘদিন ধরেই কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটের সঙ্গে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় মাঝে মাঝে খাদ্যের লোভে পৌছলাম এখানে। এক বর্ণিল ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাকারিয়া স্ট্রিট। সমগ্র বিশ্বের ভোজনরসিক মানুষের স্বপ্নপূরণের আদর্শ ঠিকানা। পবিত্র ঈদের সময় জাকারিয়া স্ট্রিট একটু অন্যরকম ভাবেই সেজে ওঠে। বেশ কয়েক বছর রমজান মাসে ঘুরে এসেছিলাম জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে। প্রতিবছরের মতো এবছরও জাকারিয়া স্ট্রিটে বসেছিল বিভিন্ন খাদ্যের আয়োজন। স্থায়ী দোকানগুলি তো বটেই, কিছু কিছু নতুন স্টল গড়ে উঠেছে প্রধানত এই রমজান মাসের জন্যই। কোন কোন স্থায়ী দোকান আবার দোকানের বাইরে স্টলের আয়োজন করে নতুন কিছু আইটেম বিক্রি করছে। চারিদিকে প্রচুর মানুষের ভিড়, এ যেন আরেক ধরনের খাদ্য মেলা। আমরা আমাদের খাওয়া দাওয়া শুরু করলাম আল বেক নামের একটি দোকান থেকে, এখানে খেলাম মাটন আফগানি কাবাব। নুনের পরিমাণ একটু বেশি হলেও টেস্ট ছিল অসাধারণ। এই দোকানে চিকেন এবং মটন ছাড়াও প্রচুর মাছের আইটেম ছিলো, কাতলা ভেটকি ইত্যাদি। এই আলবেক এর পাশের গলি বরাবরই চলে গেলাম জাকারিয়ার খুব বিখ্যাত দোকান অ্যাডামস কাবাব শপ এ। এখানে প্রধানত দু'ধরনের কাবাব পাওয়া যায়, সুতা কাবাব আর বটি কাবাব। সুতায় পাকানো মিহি করে বাটা মাংস দিয়ে বানানো হয় এই সুতা কাবাব, আর ছোট ছোট টুকরো করা মাংস দিয়ে তৈরি হয় বটি কাবাব। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন বটি কাবাব ছিলোনা বলে, আমরা খেলাম চিকেন ও বিফ সুতা কাবাব। টেস্ট খুবই সুন্দর। ওখান থেকে আমরা চলে গেলাম উল্টোদিকের গলি বরাবর নাখোদা মসজিদের দিকে। এই সাইডে দুটি বিখ্যাত দোকান আছে, তাসকিন এবং দিল্লি 6। দুটোতেই ছিল অসম্ভব মানুষের ভিড়। তাসকিনের বাইরে লাইন পড়ে গিয়েছিল ফালুদার লস্যি খাবার জন্য, আমরা অনেকক্ষণ লাইন দিয়ে শেষমেষ ফালুদা না পেয়ে rose লস্যি দিয়েই পেট ঠান্ডা করলাম। ফেরার আগে হালিম খেলাম রাস্তার ধারের একটি অস্থায়ী স্টল থেকে। নামি দোকান না হলেও এখানকার হালিমের স্বাদ ছিল সত্যিই অসাধারণ। সামনের মাসের 3 তারিখে ঈদ হয় শেষ হবে এই রমজান বা রামাদান। যারা এই ধরনের খাবার-দাবার খেতে পছন্দ করেন তারা অবশ্যই জাকারিয়া থেকে ঘুরে আসুন ঈদের আগেই।
রমজানি স্বাদে জাকারিয়া যেন শহরের ফুড স্ট্রিটএকমাত্র রমজানের কলকাতা তার খুঁটিনাটি জানে। ফিয়ার্স লেন, কলুটোলার দিক থেকে জাকারিয়া স্ট্রিট— নাখোদা মসজিদের পাড়ায় পদে পদে অপেক্ষমান অজস্র বিস্ময়। রমজানের সেরা পদ মাহি আকবরি আর মুর্গ চেঙ্গিসি।

এমনিতে এ পা়ড়ার বাতাসে সারা বছর মিশে থাকে সুখাদ্যের সুরভি। কিন্তু রমজানে এ তল্লাট দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানেই ‘ফুডওয়াক’!
