সিডনী মঙ্গলবার, ২১শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

একটি হযবরল গল্প: দীলতাজ রহমান


প্রকাশিত:
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২২:০২

আপডেট:
১৮ মে ২০২০ ২২:৫১

 

ময়ূরের পুচ্ছ দেখে কাক ছুঁয়েছি/ কাক কি আর পোষার পাখি!/ বাঁধন খোলা সে কাকের প্রাণে যে বেদনা রাখা আছে/ সে তো এখন ওই কাকের মর্মহীন সমূহ বালি;/ আমার গেল মুক্তাদানায় অমূল্য বর্ণ কিছু/ অযথাই তার নকল পালক সাজিয়ে লেখা…।/ হারানো মুক্তা নাকি ওই কাকের জন্যই অহোরাত্র বিলাপ এখন;/ কাক ও মুক্তা একা কেউ নয়, দুয়ে মিলে কথা কয় ভিন্ন সংযোজন।’ কবিতাটির নাম ‘কাক’

অনুজ কবি বিদ্যুৎ বিহারিকে মেসেজ দিলাম, ‘কাক’ নামে একটি কবিতা লিখেছি। ওটা পড়ে একটা কমেন্ট কর। একজন আমাকে হা-পা ধরে তার প্রেমে ফেলেছিল। আর আমিও পড়ে যখন, টালমাটাল করছি। মানে ভাবছি মিষ্টি কথা চালাচালি করতে করতে শেষে না ধরা খাই। বয়সে ছোট যেহেতু, সেহেতু আমি আগে মরবো। তাই বিয়ে করতে বাধ্য হলে, নির্ঘাত দু’দিনের সে সোয়ামী আমার সম্পত্তির একটা বড় অংশ বের করে নিয়ে চলে যাবে। ছেলেমেয়ের সাথে আমি জেনেশুনে একজন প্রতিপক্ষ এনে প্রতিষ্ঠিত করে যাব, এটা অসম্ভব! বহুবছর আগে এরকম মিষ্টি কথার একজন মিউমিউ করেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, ঠিকাছে, বিয়ে করতে রাজি, কলমা হবে। কিন্তু কাবিন হবে না…।’ আমার দিকে তাকিয়ে সে বলেছিল, কারণ কি? মেয়েরা তো আরো মোটা অংকের টাকার কাবিন করতে বলে। আমি বলেছিলাম, আমার তাতে দরকার নেই। কিন্তু আমার টুকুতে যেন অন্য কেউ নখ বসাতে না পারে!

কিন্তু এই নতুন প্রেমিকের সাথে কথা সে যর‌্যন্ত গড়ায়নি। শুধু একটু  টাল অবস্থার ভেতর পড়ে গেছিলাম। তাতেই একদিন নতুন প্রেমিক আমাকে মেসেঞ্জারে লিখলো, ‘তোমার একখানা ছবি পাঠাও।’

আমি আশ্চর‌্য হয়ে লিখলাম, বরাবর আমি এত ছবি পোস্ট করছি, তুমি আমাকে দেখোনি, যে এখন আমি তোমাকে ইনবক্সে ছবি পাঠাতে যাবো! তাহলে তুমি আমাকে ভাল করে খেয়াল না করেই আমার প্রেমে অমন গদগদ হয়েছিলে?

সে আমাকে বললো, ঠিকাছে, তুমি খালি বলো, তুমি কত সাইজ ইয়ে … পরো ‘

বিদ্যুৎকে লিখলাম, আমিও কি কম চালাক! আমি একেবারে দশ নাম্বার কমিয়ে লিখলাম! কিন্তু লিখলাম যে, সে বিশ্বাস করলো কিনা, তা বোঝার সময় না নিয়ে আমার হঠাৎ মেজাজ ঠাঁ ঠাঁ করে তেতে উঠলো। আমি তাকে আবার লিখলাম, তুমি আমাকে ছবিতে ভাল করে পরখ না করেই আমার প্রেমে পড়লে কেন? গাধা কোথাকার! পড়েছ তো পড়েছ, আমাকেও পিছলা কাদার মতো টান মেরে ফেলেছ! ভাল করে জেনে রাখো, আমি দেখতে তামাটে। মুখে রোদের আঁচড়ের কালো দাগ। আর একজন পঞ্চাশোর্ধ নারীর লাবণ্য কতটা আর পেলব থাকতে পারে? কিন্তু আমার একার তো একটা গৌরবের জায়গা আছে, আমি শিল্পমগ্ন একটি মানুষ। বিধাতা প্রদত্ত ছাড়াও আমার নিজের কিছু অর্জন আছে…। তুমি কি অবশেষে আমাকে শুধুই চামড়া ছিলা গরু-ছাগলের মাংসের দামে নামিয়ে আনলে?

