সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

শাখামৃগ মাটিতেও থাকে : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৯ আগস্ট ২০২৩ ০১:৪১

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৭

ছবিঃ আফরোজা পারভীন

 

প্রচার প্রচাারণায় ঢাকা ১৭ আসনটি এলিট এলাকা। এই এলাকায় সম্প্রতি হয়ে গেল উপনির্বাচন। এখানে নাকি এলিটদের বসবাস। এলিট মানে অভিজাত। অভিজাত মানেকী বনেদি? মানে যাদের পুরোনো আভিজাত্য আছে, অনেক পূর্ব থেকে শিক্ষিত, সুশীল, রুচিশীল এরা? তা যদি হয় ১৭ আসনে কি সবাই তেমন? মনে হয় না। অনেক ধনী লোক থাকে এ এলাকায়? ধনী মাত্রই কী এলিট? এ এলাকার অনেক বাড়িতে বাবা মা একা একা কেযারটেকারের হাওলায় পড়ে থাকেন। সন্তানরা বিদেশে। এরা এলিট? সরি, কেউ পারসোনালি নেবেন না। সবাই এমন না। আর এ চিত্র অন্য এলাকাতেও আছে। কিন্তু সেটা বলছি না এ কারণে যে, তাদের গায়ে এলিটের তকমা নেই। তাছাড়া এই আসনে তো কড়াইল বস্তিও আছে। তারা কঠোর শ্রমজীবী। দিন আনে, দিন খায়। এলিটত্ব তারা বোঝে না।
অভিনেতা ফারুকের ইন্তেকালে শূন্য হয়েছিল আসনটি। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মাত্র পাঁচ মাসের জন্য অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। অল্প সময় হলেও প্রার্থীরা কোমর বেধে লেগেছিলেন। প্রচার প্রচারণা, জনসংযোগ, পক্ষে বিপক্ষে বক্তব্য চলছিল দেদার। নির্বাচনের মাঠ চষে বেড়াচ্ছিলেন প্রার্থীরা। লড়াই হয়েছে মূলত মোহাম্মদ আরাফাত ও হিরো আলমের মধ্যে। হিরো আলম এবার আলোচনা আগের চেয়েও বেশি। কারণ তিনি দাঁড়িয়েছেন ঢাকার কেন্দ্রস্থল এলিটদের বাসস্থান গুলশান, বনানী, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। তার মতো একজন অশিক্ষিত, কুশ্রি, নি¤œশ্রেণির মানুষ কিভাবে কোন সাহসে এই আসনে দাঁড়ালেন এটাই ছিল প্রধান প্রশ্ন। প্রশ্নটি হিরো আলমের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বার বার। বিভিন্ন টকশো, সাক্ষাৎকারে অত্যন্ত অমার্জিত ও রুঢভাবে এই প্রশ্ন তাকে করেছেন বেশিরভাগ প্রশ্নকারী। প্রশ্নের ধরণ ছিল এমন, ‘আপনার মতো একজন মানুষ কি করে এই আসনে দাঁড়ালেন’, ‘আপনি কী মনে করেন এ আসনে নির্বাচন করার মতো যোগ্য আপনি’, ‘আপনি কী মনে করেন আরাফাত সাহেবের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা আপনার আছে’, ‘গুলশানের মতো এলিট এলাকায় নির্বাচন করার যোগ্য নিজেকে মনে করেন আপনি’ সংসদে গেলে এই যোগ্যতা নিয়ে আইন প্রণয়ন করবেন কীভাবে’। একজন মানুষকে যতটা ছোট করা যায় ততটা ছোট করেই তাকে প্রশ্ন করেছে প্রশ্নকারীরা। ‘আপনার মতো একজন মানুষ’ এই কথাটি অপমানজক যে কোন মানুষের জন্যই। আপনার মতো বলতে কি বোঝাতে চাইছেন তারা! অন্য কোন প্রার্থীকে তো কেউ এভাবে প্রশ্ন করে না! হিরো আলমকে হারু আলম থেকে শুরু করে শাখামৃগ পর্যন্ত বলেছেন কেউ কেউ। হিরো অবশ্য খুবই ঠান্ডা মাথায় সবার সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। কখনও