সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শত অপমান সয়েছেন নজরুল! তবু দমে যাননি, থেমে যাননি : আহমেদ জহুর


প্রকাশিত:
১১ অক্টোবর ২০১৯ ২২:১০

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ১৪:০৫

 

এক. মৌলভির মাথা নত হয়ে এলো!

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একবার আইনসভার প্রার্থী হয়ে ভোট চাইতে গেলেন মানুষের কাছে। গিয়ে হাজির হলেন এক মৌলভির বাড়িতে। কবিকে দেখে আঁতকে উঠলেন মৌলভি। 'এ কি! আপনি তো কাফের! কাফেরকে তো ভোট দেয়া যায় না!' মৌলভির কথায় সায় দিলেন তার সাথীরাও।

কবি এমন আচরণেও শান্ত ও স্থির গলায় বললেন, 'মৌলভি সাহেব! কাফের বলেছেন তাতে দুঃখ নেই। এর চেয়েও কঠিন কথা আমি শুনেছি। শুনতে হয়েছে অনেক জঘন্য কথাবার্তাও। তবে আপনার বাড়িতে যখন এসেছি, আপনাকে একটি কবিতা না শুনিয়ে চলে যাই কিভাবে?'

কবি নজরুল তার আবৃত্তির ডালা খুলে বসলেন। শোনালেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মহররম’। কবির ভরাট গলায় সে কি উচ্চারণ! এক অপার্থিব আবেগ ও হৃদয়ছোঁয়া বেদনার পরিবেশ তৈরি হল। মৌলভি তমিজুদ্দীন এবং তার সাথীদের মাথা নত হয়ে এলো। তারা অবনত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কবির দিকে। এই কি নজরুল! কি অপূর্ব তার কবিতা। কত গভীরে এর বেদনা! আহা! এমন করে তো আর কেউ কবিতা শোনাইনি। মৌলভি সাহেব এবং তার সাথীরা অনুতপ্ত হলেন। কবিকে বরণ করে নিলেন পরম আদর-যত্নে।

দুই. জাত কি ছেলের হাতের মোয়া?

কবি নজরুল ছিলেন বন্ধুদের জন্য পাগলপ্রাণ। এক হিন্দু বন্ধুর আমন্ত্রণে তার বিয়ের আসরে গিয়ে হাজির হলেন কবি। আহারের আয়োজন। কবিও খেতে বসলেন। কন্যাপক্ষের বাড়িতে অনেক বড় আয়োজন। বরযাত্রীদের সবাই অপেক্ষায়। কিন্তু খাবার আসছে না। ভেতর থেকে প্রশ্ন এসেছে, বরপক্ষের সাথে একজন মুসলমান এসেছেন কেন? অন্দরমহলের মেয়েরা খাবার পরিবেশন করবেন না! মুসলমানকে বিদায় করতে হবে। হোক তিনি কবি নজরুল। তাতে কি?

নজরুলকে সাথে নিয়ে যাওয়া বন্ধুরা লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। তারা তো কোনদিন নজরুলের ধর্ম দেখে বন্ধু হননি। অভিমানী নজরুল বেশ কষ্ট পেলেন মনে। হিন্দুদের এমন সংকীর্ণ আচরণ আর জাতের কদর্য রূপ দেখে ব্যথিত হলেন তিনি। মনের ক্ষোভ নিয়ে লিখে ফেললেন কবিতা, তারপর সেটি সবাইকে শুনিয়ে দিলেন। কবিতার সূচনা অংশ, 'জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছে জুয়া/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া?'

মুসলমান কবি নজরুলের মুখে এমন অগ্নিজ্বালা প্রতিবাদ শুনে সবার মাথা নীচু হয়ে এল। অভিমানী নজরুল তাঁর কবিতা শুনিয়ে চলে এলেন সেই বিয়েবাড়ি থেকে। মলিনমুখে তিনি পা বাড়ালেন বাসার উদ্দেশে।

তিন. হেডমাস্টার কেঁদে ফেললেন! 