দেখলাম, দু’দিনেও তার উত্তর নেই। বুঝলাম, ছ্যাঁক খেয়েছি। সেই দুঃখে একটা কবিতা লিখে পোস্ট করলাম। বুঝলি!

আভাস দিয়ে বিদ্যুৎকে লিখলাম, তুই কবিতাটায় এমন একটা কমেন্ট কর, যেন ওই, ওর কলিজায় পঁচন ধরে।

কতকক্ষণ অপেক্ষা করে মেজাজ গরম হলো। সবুজ বাতি জ্বলছে কিন্তু বিদ্যুতের না আসছে ‘কাক’এ কমেন্ট। না দিচ্ছে মেসেঞ্জারে উত্তর। আমি কিছুক্ষণ তীর্থের কাকের মতো তার দিকে তাকিয়ে থেকে পরে সার্চ দিয়ে বাশিরুল আমীনকে খুঁজে বের করলাম। তারপর অস্ফূট প্রেমের মুকুলেই বিপর্যয়ের সব ঘটনা লিখে, বিদ্যুৎ বিহারিকে কি লিখেছি তাও তাকে লিখলাম। লিখলাম, এমন একটা মেসেজ পড়ে বিদ্যুৎ কোথায় হো হো করে হাসির ইমো পাঠাবে, তা না, তার কোনো হেলদোল টের না পেয়ে আমার খুব গায়ে জ্বালা ধরছে। তাই আমি তোকে খুঁজে বের করলাম…। তোকে কমেন্ট করতে হবে না। তুই দেখ তো কবিতাটা হলো কি না। তাহলে পত্রিকায় ছাপতে দিই!

কিন্তু বাশিরুল আমীন বোধ হয় তার লেবারদের সাথে ঢালাই কাজের তদারকিতে ব্যস্ত। সে ছোট করে উত্তর দিল, ‘মজা পাইলাম!’ ওর ওইটুক মেসেজে আমার পরাণ ভরলো না।  আমি ‘ধ্যৎ’ বলে আবার বিদ্যুতের বক্স টেনে বের করলাম। দেখি, বিদ্যুৎ লিখছে, ‘মাদকের চালান ধরা পড়ছে গো আফা। সেই নিয়ে আছি। চেম্বারে ম্যালা মানুষ…।’

বিদ্যুৎ ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’এ চাকরি করে। চাকরিরও মেলা আগে থেকে তার সাথে আমার চেনাজানা। তাকে নিয়ে অনেকবার লিখছি, আবার লিখলে রিপিটেশন হবে। সেটা আমার পুরণো পাঠকের ভাল লাগবে না। তারচে’ বরং বাশিরুল আমীনের কথা কিছু লিখি!

