সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

আকাঙক্ষার বিড়াল : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
১৩ জুলাই ২০২৩ ১৪:০৪

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৫৮

ছবিঃ আফরোজা পারভীন


দুটো বিড়াল সারাক্ষণ বারান্দায় হুটোপুটি করে। কখনও ফুলের টবে উঠে লাফালাফি করে, প্রাতঃকর্ম করে মাটি চাপা দেয়, আবার কখনও বারান্দার সোফার নিচে ঢুকে বাচ্চা ফোটায়। অনেকগুলো বাচ্চা নিয়ে একসাথে বের হয়। দরজা খোলা পেলেই টুপ করে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ ঘর থেকে ও ঘরে যায়। যা সামনে পায় তাই সাবড়ে দেয়। এ নিয়ে মহা সমস্যা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স জুড়ে। অনেকবার মিটিং বসেছে, অনেকে নির্দেশনা এসেছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বিড়ালের জন্য জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। বলাবাহুল্য বিড়াল পালকরা তাতে মোটেও ঘাবড়ায়নি। তারা সদর্পে বিড়াল পালছে। বিড়াল ধরতে পারলে এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণাও হয়েছিল। পুরস্কারের লোভে অনেকে বিড়াল ধাওয়া দিয়েছিল। সন্তর্পণে ধরার চেষ্টাও করেছিল কেউ কেউ। ধরতে পারেনি। ওদের অপ্রতিরোধ্য গতি রোধ করা যায়নি। ওদের সাথে দৌড়ে পাল্লা দেবার মতো লোক কমই আছে। এ কমপ্লেক্সের অধিকাংশ লোক অবসরভোগী। তাদের গাঁটে, কোমরে, পায়ে ব্যথা। বিড়াল ধরার সামর্থ্য তো দূর, চিন্তাও তারা করে না। চেষ্টা যা করার তাদের ছেলে মেয়েরা করেছিল। একবার একটা বিড়ালকে ধাওয়া দিলে সে ছয়তলা থেকে পড়ে গিয়েছিল । বিড়ালটা মারা গিয়েছিল। তা নিয়ে বিড়ালের মালিক অনশনে বসেছিল। তখন কমপ্লেক্সের লোকজনের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয়েছিল। এ কমপ্লেক্সে বিড়াল বিরোধী সিংহভাগ তবে বিড়ালপ্রেমীও কিছু আছে। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ালকে খাবার দেয়, গোসল করায় । আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে বিড়ালের তেজ বাড়ে।
কমপ্লেক্সের বেশিরভাগ লোক বিশ^াস করে পালকদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিলে বিড়াল পালা বন্ধ হতো। তা নেয়নি এপার্টমেন্ট কমিটির লোকজন।
নাসিমা বেগমের বরাবরই বিড়ালে বিরক্তি। শুধু বিড়াল কেন, সব ধরণের পশুতেই তার বিরক্তি। একুইরিয়ামে মাছ দেখতে ভালবাসেন তিনি। কিন্তু ওই মাছ লালনপালনের যে হ্যাপা তা তিনি নিতে পারেন না। যৌবনেই পারেননি আর এখনতো রোগে ঝরঝরে শরীর। বেতস পাতার মতো কাঁপে। প্রায়ই হেলে পড়ে যায়। ছেলে একটা লাঠি ধরিয়ে দিয়েছে হাতে। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। ওই লাঠি সমেতই হেলে। বরং লাঠিটাকে তার মাঝে মাঝে বিড়ম্বনা মনে হয়। একটা বোঝা বেড়েছে তার। পাখিও তার ভাল লাগে। ঘুঘু ময়না বাজিগর পছন্দ। কিন্তু সমস্যা ওই লালনপালন। কাজেই কোনোটাই হয়নি। তার শখ বলতে গাছ পরিচর্যা। ড্রাইভার গাছে পানি দেয়। যেদিন সে আসে না কষ্টে সৃষ্টে পানি দেয় নাসিমা। গাছের সবুজ তার অনেক ক্লান্তি দূর করে দেয়। সেই গাছ নিয়েই যত বিপত্তি। বিপত্তি করছে গুচ্ছের বিড়াল। কোথা থেকে যে পিলপিল করে আসে আর গাছ তছনছ করে দিয়ে চলে যায়।