কখনও তার জবাব প্রশ্নকারীদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। কখনও প্রশ্নকারীকে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন তিনি। হিরো এটাও প্রশ্নকারীদের জানিয়ে দিয়েছেন, গুলশান বনানী এলাকায় শুধু এলিটরাই থাকেন না, অনেক বস্তিবাসীও আছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষিত লোকও আছে। গুলশানের এলিটদের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রশ্নকারীরা বার বার ওইসব এলাকার সাধারণ মানুষ আর বস্তিবাসীদের অবজ্ঞা করেছেন। যেন এলিটরাই মানুষ, বস্তিবাসী আর সাধারণ মানুষ কীট পতঙ্গ। ওদের ভোট দেবার অধিকার নেই।
একসময় ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ছিল পুরোনো ঢাকা। তারাই ছিল বনেদি। আমার ছাত্রজীবনে ধানমন্ডিতে কেউ বাস করে শুনলে সমীহ ভাব ফুটে উঠত চোখে । এখন ধানমন্ডির জায়গা নিয়েছে গুলশান বনানী বারিধারা। অদূর ভবিষ্যতে এ এলাকাগুলিকে পেছনে ফেলে এলিট হবে অন্য কোন এলাকা। তাই এলাকা নিয়ে বড়াই করার কিছু নেই।
হিরো টাকা ক্ষমতা যোগ্যতা কোনটাতেই মোহাম্মদ আরাফাতের সমকক্ষ নন। কিন্তু তার আছে মনোবল, আছে গরিবের জন্য ভালবাসা। তিনি অদম্য সাহসী এবং দৃঢ়চিত্ত। নিজে দরিদ্র ছিলেন বলে দরিদ্রের পালস বোঝেন। জিতলে হয়ত দরিদ্রদের জন্য কিছু করতে পারতেন। গুলশান এলাকাতে গরিবের সংখ্যা অনেক।
হিরো আলম নির্বাচনে হেরেছেন। তিনি এই হার মেনে নেননি। বলেছেন নিজ চোখেই দেখেছেন ব্যালটে সিল মারা হচ্ছে। এর আগে কাহালু নন্দিগ্রাম নির্বাচনে মাত্র ৮১৪ ভোটে হেরেছেন হিরো। তিনি বলেছেন, তাকে হারানো হয়েছে। ভোটে জিতেছেন, ফলাফল ঘোষণায় হারানো হয়েছে তাকে। কেন বার বার নির্বাচন করছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে চান। এটা তার প্রতিবাদ। তাকে আটকে দেয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছে। বার বার তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। তিনি আপিল করে ফিরিয়ে এনেছেন।
এই এলিটীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। কম হবার কথা। এলিটদের সকাল সকাল ঘুম ভাঙে না। ছয় ঘন্টায় এক কেন্দ্রে বারোটা ভোট পড়েছে বলে শুনেছি। ভোটের শতকরা ভাগ ১১ এর কিছু বেশি। পরীক্ষায় পাশ করতেও তো ৩৩ পেতে হয় জানি। এটা কী করে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়! তথাকথিত এলিট শ্রেণি ভোট দিতে আসাটা অপ্রয়োজন মনে করেছেন। অন্য নির্বাচনগুলিতে এ আসনে ৬০ ভাগ ভোট পড়েছে বলে শুনেছি। ১১ ভাগ ভোট দিয়েছে নন এলিটরা যারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন। তারাই পালন করেছেন নাগরিক দায়িত্ব।
নির্বাচনে হার জিৎ থাকে। হারলে কেউ সহজে মেনে নেয় না। অনেক রকম যুক্তি খাড়া করে। দিনের ভোট রাতে, ব্যালটে সিল, এজেন্ট বের করে দেয়া, প্রিজাইডিং পোলিং অফিসারদের অসহযোগিতা এমন নানান অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এটা নতুন কিছু না। আমার কথা এ বিষয়ে না। যিনি জিতেছেন তিনি রাজনীতিতে পুরোনো না হলেও ভাল প্রার্থী। তাকে অভিনন্দন জানাই!