ক্ষমতাধর আমলা থেকে সুদর্শন চেহারার ফেসবুকীয় যত মাকাল আছে, যাদের থেকে একজন লেখকের অন্তত কিছু পাওয়ার নেই, আর সেই বোধ যখন উদয় হলো, তাদেরকে ডিলিট করে করে তরুণ-তরুণীদের ভেতর যত তুখোড় আছে, যারা নতুন কিছু বলার চেষ্টা করছে, তেমনি যাদের আমি নিজে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধু বানিয়েছি, বাশিরুল আমীন বোধহয় তাদের একজন। একদিন সে পোস্ট দিয়েছিল, বাসে কোথায় যাচ্ছিল, তার কাছে ভাড়ার দশ টাকা ভাংতি ছিল না। পরে পাশের এক মহিলাকে বলেছিল, আপা, আমার ভাড়াটা আপনি দিয়ে দেন। তিনি দিয়ে দিলেন। বাশিরুল তাতে খুশি হয়েছে দেখে, আমি বুঝলাম, এইটা আমার মতো সরলসিদা! নইলে আবার এটা মানুষের পড়ার জন্য লেখেও! তাই আমি কমেন্ট বক্সে লিখলাম, যদি কোনোদিন ওই মহিলার সাথে দেখা হয়, ওই টাকাটা ফেরত দেবে। কারণ ছোট ছোট ঋণে বড় বড় প্রাপ্তিগুলি কাটা যায়। বাশিরুল লিখলো, ‘ঠিক!’ সেই থেকে যে ওর সাথে আমার একটা আত্মিক যোগাযোগ হয়ে গেল। তারপর টের পেলাম সে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা ছেলেমেয়ে যদি সচেতনভাবে লেখালেখি করে, যেভাবে চলে আসছে, সেরকমটি হলে, সাহিত্যজগতে তাহলে আরো ভিন্নমাত্রা যুক্ত হবে বলে আমি মরে করি। কারণ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা অধিকাংশেই মুক্তবুদ্ধির না হয়ে গোঁয়ার হয়। আর বাশিরুলের ভেতর ব্যাতিক্রম এক তেজও আমি লক্ষ্য করেছি। ও মারাত্মক পড়ুয়া এবং মুক্ত চিন্তার তরুণ!

আর সেটা লক্ষ্য করেই তাকে আমি পটিয়ে পটিয়ে কুরিয়ারে নিজের বই গছিয়েছি। যখন তার কাছে টাকা হলো, সে সে টাকা বিকাশে পাঠিয়ে নিজের সম্পর্কে ধারণাটা সুস্পষ্ট করে নিলো। তারও আগে ফেসবুকে সে বইটির একটি আলোচনাও লিখেছে। প্রতিনিয়ত ছেঁড়া খোঁড়া প্রশ্ন করতে করতে আরো জানলাম, আপাতত সে মামার বাড়ি থাকে। মামার আটতলা বাড়ির কাজ হচ্ছে। সে সেই বিত্তবান মামার ভাগ্নে হওয়ার সুবাদে আপাতত আছে মামার বাড়ি নির্মাণ কাজের তদারকি নিয়ে। ফজরের নামাজ পড়েই লেবারদের সাথে থাকতে হয়। মামার চার চারটে কুকুরের দেখাশোনাও তাকে করতে হয়। কুকুরগুলোর সেবা যত্ন করতে করতে এখন সে কুকুরপ্রেমিকও বটে!

বাশিরুল ওর কাজের ধরণ বলে যায় আর আমি ইট-বালি-সিমেন্টঘনিষ্ঠ জীবনের গল্প বুনতে থাকি। যে জীবন আমার অনেকখানি চেনা। কারণ বাশিরুল মামার যে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। আমি বিয়ের পর থেকে স্বামীর সেই দায়িত্ব পুরোটাই পালন করেছি। আর পালন করতে করতে বুঝেছি, বাড়ি করার কাজ হলো জুয়া খেলার চেয়ে মারাত্মক নেশার। বাশিরুলের সাথে নানান বিষয়ে মত বিনিময় করতে করতে আমি ভুলে যাই, আমার বয়স ওর চেয়ে আনেক বেশি। মনে হয়, জন্মেছি আগে তবে ও আমার এমন সতীর্থ যার সাথে এসব সুচাল চলে। ওর প্রজ্ঞা তা ডিজার্ভ করে।

বাশিরুরের ছোট কমেন্টে বিমুখ হয়ে পরে দেখি, বিদ্যুৎ কবিতাটিতে যা কমেন্ট করেছে, তা ওই কাকের পক্ষেই যায়। কি আর করি! একটা আস্ত কবিতা লেখার চনমনে ভাবটা মনের ভেতর থিতিয়ে গেল।

পরদিন কুইন্সল্যাণ্ডে মেয়ের কাছে বেড়াতে আসা সাঈদা রোকেয়া আমাকে নিয়ে যাবে এখানে কোনো এক হলে অনুষ্ঠিত পিঠা উৎসবে। সাঈদা রোকেয়ার সাথে পরিচয় এখানে এসে। ও একসময় টেলিভিশনে খবর পড়তো। তারপর একমাত্র মেয়ে ঐশির বিয়ে দিয়ে নাতি হওয়াতে জীবন করে ফেলেছে নাতি কেন্দ্রিক! তবু ভিসার মেয়াদ ফুরালে আমার পরপর তাকেও দেশে চলে যেতে হবে!