শেষ বিকেলে মাগরিবের নমাজের সামান্য আগে মাহি আকবরি আর মুর্গ চেঙ্গিসি-র ঠেকেই দেখা নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যাপক বন্ধু প্রণব সরকারের। কলকাতার বন্ধুরা রমজানে এ পাড়ায় আসে, সবার সঙ্গে মিলিত হবার একটা বড় সুযোগ । ‘‘শুধু রোজাদারেরা নন, গোটা কলকাতার খাইয়েরাই আসেন।’’— হেসে বললেন আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে চাকরি করে আমার স্যারের ছেলে আবু সাঈদ লস্কর।এখানকার স্বপ্নের কারিগর-মুরগির স্বাদ-স্রষ্টা মহম্মদ আলাউদ্দিন। বছরভর লস্যি, ফালুদা, কফি বিক্রি করেন খালেক সাহেব। কিন্তু রমজানে তাঁর মাছ-মুরগির পদ জাকারিয়ার গৌরব।
রমজান বলতেই থকথকে মাংসভরা ডালের মতো হালিমের খিদে পায় আমবাঙালির। পার্ক সার্কাস, জাকারিয়া, খিদিরপুরের বাইরে কলকাতার হালিম-মানচিত্র এখন বিস্তৃত হাতিবাগান, নাগেরবাজার, গড়িয়াহাটেও। তবু জাকারিয়ার মেনুর বৈচিত্র্যই আলাদা। শীতে সুফিয়ানার প্রভাতী মাংসের ঝোল নিহারির মতো রমজানেও স্বাদ-অস্ত্র উপুড় করে সে। কলুটোলার ইসলামিয়া হোটেলের স্পেশাল হালিমে গুল্লি গুল্লি মাটন কোফতার মিশেল অনেককেই এ পাড়ায় টেনে আনে। ফিয়ার্স লেনের দিকের শতাব্দী-প্রাচীন মেঠাইওয়ালা হাজি আলাউদ্দিনের ভাঁড়ারে নানা কিসিমের স্পেশাল খাজলা। এই খাজলা আদতে কম মিষ্টি খাজা, যা দুধে ডুবিয়ে খেতে অমৃত।
কলুটোলা থেকে বলাই দত্ত স্ট্রিট ধরে ডাইনে বেঁকে জাকারিয়ার মুখে এগোতেই আবার স্পেশাল বাখরখানির ‘স্টেশন’। ৮০ টাকার শুকনো, ফুরফুরে, প্রকাণ্ড গোলাকার দুধে ভিজিয়ে প্রাতঃরাশের মাওয়াঠাসা রুটি। ১০ দিন তাজা থাকবে বাখরখানি। মেটিয়াবুরুজ থেকে আসা মহম্মদ আখতারের স্টকে রয়েছে স্পেশ্যাল খাস্তা বিস্কুট পাকিজা, মাকুটি বা মাংসের ঝোল দিয়ে খাওয়ার মিষ্টি রুটি শিরমল। দিলশাদ কবাবির খিরি কাবাব, সুতি কাবাব বা কলুটোলায় চিকেনের পেয়ারে কবাব তো বছরভর মেলে! রমজানে পদে পদে মাংসের কুচিভরা সামোসা, দইবড়া, পাঁচ টাকার ফলটলের সঙ্গে আমিনিয়া, সুফিয়ানার স্পেশাল বিরিয়ানিও দেদার। দুধেল সরের প্রলেপ জড়ানো রমজানি শাহি টুকরাও বড় মধুর। বেলা বারোটা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত সরগরম গোটা তল্লাট।
এত ভিড়েও স্বাদ, যত্ন, আয়োজন নিয়ে ভয়ানক খুঁতখুঁতে সাহাবুদ্দিন সাহেব। মাছ-চিকেনের গায়ের ৫৫ না ৪৫ রকমের মশলা হামানদিস্তায় গুঁড়ো হবে। মানিকতলা বাজারের আধ কেজি কাতলাপেটি থেকে মাছের জন্য খাঁটি সর্ষের তেল, চিকেনের ঘি-ডালডার মান, রান্নার তামার বাসন— একফোঁটা আপস নেই।
অস্থায়ী দোকানে বাগদা চিংড়িতে মশলা মাখাতে মাখাতে বসিরহাটের যুবক আব্দুল শেখ হাসলেন, ‘‘উপোস করে খাটনির ধকল থাকলেও রোজগারও এখন ডবল।’’
করোনার ভয়াবহ প্রভাব নেই আজ কলকাতায়। গত দুবছর সেই ভাবে রমজানের খাদ্যের উৎসবে সামিল হতে পারেনি আমখাদ্যরসিক মানুষ। এ বছর আট থেকে আশিরমানুষ রমজানের উৎসবে সামিল হতে চলেছেন। কলকাতার বিভিন্ন জায়গাতেই তার চূড়ান্ত প্রস্তুতিপর্ব চলছে। পবিত্র ঈদের উৎসব পালিত হোক আনন্দে । এ উৎসব মহা মিলনের হোক।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top