সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

গল্প


প্রকাশিত:
১১ অক্টোবর ২০১৯ ২২:১৪

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:১৮

গল্প

এই কী সেই রমিজ্যা 



বিস্তর টাকাওয়ালা গাঁয়ের ঐ মানুষটি যখন অপঘাতে মারা গেল তখন খুশিতে ধেইধেই করে নেচেছিল  রমিজ। লাফিয়ে লাফিয়ে হাত পা ছুঁড়ে নেচেছিল ঠিক যেন দক্ষযজ্ঞে শিবের তান্ডব নৃত্য। গাঁয়ের বয়স্করা বলেছিল, ‘রমিজ, অ্যারম করিস না, অ্যারম করতে নাই। মানুষ যখন দুনিয়া থেন চলি যায় তখন তার গুণগুলানই গাইতে হয়, দোষগুলান না।’ কেউ বা আবার বলেছিল ‘তুমি তো কোনই কাম করতা না তাও ঐ মানুষটা তুমারে কী দেয় নাই রমিজ, সবই তো দিছে। থাকবার জায়গা দিছে, মাস গেলে খাওয়া-পরার টাকা দিছে। সেই মানুষটার মরণে তুমি নাচতেছ! এইডা কি ঠিক রমিজ!’ কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে,‘ খালি কি ওরে দিছে, উনি তো গাঁয়ের মানুষের জন্যি করছেন, সকলের ভালোর জন্যি কাম করছেন, বিপদে আপদে সাহায্য করছেন। সকলের ম্যালা উপকার করছেন; যে, যা চাইছে, তাই দিছেন; কেউ ফিরে নাই খালি হাতে।’ এইসব কথা বলাবলি চালাচালি ছিল চল্লিশদিন; ফকির-মিসকিন খাওয়ানোর পর বন্ধ হলো সব কথা! এই ধরণের  কথা শুনলেই রমিজ উচ্চ হাস্যে দশদিক মুখর করে বলতো, ‘তোমরা জান না, ঐ লোকটা আমার কতোখানি ক্ষতি করছে। ও একটা হাড়-বজ্জাত লোক।’ ঐ টাকাওয়ালা মানুষটার বাড়িতে ছোট থেকেই থাকে রমিজ। তবে ঐ লোকটা মারা যাওয়ার আগের রমিজ আর এখনকার রমিজে আকাশ-পাতাল তফাৎ দেখতে পাচ্ছে গাঁয়ের মানুষ। 



চায়ের একটা দোকান ছিল রমিজের বাপজানের। ধানি জমি ছিল। গরু ছিল। সুখী সুন্দর সংসার ছিল, সেই সংসারে ছিল মা আর আদরের ছোট একটি বোন। গাঁয়ের মানুষ না জানলেও রমিজ জানে ঐ লোকটা! ঐ লোকটা সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে ওর! সব কিছু কেড়ে নিয়ে পথের কুকুর বানিয়েছে ওকে! ওদের বললেও বিশ্বাস করে না, করবে না কেউ! সকলে জানে সব হারিয়ে ঐ লোকের দয়ায় বেঁচে আছে রমিজ্যা মানে ঐ হাভাতে রমিজ। রমিজ লেখাপড়া তেমন জানে না; সুযোগ পায়নি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ওর বাপজান গাঁয়ের পাট ক্ষেতের মধ্যে গামছা জড়ানো অবস্থায় চিৎ হয়ে পড়েছিল। কে বা কারা ফেলে রেখেছিল তা জানে না রমিজ। তবে ওর এখনও মনে আছে বাপজানের এক চোখের কালোমণিটা কোটর থেকে বেরিয়ে ঝুলছিল গালের ওপর আর অন্য চোখে বাপজান চেয়েছিল আকাশের দিকে। বুকের ভেতর খুব কষ্ট হয়েছিল, এখনও মাঝেমধ্যে সে কষ্ট ফুলেফেঁপে ওঠে বুকের মধ্যে। বাপজান মারা গেলে এই লোক তাকে ডেকে এনে পেটভাতে কাজে রেখেছিল। ওর মাকে দিয়েছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বাড়িতে ঘরকন্নার কাজ। তারপর কী হয়েছিল জানে না, কেন হয়েছিল তাও জানে না; শুধু জানে ছোট বোনটা যখন ডাগর-ডোগর হয়ে উঠলো তখন গাঁয়ের ত্রিসীমানায় একদিন কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না ওকে। আদরের বোনের জন্য কত্তো যে ঐ লোকটার কাছে ধর্না দিয়েছিল তার ইয়াত্তা নাই; লোকটা ওর মাথায় হাত দিয়ে অদ্ভুতুরে কন্ঠে কথা দিয়েছিল খুঁজে দিবে কিন্তু দেয়নি। বারবার ঐ লোকটার কাছে গিয়েছে কিন্তু শুনেছে ঐ একই কথা, ‘খুঁজে দিব।’ একদিন পায়ে ধরে বলেছিল ‘আপনে তো সব পারেন হুজুর, একটু দেইখ্যা দ্যান হুজুর, খুঁইজা দ্যান হুজুর, আপনার পায়ে ধরি হুজুর; খুইজা দ্যান গো হুজুর।’ পা ধরেই রেখেছিল রমিজ। কিন্তু লাথি মেরে পা সরিয়ে লোকটা বলেছিল, ‘ম্যালা ঘ্যানঘ্যান করিস রমিজ্যা। যা এখান থাইক্যা। আমার কাম আছে। তর বোন অকাম-কুকাম করতে গিয়া কই পলায়া গ্যাছে তার ঠিক নাই...।’ কথা শুনে শরীরের মধ্যে রক্ত টগবগ করছিল তবুও কিছু বলেনি রমিজ। উপরন্তু আবারও অনুরোধ করতে চেয়েছিল রমিজ কিন্তু বাড়ির পাশের কুদ্দুস এসে ওর কানে কানে কী কথা বলাতে দৌড়ে চলে গিয়েছিল বাড়ি। 