এদিকে বাশিরুল আমীন আর বিদ্যুৎ বিহারির সাথে এইসব মেসেজ চালাচালির  ভেতর একটি গল্পও এডিট করছিলাম। গল্পটা লিখছিলাম অনেক আগে। অনেকদিন পর চরিত্রগুলো আমাকে নাগাল পেয়ে কাঁটার মতো আঁচল টেনে ধরছিল। আরো কিছুক্ষণ তাদের সাথে থেকে যেতে। অন্যদিন টানলে থাকি না। কিন্তু সেদিন থাকলাম। এদিকে নিজেকে গালমন্দ করতেও ছাড়ছি না। যে অন্যদিন লেখার তাড়া নাও না। কাল সকালে একজন তোমাকে সাথে করে এক জায়গায় নিয়ে যেতে আসবে। তার আগে তোমার ঘরে নাতি-নাতনি, মেয়ে-জামাইয়ের জন্য রান্না করে যেতে হবে। যে শাড়িটা পরে পিঠা উৎসবে যাবে, তাও তো ইস্ত্রী করে রাখোনি। ম্যাচিং ব্লাউজও তো খুঁজে রাখোনি! তুমি তো আবার যা পাও এক শাড়ির সাথে আরেক ব্লাউজ গায়ে সেঁধিয়ে দৌড় দাও! অথচ এখনো কোথাও প্রেমের একটু গন্ধ পেলে রক্তপিপাসু জোঁক হয়ে ওঠো!

রাত তিনটা বাজলো বিছানায় যেতে। তারপর আইপ্যাডে চোখ বুলাতে বুলাতে এক অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক, তিনি এই অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যাবেরাতে থাকেন। মাঝে মাঝে আমি লেখা পাঠালে খুশি হয়ে ছাপেন। শেষ গল্পটা পাঠিয়ে জানানো হয়নি। তাই তাকে দেখে নক করতে তিনি বললেন, তিনি একটি কবিতা লিখেছেন। তা আমাকে পাঠাবেন। কিন্তু তিনি আমাকে লিখলেন, আগে প্রমিজ করেন, কার জন্য লিখেছি, তা জানতে চাইবেন না। উত্তরে আমি লিখলাম, আপনি এমন করে অনুরোধ  করছেন, যে আমি তা জানতে না চাই কী করে!

সম্পাদক সাহেব ‘হা হা হা’ হাসি পাঠালেন। কিন্তু অনেকক্ষণ সময় পার হলেও ওনার কবিতার ক’য়েরও দেখা নেই। আমার ঘুম আসছিল না। কিন্তু কালকের প্রোগ্রামের কথা মনে রেখে নিজেকে ধরেবেঁধে ঘুমানোর চেষ্টা তো করতে হবে! আর সেই কাজটিই দ্রুত করতে আমি সম্পাদক সাহেবকে দ্বিধা-জড়তা-লজ্জা গুড়িয়ে ভাঙতে বাশিরুল আর বিদ্যুৎকে পাঠানো মেসেজ দু’খানা তাদের ইনবক্স থেকে ফরোয়ার্ড করে পরপর দিলাম। বোঝালাম, আপনি কি নিয়ে এত লজ্জা পাচ্ছেন? দেখেন, আমি আমার অনুজ ও সন্তানতুল্যদের সাথে কি সব বিষয় তুলোর মতো ধুনে শেয়ার করি! আরে এ বয়সে একটু আধটু রোমাঞ্চ করবেন, তো বন্ধু-বান্ধবের সাথে এত রাখঢাকের কি হলো!