আমার কথা হচ্ছে কে দরিদ্র, কার বাবা গামছা বিক্রি করত, কে ফেরি করত, কে টোকাই এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করাই অশিক্ষা। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার নূন্যতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা নেই। যেহেতু নেই সেহেতু ঋণখেলাপী না হলে বা ফৌজদারি অপরাধে দ-িত না সবাই যোগ্য। কার ডিগ্রি আছে কার নেই, কে দরিদ্র পরিবারের সন্তান কে ধনী, কে ক্ষতাশালী কে ক্ষমতাহীন, কার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার আছে, কার নেই, কার গায়ে শক্তি আছে, চেহারা ধবধবে, কে কালো , দুর্বল এসব বিবেচ্য হতে পারে না। আমাদের সংসদে এমন অনেক এমপি সাহেব আছেন যারা ভাল করে বাংলা পড়তে পারেন না, যাদের একটা কথাও বোঝা যায় না, যাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ভাল না, যাদের শিক্ষা দীক্ষা নেই তাদের কথাও ভাবা হোক। তারা কীভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন! অনেকের বিবেচনায় হিরোর গান অভিনয় কিছুই ভাল না, তাই সে অযোগ্য। সে নিজের নাম বদলে হিরো বানিয়েছে তাই অযোগ্য। এদেশে আর কেউ কি নাম বদলায়নি। ভুরি ভুরি উদাহরণ দিতে পারি। আর এগুলো যদি তার অযোগ্যতা হয় সে একজন মানুষ, এদেশের নাগরিক হিসেবেই ভোটে দাঁড়াতে পারে। অনেকেই তো সংসদে গান বাজনা করছেন। গায়ক আছেন অভিনেত্রী আছেন, অভিনেতা, কবি ছিলেন। তাদের রাজনৈতিক কোন পূর্ব রেকর্ড নেই। শিল্পী সাহিত্যিক যোগ্যতাতেই তারা সংসদে গেছেন। তাদের ক্ষেত্রে তো কেউ প্রশ্ন তোলে না আপনারা কীভাবে আইন প্রণয়ন করবেন! চেয়ার মানুষকে শেখায়, উপযুক্ত করে। শেখার ইচ্ছে থাকলে শিখতে পারে। পৃথিবীতে বহু মানুষ শূন্য থেকে শীর্ষে গেছেন। তাদের তালিকা দীর্ঘ।
সমস্যা হচ্ছে হিরো আলম বা পরীমণি সম্পর্কে কথা বললেই লোকে ভাবে আমার ক্লাস নেই। কৌলীন্য নেই। একবার পরীমণি সম্পর্কে লিখেছিলাম বলে এক ভদ্রলোক আমাকে যা নয় তাই বলেছিলেন। পরে আবিষ্কার করেছিলাম, তিনি ফেসবুকে দিনের পর দিন একটা কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলেন আমাকে ট্যাগ করে। যেন আমি তার পার্টনার, ব্যবসার অংশিদার! আমি অবাক! আমি পারতপক্ষে কখনই কাউকে ট্যাগ করি না। অনুমতি না নিয়ে করার তো প্রশ্নই ওঠে না। এ লোককে আমি চিনি না, জানি না। আমি তাকে লিখেছিলাম, ‘প্লিজ আমাকে ট্যাগ করবেন না’। তাতে তিনি রেগে যান। রাগটা মনে পুষে রেখেছিলেন। পরীমণিকে নিয়ে লিখলে সে রাগ উগরে দেন। সবখানেই আসলে হিসেব নিকেশ আছে। আঁতে ঘা লাগলে মানুষ শত্রু হয়ে যায়। নিজের দোষ অক্লেশে অন্যের উপর চাপিয়ে সাধু সাজে। চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যায়। মুখোশ খসে পড়ে। হিরোকে নিয়ে লিখেছিলাম বলে তো আমার সমালোচনার অন্ত