নাসিমা অনেকবার অফিসে কমপ্লেন করেছে বিড়ালের ব্যাপারে। কোন লাভ হয়নি। কমপ্লেন করার সময়ই অবশ্য নাসিমা জানতো লাভ হবে না। তার সমস্যায় কার কী আসে যায়। এ কমপ্লক্সের নেতা গোতারা থাকেন অন্য বিল্ডি-এ। তাদের ব্যালকনিতে মোটা গ্রিলের দরজা। ওই দরজা গলিয়ে বিড়াল ঢুকতে পারে না। তাছাড়া কমপ্লেক্সের বুয়া, কেয়ারটেকাররা তাদের খেদমতে এক পায়ে খাড়া। সারাদিন ওসব বাড়িতে তাদের আনাগোনা। বিড়াল ঢুকবে কী করে। যত সমস্যা নামিসা আর তার মতো অল্প পয়সার লোকদের।
বিড়াল নিয়ে অবশ্য পুত্রবধু জেনিফারও বিরক্ত। কোন কিছুতে মিল না থাকলেও এই একটা বিষয়ে শাশুড়ি বউমার দারুণ মিল। জেনিয়ার অবশ্য অনেক কিছু নিয়েই বিরক্ত। নাসিমার মনে হয়, সে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত তার উপরে। কেন স্বামীর সাথে জলজ্যান্ত একটা শাশুড়ি রয়েছে এটা নিয়েই তার গাত্রদাহ। যদিও বাড়িটা শাশুড়ির। তার খাওয়া ওষুধ পথ্য বাবদ কানাকড়িও খরচ করতে হয় না ছেলেকে। বরং নাসিমাই উদারহস্তে খরচ করে যায়। তারপরও তার বিরক্তি, অশান্তি। ভাবখানা এমন শাশুড়ি না থাকলে পুরোটাই তারা পেত। ওষুধের পয়সা লাগত না, পথ্যির পয়সা লাগত না, খাওয়া খরচ লাগত না। রাশেক একমাত্র সন্তান শাশুড়ির। কাজেই ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেয় হোক সবই ছেলের হাতে আসত। না জেনিফার নাসিমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে না। তবে কথা না বলে খারাপ ব্যবহারের চ‚ড়ান্ত করে। কথা না বলা যে কতবড় শাস্তি নাসিমা বুঝতে পারে। তার একটা মাত্র পুত্রবধূ। কত সাধ ছিল তাকে নিয়ে। একসাথে ঘুরবে ফিরবে গল্প করবে খাবে দাবে। কোনোটাই হলো না। এ নিয়েও নাসিমার মনে অনেক কষ্ট। একদিকে বিড়াল সমস্যা অন্যদিকে বউমা সমস্যা নিয়ে সে জেরবার।
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ বেশ শোরগোল উঠল কমপ্লেক্সে। বাজনার শব্দ ভেসে এলো। নাসিমা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখল গেট থেকে শুরু করে হর্তা কর্তাদের বিল্ডিং পর্যন্ত আলোর রোশনাই। সাতদিন ধরে জ¦লল সে আলো। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রæপে লেখালিখি হলো, কমপ্লেক্সের বিদ্যুৎ পুড়িয়ে সভাপতির ছেলের বিয়ে। সবাই বুঝল। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে। বিয়ের দিন হঠাৎ করে দারুণ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো। ‘ধর ধর, গেল কোথায়, মার মার’ আওয়াজ উঠল। অনেকেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। দেখা গেল সভাপতি ঝাড়– হাতে দৌড়াচ্ছেন। তার পরণে মহামূল্যবান পাঞ্জাবি। তার পেছনে বেশ কয়েকজন চামচা। তিনি ক্ষমতাসীন দল করেন। ষন্ডাপান্ডা দু’চারজন সবসময়ই তার সাথে থাকে। সামনে দৌড়াচ্ছেন সভাপতি তার পেছনে ষÐারা। আর সবার সামনে একটা কালো বিড়াল। অল্প পরে অবশ্য একজন বুঝিয়ে সভাপতিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল বরের কোলের উপর উঠে বসেছিল একটা বিড়াল। প্র¯্রাব করেছিল কিনা সঠিক জানা যায়নি। এক একজন এক একরকম কথা বলতে লাগল। অনেক লোকের সমাগমে ওদিন গ্রিলের দরজাটা খোলা ছিল। কোন এক ফাঁকে ঢুকে পড়েছিল বিড়াল। বরযাত্রীরা নাকি মহাখাপ্পা হয়েছিল। উঠে চলে যাবে এমন অবস্থা। কোনক্রমে সভাপতির ছেলের নতুন পাঞ্জাবি পায়জামা পরিয়ে বসানো হয়েছে তাকে। এ নিয়েও অবশ্য মতভেদ আছে।