এরপর দেখলাম সম্পাদক সাহেব ‘লিখলেন, দু’জনকে পাঠানো আপনার মেসেজ দু’খানা পড়ে  দারুণ মজা পেলাম!’ তারও পর শাঁ করে তার সেই কবিতা এলো। ছয়/সাত লাইনের অণুকবিতাই বলা চলে। উনি যে হারে লজ্জা পাচ্ছিলেন, শেষে ওনার কবিতা পড়ে আমি নিজেই লজ্জা পেলাম। কারণ বার্লির ভেতরও তো কিছু পুষ্টিগুণ থাকে। ও কবিতাতে তো কিচ্ছুটি নেই! বুঝলাম, এই লোক প্রেম করলে আর কদ্দূর যাবেন!

আমি মনে হয় তাকে তার শেষ বয়সে প্রেম শেখাতেই লিখলাম, এই কবিতা পাঠাতে আপনার এতক্ষণ লাগলো? তাহলে দেখেন, আমি গল্পে কি লিখেছি? বলে একজনকে ইনবক্সে লেখা অণুগল্প তাকে ফরোয়ার্ড করলাম। যেন একেবারে ঘাড় ধরে শেখানো, দেখেন, রোমাঞ্চ কাকে বলে!

গল্পটি এমন, বয়সে বড় এক নারীর প্রেমে পড়েছে তার থেকে বয়সে ছোট এক পুরুষ। কিন্তু নারীটি তার প্রেমে না পড়লেও আলোড়িত হতে শুরু করেছে তার কথায়। তাই বুঝি নিজের অজান্তেই তাকে পরখ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।  এর ভেতর নারীটি একদিন ফেসবুকে গনগনে একটি প্রেমের কবিতা পোস্ট দেয়। আর ওই প্রেমিক প্রবর তাতে কমেন্ট করে ফেলে, ‘এখনো এই বয়সে এতো ভালবাসার জোর আছে?’ নারীটি ক্ষুব্ধ হলেও রয়েসয়ে উত্তর লিখলো, ভালবাসা একটি বোধের নাম। এটা তো ফুরোবার নয়! যার তা ফুরোয় এই পৃথিবীতে সে অপাক্তেয়! বাঁচবার ক্ষমতা তার নষ্ট হয়ে গেছে।’

কিন্তু নারীটি টের পেল, তার রাগ মেটেনি। কিন্তু কমেন্ট বক্সে তো এর থেকে বেশি লেখা যায় না! সে নায়ককে আবার ইনবক্সে আক্রমণ করলো। কিন্তু সবুজ বাতি গনগন করে জ্বললেও ওপাশ থেকে নায়কের কোনো উত্তর নেই! আলো নিবিয়ে নায়িকা শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম আসছে না। সে ঠান্ডা পনিতে হাত-মুখ ধুয়ে এল। কিন্ত মেজাজ তাতেও নামছে না। শেষে সে আচমকা হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠে ড্রাইভারকে ফোন করলো। বললো, তোমার সাইকেলে করে পনের মিনিটের ভেতর চলে এস।

রাত দুটা। রাস্তা তখন পুরোই ফাঁকা। নায়িকা ইনবক্স ঘেঁটে নায়কের ঠিকানা বের করলো। নায়ক সেধেই দিয়েছিল, কোথায় থাকে তা জানাতে। কল্যাণপুর কোনো বাড়ির দোতলার ওপরে একটা রুম। মানে চিলেকোঠা। সহজেই পেয়ে গেল। তারপর হনহন করে নায়িকা সিঁড়ি ভেঙে উঠে কলিংবেল নয়, দরজায় রঙতুলি নিয়ে তার খেলার আঙুলগুলো দিয়ে যাকে বলে আঙুলাঘাত করলো।