নেই। একজন অনেক কাছের মানুষ আমার শত্রু হয়ে গিয়েছিল প্রায়। বিষয়টা সে এতটাই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিল এবং মনে রেখেছিল যে, পরবর্তীকালে এক পোস্টে আমার প্রাপ্য সম্মানটুকুও দেয়নি। দু একজন আমার আদর্শের দিকেও ইঙ্গিত করেছিল। কিন্তু লাভ নেই। ইতিহাস মুছে যায় না। আমার আব্বা বা ভাই কে, এদেশ নির্মাণে তাদের অবদান ইতিহাস থেকে মোছা যাবে না। আমি সারাটা জীবন মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেছি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ডজন ডজন বই লিখেছে। শৈশবেই বঙ্গবন্ধুর ¯েœহস্পর্শ পিয়েছি, সেটা আমার অনন্য প্রাপ্তি!
আমি বরাবরই প্রান্তিক মানুষের পাশে ছিলাম, সাথে ছিলাম, থাকব। তাতে যদি কেউ বলে আমার ক্লাস নেই তো নেই। ক্লাস কি ধুয়ে খাব। সত্যি বলব না, অন্ধ হবো! ভুলটা ভুলই । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা তার সরকার কী বলেছে, হিরো আলমকে পিটাও! এমন নির্দেশনা কী ছিল যে পুলিশরা নির্বিকার দর্শকের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে! নির্বাচন যেমনই হোক একজন প্রার্থীকে পিটানো হবে কেন, তার গায়ে হাত তোলা হবে কেন? সে হিরো আলমই হোক অথবা চর মোনাই-এর পীর সাহেব! এটা কেমন কথা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখল পুলিশ । একজন বলল বাইরে কর্ডনের দায়িত্ব তার না। তাহলে বাইরের পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার লোক কোথায় গেল! পুলিশদের কারো চাকরি গেছে বলে তো শুনিনি। হিরোকে নাকি আওয়ামী লীগের লোকজন মারেনি। হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কিন্তু ভোটকেন্দ্রের সামনেই এ ঘটনা ঘটেছে এটা সত্য। কেন ঘটবে! আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত পুলিশরা কী করল! এ দায় কার!
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সময়টা দেশের জন্য, রাজনীতিবিদদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলা দরকার সাবধানে, ভেবেচিন্তে। তা নাহলে যে কোন স্যাবোটাজ ঘটে যেতে পারে। বিভিন্ন মহল স্যাবোটাজ ঘটানোর পরিকল্পনা করতে পারে। বিভিন্ন দেশ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে আমাদের দেশের উপর। ষড়যন্ত্র চলছে। সে কথাটি মাথায় রেখে চলা উচিত ছিল। মোহাম্মদ আরাফাত অবশ্য এই ঘটনার বিচার চেয়েছেন। এটা শুভ লক্ষণ!
নির্বাচনে মোহাম্মদ আরাফাত জিতেছেন ঠিকই কিন্তু জনগণের আলোচনায় আছেন হিরো। তাকে নিয়ে দেশে বিদেশে আলোচনা, বিবৃতি, প্রতিক্রিয়া । একজন প্রান্তিক মানুষ লড়াই করে উঠে আসতে চাইছে। তাকে বাধা দেয়া অন্যায়। যারা তাকে ‘শাখামৃগ’ বলছেন তাদের বলছি, একসময় আপনারাও ‘শাখামৃগ’ ছিলেন। শাখামৃগ শুধু শাখায় নয়, মাটিতেও থাকে। কি বললাম বুঝলেন তো?

 

আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, গবেষক, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top