সেদিন কমপ্লেক্সের সবাই মন খুলে হেসেছিল। সভাপতি নানা কাজকর্মে এতদিন যাদের জ¦ালিয়েছে তারা সবাই সেদিন খুব আনন্দ পেয়েছিল। বলেছিল, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’। ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’। এমন নানান কথা। সেদিন অনেকরাত পর্যন্ত বেশ কয়েকটা বাড়িতে দীর্ঘ ফোনালাপ হয়েছিল। নাসিমার কাছেও ফোন এসেছিল। হোয়াটসআপের পেজ ভরে উঠেছিল রসালো আলোচনায়।
তারপর কমপ্লেক্স থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল বিড়াল। তার মানে কমিটি চাইলেই পারে। বারান্দা করিডর সিঁড়ি ছাদ গ্যারেজ কোথাও কোন বিড়ালের চিহ্ন নেই। এতগুলো বিড়াল রাতারাতি কোথায় গেল এ প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খেলেও কেউ মুখ ফুটে রা করেনি। বরং সবাই স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলেছিল। এখন আর টবে মল ত্যাগ করে না ওরা, সোফার নিচে বাচ্চা ফুটায় না, হুট করে ঘরে ঢুকে পড়ে না। যাক স্বস্তি, বিরাট স্বস্তি!
স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলে জেনিফারও । অফিস থেকে আসার পথে প্রায় প্রতিদিনই দরজার সামনে কুন্ডলি পাকিয়ে বসে থাকতে দেখত বিড়ালগুলোকে। বাচ্চা হবার পর ওরা খানিকটা মারমুখিও হয়ে গিয়েছিল। ওদের পায়ে মাড়াতে বা ধাওয়া দিতে ভয় লাগত জেনিফারের। শাশুড়ির গাছপালা নিয়ে তার কোন ইন্টারেস্ট নেই। তার সমস্যা শাশুড়িকে নিয়ে। তার গাছপালা থাকলেই তার কী আর গেলেই তা তার কী। গাছ কখনই তার ভাল লাগে না। অনেক ঝক্কি ওসবে। শাশুড়ি করছে, করুক। তার বন্ধুরা অবশ্য বাড়িতে ঢোকার সময় ব্যালকনির গাছগুলো দেখে বলে, ‘কী সুন্দর তপোবন বানিয়ে ফেলেছিস রে’! তখন অবশ্য নিঃশব্দে প্রশংসাটুকু নেয় জেনিফার। একবারও বলে না এই তপোবনের পেছনে তার কোন কৃতিত্ব নেই।
বিড়াল বিদায় হওয়াতে গাছগুলোর চেহারা আলো ফেলে। পাতাগুলো লকলকিয়ে ওঠে। ডগাগুলো পুরুষ্টু হয়। নাসিমা মুগ্ধ চোখে দেখে। এই সময় এক ছুটির দিন রাশেক এসে নাসিমার পাশে দাঁড়ায় । বলে,
: গাছগুলো দারুণ সুন্দর হয়েছে!
নাসিমা অবাক হয়। ছেলে কখনও গাছের দিকে ফিরেও তাকায় না। বিয়ের আগে কখনও অপাঙ্গে চোখ পড়লেও বিয়ের পর সে চোখ কখনই গাছমুখি হয় না। সেই ছেলে বলছে গাছ সুন্দর!
নাসিমা বিস্মিত। কিছু বলে না।
: মা একটা কথা ছিল।
: বল
: জেনিফার অনেকদিন ধরে বলছে ওর মায়ের কাছে গিয়ে থাকেব। এখান থেকে অফিস দূর হয়ে যায়। অসুবিধা নেই আমি প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে তোমাকে দেখে যাব, যা যা লাগে দিয়ে যাব। তুমি শুধু মাস মাস আমাদের খরচটা দিও
নাসিমা বুঝতে পারে, জেনিফারের শিখিয়ে দেয়া কথা বলছে ছেলে। সে বলে না জেনিফারের অফিস থেকে এ বাসার দূরত্ব তার মার বাসা থেকে কম। বলে লাভ কী। ও শুধু মাথা নাড়ে।
পরদিন ব্যাগ বোচকা নিয়ে বেরিয়ে যায় জেনিফার। ছেলের চোখ ছলছল করে। তাকে যেন কেমন অসহায় লাগে নাসিমার। ছেলের জন্য কষ্ট হয়!
নাসিমা দরজা বন্ধ করে শূন্যে তলিয়ে যায়। প্রথম কয়েকদিন নিয়ম করে সন্ধ্যায় ছেলে আসে, তারপর ছেদ পড়তে থাকে। নাসিমা ছেলের পদশব্দ খোঁজে না। ও জানে এ শব্দ ক্রমশ দূরবর্তী হবে, তারপর একসময় হারিয়ে যাবে। ও উঁকি দিয়ে সোফার নিচে দেখে, সিঁড়ির কোণ দেখে, টবের ভেতরে ভেতরে খোঁজে। বিড়ালগুলো গেল কোথায়, বিড়াল। ও প্রাণস্পন্দন চায়, একটু স্পন্দন। একটু শব্দ, একটু খচখচ।

 

আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top