সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

ক্রীতদাসের হাসি যেন এক জীবন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
১৮ মে ২০২৩ ২২:৫৬

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৩৮

 

জীবনে সুখ-দুঃখ আপেক্ষিক বিষয়। আর এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে হাসি-কান্না নামক অভিব্যক্তিতে। হৃদয়ে ধারণ কিংবা অন্তরে অনুভব করা ছাড়া এই অভিব্যক্তি যে কতটা দুষ্প্রাপ্য সেটা বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের 'ক্রীতদাসের হাসি' উপন্যাসে।রাজপ্রাসাদের অদূরে স্ত্রীর সঙ্গে ক্রীতদাস ‘তাতারির’ অফুরান সুখের হাসি চঞ্চল করে তোলে সম্রাট হারুনকে। সেই হাসি নিজের করে নিতে ক্রীতদাস তাতারিকে নিজের ধন-সম্পদের ও প্রাচুর্যের মাঝে বন্দী করেন সম্রাট। শৃঙ্খল বন্দী তাতারি হাসতে ভুলে যান। এমনকি সম্রাটের প্রবল হুকুমেও সেই অনাবিল সুখ-হাসি আর জাগ্রত হয় না। ফলে ক্রুদ্ধ সম্রাটের নির্দেশে তাতারির বিচ্ছিন্ন গর্দান মাটিতে পড়ে যায়। 'ক্রীতদাসের হাসি' উপন্যাসটি আরব্য রজনী আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা-এর শেষ গল্প 'জাহাকুল আবদ'- এর অনুবাদ। রচনা এবং প্রকাশকাল অনুযায়ী ধারণা করা হয় এ উপন্যাসে রূপকারের আইয়ুবি স্বৈরশাসনের স্বরূপ এবং পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের অন্তরের কথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে উপন্যাসটি যেন মানব জীবনের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। শওকত ওসমানের রূপকধর্মী এ উপন্যাসটি ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাবশি গোলাম তাতারি। খলিফা হারুণ অর রশিদের হাবসি ক্রীতদাস ও আর্মেনীয় দাসী মেহেরজানের প্রেমের স্বীকৃতি দেন খলিফার স্ত্রী জুবায়দা। খলিফার অজান্তেই রাজমহিষী তাদের দুজনের বিবাহ দেন। বিবি জুবায়দার অনুমতিক্রমেই প্রতি রাতে নির্ধারিত স্থানে তারা দেখা করত। খলিফা হারুনুর রশিদ বাগদাদের অধিপতি। উজিরে আজম জাফর বার্মাকির হত্যার আদেশ কার্যকর হওয়ার পর তার মধ্যে মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। একদিন রাতে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নির্মল হাসির শব্দ শুনতে পান তিনি যা তার হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই হাসির উৎস খুঁজতে গিয়েই তিনি দেখতে পান গোলাম তাতারি ও তার স্ত্রী মেহেরজানের প্রণয়দৃশ্য এবং শোনেন তাতারির প্রাণখোলা হাসি। ক্রীতদাস পল্লীতে চরম দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস করলেও তাদের এই হাসি থামে না।যেন এক সুখের হাসি লেগেই থাকে তাদের মুখে। বাদশাহ হারুন রূপবতী দাসী মেহেরজানকে রানীর মর্যাদা দিয়ে প্রাসাদে নিয়ে আসেন। তাতারিকে একটি রাজ্যের রাজত্ব দেয়া হলো। অন্য আরো সুবিধা দিয়ে বলা হলো এর বিনিময়ে খলিফা প্রাণখোলা হাসি শুনতে চান কিন্তু তাতারী আর হাসে না। তাতারির প্রাণখোলা হাসির উৎস ছিল প্রিয় মেহেরজান। সে এখন খলিফার রানী। প্রিয়া বিরহে তাতারি প্রাণখোলা হাসি তো দূরের কথা, সামান্য হাসিও হাসতে পারে না। এতে খলিফা অপমানিত বোধ করেন। হাসি শোনানোর জন্য তাতারিকে বারংবার সময় দেয়া হয়। বাগদাদের সবচেয়ে সুন্দরী ও আবেদনময়ী নর্তকীকে তাতারীর মহলে পাঠানো হয়। কিন্তু সে তাতারিকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়। বরং তাতারির নৈতিকতার কাছে পরাজিত হয়ে সে আত্মহত্যা করে। এ আত্মহত্যাকে হত্যা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে তাতারির ওপর এর দায় চাপানো হয়। তার বিচার হয়। সাহিত্যে সমাজের অনিয়ম, অনাচার ফুটে ওঠে। আর এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন লেখক, কবি, সাহিত্যিকেরা। এখানেও খলিফার নির্দয়তায় আপত্তি তোলেন কবি নওয়াস। ফলে তাকে রাজদরবার থেকে বহিষ্কারও হতে হয়।
তাতারিকে হাসাতে ব্যর্থ হয়ে খলিফা তার ওপর নির্যাতন শুরু করেন। তাতেও কাজ হয় না। সকল প্রকার অত্যাচার নির্যাতনে সে নীরব থাকে। অতঃপর সর্বশেষ কৌশল হিসেবে মেহেরজানকে তাতারীর কাছে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু মেহেরজান এখন তাতারীর প্রেমিকা নেই, এখন সে খলিফার রানী। প্রথমে মেহেরজান তাতারীকে চিনতেই পারে না। পরে চিনতে পারলেও প্রাক্তন প্রেমিককে সে কোনো কথাই বলাতে পারেনি। শত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে খলিফা হারুন দুঃখে, ক্ষোভে চরম উত্তেজিত হয়ে তাতারী্ রিকে চাবুক মারার আদেশ দেন। মেহেরজান চলে যাওয়া শুরু করলে তাতারী মুখ খোলে। মেহেরজানকে পিছু ডাক দেয় এবং খলিফাকে বলে-শোন, হারুনুর রশিদ। দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব! কিন্ত ক্রীতদাসদের হাসি না। এ উক্তিই উপন্যাসের জীবনদর্শন। এ পর্যায়ে কবি নওয়াস মন্তব্য করেন- আমিরুল মোমেনিন, হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি। কবি নওয়াসের কণ্ঠে অসাধারণ এ উক্তিটির মাধ্যমে উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে।
একটা জীবন বা সময়কে বুঝতে তার পারিপার্শ্বিক সময়ের সমস্ত বিষয় জানা জরুরি। সে হিসাবে এ উপন্যাসের প্লটকাঠামো যে বিভক্ত ভারতের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ ও বঞ্চনার ইঙ্গিত, তা সুস্পষ্ট ।‘উপন্যাসের তাতারি চরিত্র মূলত তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতিনিধি এবং সম্রাট চরিত্র ‘পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্রের’। এ উপন্যাসেও দেখা যায় সম্রাট চরিত্র প্রলেতারিয়েত বা নিম্নবর্গীয় শ্রেণি ‘ভৃত্য তাতারি’কে আড়ষ্ট এবং দাবায়ে রাখতে চেয়েছিল। কবজা করে রাখতে চেয়েছিল তার মৌলিক চাহিদাসম্পন্ন স্বপ্ন বাস্তবতাগুলোকে যা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top