বাড়ি এসে দেখতে পেয়েছিল ওর মা ঝুলে আছে বাড়ির পেছনের আমগাছের ডালে। বাপজান চলে যাওয়ার পরে মা আর বোনকে নিয়েই ছিল রমিজ; সারাদিন টাকাওয়ালা মানুষটার বাড়িতে থাকতো আর রাতে বাড়ি এসে বোন আর মায়ের সঙ্গে কথা বলে সময় পার করতো। রমিজের কাছে মা-বোনের সঙ্গে সময় কাটানোই ছিল সারাদিন চব্বিশঘন্টার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সময়! ঐ সময়টাতে গাঁয়ের মানুষ কোন রকম কাজ করতে দেখতো না ওকে! 



গাঁয়ের মানুষ জানে রমিজের বাপজান ছিল খুবই ভালো মনের মানুষ। সেই বাপজানের সন্তান হয়ে কখনই খারাপ কাজ করা তো দূরের কথা, খারাপ কাজের কথা চিন্তাও করতে পারে না রমিজ। সকলের চোখের সামনেই রমিজের পরিচিত সাথি-বন্ধুরা অপরাধজগতে ঢুকে কেউ ছিনতাইকারী, কেউ বা  মাদক পাচারে জড়িয়ে জেল-হাজত খেটে খেটে বিদিশা হয়ে গেল কিন্তু রমিজকে সেই আলাভোলা গোবেচারাই দেখেছে গাঁয়ের মানুষ। কিন্তু গাঁয়ের মানুষ বুঝতে পারেনি ওকে! ওরা জানে না রমিজ ঐ লোকটাকে ক্ষমা করতে পারেনি কখনও; আগেও না পরেও না! যখন খুব ছোট ছিল রমিজ তখন বুঝতে না পারলেও বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবই বুঝতে পেরেছিল; ওর এই রকম জীবনটার জন্য দায়ী কে? কিন্তু এই কথা কাউকে  বলতে পারেনি, হয়তো ইচ্ছে করেই বলেনি। গাঁয়ে মানুষটার খুব সুনাম! দিলদরিয়া মানুষ, দাতা হাতেম তাই। এ গাঁয়ের মানুষ ঐ ধনী মানুষটার নামে কোন রকম কটুকথা সহ্য করতে পারে না। রমিজ সব জেনেও চুপ থেকেছে! কাউকে কিছু বলেনি, বলতো না কখনও। কিছু না বললেও সকলে অবাক হতো! ভাবতো ব্যাপার কী? ‘এমনি এমনি ওর জন্যে এত্তোকিছু করে ক্যান ঐ মানুষটা?’ এসব আলোচনাও করতো অনেকে কিন্তু কোন সদুত্তর তারা পেতো না। 



রমিজের বোনটা ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল আগেই, এবার চলে গেল মা। ওর আর আগে পিছে কেউ রইলো না। যখন একা হয়ে গেল তখন অনেক চিন্তা ভাবনার পর বুঝতে পারলো কেন এইসব ঘটেছে ওর জীবনে, আর কে ঘটিয়েছে! কিন্তু যখন মারা গেল লোকটা তখন চুপ করে থাকতে না পেরে দুই হাত তুলে শিবের নাচন নেচেছিল! মিষ্টি বিলিয়েছিল। গাঁয়ের মানুষ নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করেছিল ‘ছোটবেলায় বাপকে হারায়ে বড় একা হয়ে গিয়েছিল। তারপর মা আর বোন চলে যাওয়াতে এক্কেবারে  পাগলই হয়ে গেছে। না হলে অ্যারম করে!’  কিন্তু ঐ মানুষটার মৃত্যুর মাস ছয়েক পরই গাঁয়ের মানুষ আশ্চর্য হলো! এই কী সেই রমিজ, রমিজ্যা; হাবাগোবা গোবেচারা রমিজ্যা। প্রথমে ওর বেশভূষার পরিবর্তন সকলের চোখে লেগেছে! পাত্তা দেয়নি কেউ। তারপর রমিজের ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হতে দেখে অনেকে এর উৎস খুঁজেছে পায়নি। সবার ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে রমিজ। ছোঁয়া-পাত্তা পায়নি গ্রামের মানুষ। শুধু অবাক আর আবাক; অবাকই হয়েছে। কিন্তু সেদিন আর অবাক নয়, ওদের ‘চক্ষু চড়কগাছ’!  যেদিন ওরা চোখ বড় বড় করে দেখলো ঐ অপঘাতে মৃত টাকাওয়ালা লোকটির তৃতীয় পক্ষের সুন্দরী স্ত্রীর হাত ধরে হেসে হেসে ঐ মৃত লোকটির বাড়িতেই ঢুকছে রমিজ! ঐ হাভাতে রমিজ্যা! 



 



কবি ,লেখক ও সংগঠক


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top