নায়ক খালি গা, ঘুমে জড়ানো চোখে দরজা খুলতেই সে নায়িকাকে দেখে চিনতে পারলো। যদিও আগে কোনোদিন বাস্তবে দেখেনি। নায়িকাকে চিনতে পেরে তার কবিতায় তার নিজের কমেন্টের কথা মনে পড়ে গেল। সে ভয়ে ঘরের ভেতরের দিকে দু’পা পিছিয়ে গেল নিজের অজান্তে। আর নায়িকা জেনেশুনে তার দিকে এগিয়ে পা পিছানো সে নায়কের দুই গালে ঠাসঠাস করে কয়েকটা থাপ্পড় কসিয়ে বললো, ‘একজন স্ত্রী একজন স্বামীর বিশ বছরের ছোট হলে তা কারো চোখে লাগে না। কিন্তু একজন স্বামী একজন স্ত্রী’র থেকে পাঁচ বছরের ছোট হলে, বারবার তাকে তার বয়স মনে করিয়ে দিতে হবে, না? আমার পিছনে লেগেও থাকবি আবার একটুতে বয়সও মনে করিয়ে দিবি, তোর থেকে আমার বয়স বেশি…! ডু ইউ নো, আই ক্যান মেইক টেন ম্যান লাইক ইউ কাম এট দ্য সেইম টাইম?’ বলে চিত্রশিল্পী সে নায়িকা আর দাঁড়ায় না।

নায়িকাকে যেমন পাঠিয়ে ছিলাম ইতিহাসের অধ্যাপক ডিভোর্সী নায়ককে শিক্ষা দিতে, তেমনি হনহন করে ফিরিয়েও আনলাম। আর অধ্যাপক, নিরীহ সে নায়ককে রেখে দিলাম সেইখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। শেষ পর‌্যন্ত তাদের মিলও দেখাইনি!   

শেষরাতে ইনবক্সে পাঠোনো এই গল্প পড়ে তো অনলাইন পত্রিকার সম্পাদকের মাথা গরম হয়ে গেছে! তিনি বারবার মেসেজ পাঠাচেছন, গল্পে আমি যেন ওইখানে নায়ককে দিয়ে নায়িকাকে টেনে ধরাই। তাকে বিছানাই নেওয়াই! এত রাগের পরে একটা বড় আদর লাগে।

আমি লিখলাম, তাহলে তো আর গল্প হবে না। দু’জনের এক সার্থক বাসর হবে সেটা!

কিন্তু তিনি আমাকে ফোর্স করতে লাগলেন। আমি বললাম, গল্পটি তো সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘বিহান’ নামের একটি ছোট পত্রিকায় মুতিউল মুরসালিন নামে এক লিটলম্যাগ সম্পাদক ছেপে ফেলেছেন!

এরপর অনলাইনের সম্পাদক সাহেব বললেন, আমি কি আপনাকে মেসেঞ্জারে কল দিতে পারি? এতকথা লিখে বোঝাতে পারছি না!

আমার তখন দারুণ অপারগ সময়। কারণ তখন ভোর প্রায় চারটে। পাশের ঘরে জামাই-মেয়ে। আর এইদেশের বাড়িঘর সব নিচ্ছিদ্র হওয়াতে এতটুকু শব্দও সব মানুষের কানের ছিদ্রে বহুগুণ হয়ে পশে যায়। তারওপর আমার এমন কণ্ঠ, যে, প্রেমিকদের সাথেও কথা বলতে হয় বন্ধুত্বের স্বরে। দেশে থাকতে একদিন ছোট মেয়ে বলেছিল, ‘আম্মা, তুমি যাদের সাথে কথা বলো তারা সবাই কি বয়রা?’

বলেছিলাম, কেন?

মেয়ে বলেছিল, তাহলে এত জোরে কথা বলো কেন?’

সম্পাদক সাহেবকে তবু কল দিতে বললাম। কারণ আমার কোনো অপারগতা কারো কাছে প্রকাশ করতে ভাললাগে না। সম্পাদক সাহেব কল দিলে, কত বিষয় ছেড়ে বিষয়ান্তরে আমরা চলে গেলাম। কি ছিল না সেই আলাপে! কিন্তু সব কথার ভেতর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তার ওই এক কথা, গল্পটাতে আপনি মিল দেখান। উনি এও বললেন, নায়িকা দম্ভ করে নায়ককে যা বলেছে, তাতে তো তার কোনো ক্রেডিট দেখি না!

আমি বললাম, কেন? ক্রেডিট দেখবেন না কেন? দশ নারীকে ঠান্ডা করার ওই ক্রেডিট কি একা শুধু পুরুষের থাকতে হবে? নারীর থাকলে সেটা পুরুষের অপছন্দ?