একবার এক হেডমাস্টার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দাওয়াত করে নোয়াখালী নিয়ে এলেন। নজরুলের সভায় মানুষ এলো দলে দলে। চলে এলো মৌলভী সাহেবরাও। যতদূর চোখ যায়, শুধু সাদা টুপির সারি। মানুষে ভরে গেছে সভাস্থলের চারপাশ।

এ বিরাট জনসমুদ্রে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলেন কয়েকজন মৌলভি। তাদের সম্মিলিত কন্ঠের এক দাবি, 'এ সভায় নজরুলকে গান করতে দেওয়া হবে না। কোনভাবেই এ সম্ভব না।’ আশেপাশের অনেক মানুষও তাদেরকে সমর্থন জানালেন। কয়েকজন প্রভাবশালী লোক মৌলভি সাহেবদের অনুরোধ করলেন, নজরুলকে কয়েকটি গান গাইতে দেয়ার জন্য। তারা কিছুতেই রাজি হলেন না। এলাকাবাসীর ওপর মৌলভি সাহেবদের প্রভাব অনেক বেশি। তারাও মৌলভিদের পক্ষে। হেডমাস্টার সাহেব এমন পরিস্থিতিতে কেঁদে ফেললেন সবার সামনে। নিজের এলাকায় নজরুলকে নিয়ে এ অপমান তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।

কবি নজরুল বসে আছেন মঞ্চে। এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সবাইকে থামালেন। নীরব হয়ে এলো চারপাশ। তিনি তাঁর ভরাট কন্ঠে সবাইকে বললেন, 'আমার অনুরোধ' একটি মাত্র গান গাইবো আমি। যদি তা ভালো না লাগে, যদি আমার গান আপনাদের মত ও পথের বিপরীত হয়, তবে নিজেকে তুলে দিবো আপনাদের হাতে, যা খুশি আপনারা করবেন তখন।'

নজরুলের এমন কথায় থেমে গেল সবাই। মৌলভি সাহেবরা রাজি হলেন। একটা গান শোনা যেতে পারে। এর বেশি নয়। তারপর সভা শেষ করে ফেলতে হবে। কবি পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে গান ধরলেন। মনের সবটুকু আবেগ ও তেজ ঢেলে দিলেন তার কন্ঠে। তিনি গাইলেন, 'বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা/শির উঁচু করি মুসলমান….’। উপস্থিত শ্রোতাদের ধ্বনিতে কেঁপে উঠলো সভার আশপাশ। কবির গানের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়লো আকাশে বাতাসে, ঢেউ উঠলো জনসমুদ্রে। গানটির শব্দ ও কথার জাদুতে বিমুগ্ধ মৌলভি সাহেবরাও উঠে দাঁড়ালেন। তাদের গলা থেকে ভেসে এলো, 'মারহাবা! মারহাবা!! আরে, এতো গান নয়। গজল। গজল। এ গজলের সুর মানুষের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, এ গজল নাজায়েজ হয় কিভাবে? আমরা যে আরও শুনতে চাই। কবি সাব! আরও একখানা গাইতে হবে।'

কবি নজরুলতো এরই অপেক্ষায় ছিলেন। জনতার চেহারা এবং আপত্তিকারীদের মনমর্জি তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন। তিনি বললেন, 'আর না। আমি ক্লান্ত। বিশ্রাম নিতে হবে।'

বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ভেসে এলো আওয়াজ। অধৈর্য মৌলভি সাহেবদেরও নাছোড় দাবী, 'আর অন্তত একটি হলেও শোনাতে হবে।' মরুভূমির পিপাসা তাদের বুকজুড়ে। মানুষের এ আবেগ আর মৌলভিদের এমন বিগলিত দাবীর কাছে হার মানলেন নজরুল। তিনি বললেন, 'তবে তাই হবে।' তারপর শুরু হল তাঁর গান। সুরের তরঙ্গদোলায় ভাসতে থাকলো শ্রোতারা। মাথা নেড়ে নেড়ে দুলতে থাকলেন মৌলভি সাহেবরা। কবির শব্দঝংকারে উন্মাতাল হয়ে উঠলো পরিবেশ। নোয়াখালীর মানুষদের ভাবসাগরে জোয়ারের পর জোয়ার উঠতে থাকলো। গলা ছেড়ে কবি গাইতে থাকলেন তাঁর সব আবেগমাখা গান-গজল। একাধারে পাঁচ ঘন্টা কবি নজরুল গেয়ে শোনালেন তাঁর অমীয় গান-গজল। হৃদয়ছোঁয়া সেইসব ছন্দ মোহিত করে ফেললো সবাইকে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত কবি যখন চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, বিমুগ্ধ শ্রোতারা সবাই মিলে দাঁড়িয়ে গেলেন কবির সম্মানে। কবি হেঁটে চললেন তার জন্য নির্ধারিত বিশ্রামখানায়। পিছে মৌলভিদের সারি।

 

আহমেদ জহুর
কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top