সম্পাদক সাহেব বললেন, ‘শোনেন, ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে একসাথে খেলছিল। একসময় ছেলেটি খেয়ালের বশে মেয়েটিকে তার পেনিস বের করে দেখিয়ে বললো, এই দেখ, আমার এইটা আছে, তোর আছে?’ মেয়ে প্যান্ট খুলে দেখে, তারটা নেই। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। মা’কে বললো, ‘ওর ওটা আছে, আমার নেই কেন?’ মা মেয়েকে শিখিয়ে দিলো, ‘ওকে বলগে, আমার এইটা দিয়ে তোরটার মতো দশটা আসবে!’

সম্পাদক সাহেব বললেন, তো, আপনার গল্পটা আমার সেই রকমই মনে হচ্ছে। মেয়েদের আসলে অত ক্ষমতা নেই। আপনি দু’জনের মিল করে দেন…। অন্তত নায়ক নায়িকাকে টেনে ধরুক! অত রাতে তাকে একা পেয়ে একজন পুরুষ মানুষ ছেড়ে দেয় কি করে?’

আমি বুঝতে পারছি, ষাটোতিক্রান্ত সম্পাদকের নিজের মাথায়ই আগুন উঠে গেছে। কিন্তু ওনার সেই আগুন নামানো দায়, বিশ্বাস টলিয়ে আমাকেই নিতে হবে কেন? আমি মনে মনে বললাম, আপনি যতই বলেন সম্পাদক ভাই, কস্মিনকালেও সেটি হবার নয়! পুরুষের দম্ভ চূর্ণ করার সময় এসেছে।

কিন্তু মেসেঞ্জারে বললাম, আগে বলা হত মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। এখন যে সময় উল্টে গেছে, তা দেখেছেন?

সম্পাদক সাহেব বললেন, যেমন?

বললাম, আগে মেয়েরা নিজেদের খাবার-দাবারের খেয়াল রাখতো না। বছর বছর ছেলেমেয়ের জন্ম দিতে বাধ্য হতো! এখন ছেলেমেয়ের জন্ম দিতে তারা বাধ্য নয়। এখন নিজেদের যত্ন নেয়া শিখে তো গেছেই, বিউটি পার্লারে গিয়ে আবার  পুরো শরীর ঘষামাজা করায়!  খেয়াল করেন, এখন প্রতিটি ঘরে বউয়েরা যুবতীর মতো দেখতে। কিন্তু স্বামীগুলোকে দেখেন? মনে হয় তাদের চাচা চাচাভাব!

সম্পাদক সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আপনার সাথে আমি কথায় পারবো না, জানলে এত কল দিতাম না’ বলে লাইন কেটে দিলেন।     

আর আমি পরদিন পিঠা উৎসব থেকে ফিরে এসে সম্পাদকের সংলাপগুলো টাইপ করে, বাশিরুল আমীনকে মেসেজ দিলাম, ‘তোর জলজ্যান্ত নামটা আমি একটা গল্পে লিখে ফেলেছি। কিন্তু আমি তোর তেমন কিছু জানি না! মরার পর যদি বিখ্যাত হয়ে যাই, পাঠক তোকে নিয়ে গবেষণা ‘আসমানী’র মতো রব উঠবে। তাই তাদের কাজটা এগিয়ে রেখে যাই। আর কাউকে নিয়ে লিখতে হলে, বাড়িয়ে লিখতে আমি রাজি আছি। কিন্তু কাউকে খর্ব যেন না করে ফেলি। মনে কর আমি কাউকে একটা জামা কিনে দিলাম। জামাটা বড় হলে সে ট্রাঙ্কে রেখে নিজেকে সে জামার উপযুক্ত করার সাধনা করবে।  কিন্তু ছোট জামা দিলে তো সে তা তখনই ফেলে দেবে! তাই কাউকে নিয়ে তার থেকে কম লিখলে তো সে নিজেই তার থেকে পালিয়ে বাঁচবে! অন্যের তেমন লেখা সে বইবে কেন? 

আমার মেসেজের পর বাশিরুল উৎসাহী হয়ে একের পর এক তীরের মতো ছুঁড়তে লাগলো, ‘আমি মূলত একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়াই।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম (সোস্যাল ওয়ার্ক)য়ে অনার্স ও মাস্টার্স। মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাশ। উন্নয়ণকর্মী হিসাবে কাজ করেছি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও কাজ করেছি। ‘পলিমাটি’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করি!’

দেখতে দেখতে আমি চিৎকার করে উঠি প্রায়। লিখি, তোকে এতকিছু কে করতে বলেছে? তোর এইসব গুরুগম্ভীর বিষয়ের ভিড়ে আমার বুদ্বুদের মতো বিষয়টি  চাপা পড়ে যাক আর কি! যেন আমার কিছুই ঘটেনি, তুই-ই সব!

বাশিরুল হো হো হো হাসির ইমো পাঠিয়ে লিখলো, চা বাগানে কুলি, সীমান্তে গারো ও খাসিয়াদের কাজও করেছি।’ আমি লিখলাম, তোকে নিয়ে অনেক হয়ে যাচ্ছে কিন্তু…।

ও আবার লিখলো, আমি সন্ধ্যার পর ফরেইনারদের বাচ্চা পড়াই। আবার ফজরের পরপর লেবারদের সাথে বালু-সিমেন্ট মাখাই!’ এবার কষে ধমকের মতো মেসেজ পাঠাই, লিখি, চুপ থাক!

কিন্তু ও তবু আরেকখান ছুঁড়ে দিল, ‘টেস্ট পেপার রাঙতা দিয়ে মুড়িয়ে গিফট বানিয়ে কত কত কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে কত বিয়াও খাই…!’

আমি বাশিরুলকে আবার লিখলাম, এ দেখি তোকে দিয়ে সমাপ্তি টানা হয়ে যাচ্ছে। আমার অনেকগুলো গল্প এডিটিংয়ের বাকি আছে। এখন এই লেখার ভেতরের বিষয় দিয়ে একটু লেজ না ঝোলালে তো একেবারে খাপছাড়া হয়ে যায়, কি বলিস?

বাশিরুল লিখলো, তা আপনি পারবেন। নিজেকে নিয়ে মজা করার অদ্ভূত ক্ষমতা আপনার!

আমি লিখি, মানুষ তো নিজেরটা চেপে অন্যেরটা টানাটানি করে। আর আমি অন্যেরটা এনে নিজের জীবনে সাজাই। আসল বিষয় হচ্ছে পাঠককে আমি মূল বিষয়ের সাথে যথাযথ পরিচয় করাতে পারছি কি না! সেখানে আমি হলে ক্ষতি কি? আমি কি স্বর্গ থেকে এসেছি, যে আমার কোনো বোকামি, লোভ-পাপ, স্খলন থাকতে পারবে না?

বাশিরুল লিখলো, আপনি এবার ফিনিশিং দেন। দেখি কেমন হয়…।

বাশিরুলকে লিখলাম, আমি ওই কাকের ইনবক্সে লিখে রেখেছি, ‘ওই, আমি কি তোকে দেখছি? তোকে দেখার পর, আমিই যে তোকে পছন্দ করবো, সে কথা তুই বুঝলি কিভাবে? এত বিশ্বাস তোর আসে কোত্থেকে, তোর পছন্দই শেষকথা হতে যাবে? আমার লিখে রাখা মেসেজ তুই নিরুত্তর রেখেছিস্। আমি দেশে আসি। দেখিস, নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে রক্ত যদি না ছুটিয়ে দিই…।’  এখনো পাঠাইনি। বুঝলি! খালি আঙুলের এতটুকু টাচ্ দিলেই চলে যাবে!

বাশিরুল লিখলো, আহা, একেবারে তুইতে নেমে গেলেন?

বাশিরুলকে লিখলাম, রাগলে আমি মুতিউলের ‘বিহানএ পাঠানো ওই গল্পের নায়িকার মতো ওইরকমই বলি!

বাশিরুল লিখলো, তাহলে আর কি করা!

 

দীলতাজ রহমান
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top