সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

ভাঙা ডানার প্রজাপতি : দীলতাজ রহমান


প্রকাশিত:
১১ অক্টোবর ২০১৯ ২২:১৭

আপডেট:
১৮ মে ২০২০ ২২:৫৬

 

আগে এমনটি হতো না।  যেখানে প্রয়োজন হতো সেই কলেজ জীবন থেকেই গটগট করে একাই বেরিয়ে পড়তাম। কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় গড়া সম্পর্কটির হাল শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে অপারগ হয়ে আবার যখন বাবার ঘরে ফিরে আসলাম, ক্রমে টের পেলাম অনেক ধরনের বিলাসিতার সঙ্গে বিলোপ হয়ে গেছে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত গতিও। এখন কোথাও পারতপক্ষে একা যেতে ইচ্ছে করে না। প্রয়োজনে তাই সবুজকে সঙ্গে নিয়ে যাই।

ব্যস্ত রাস্তা পার হতে গেলে ও আমাকে এমনভাবে আগলে ধরে এগোয় যেন কোনো যানবাহনে ও পিষে গেলেও আমার কিছু না হয়। ওর আচরণে আমরা সবাই এমনিতে মুগ্ধ হয়ে আছি। আমার হতাশ, ভাঙা মনটিতে জোর ফিরিয়ে আনতে ও উঠতে বসতে কত যে শক্তিদায়ক উদাহরণ টানে। পরিবারে শুধু আমরা ক’টি বোন আর বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত এবং রোগব্যাধির ভারে আক্রান্ত আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মা। সবুজের পদচারণা আমাদের মাঝে বাড়তি শক্তি যোগায়।

আমি সবার বড়। আমার পরের দু’টি বোন স্বামী-সন্তান নিয়ে নিজের নিজের সংসারে ভালোই আছে। তাদের পরের দুটি বোন লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে চাকরির সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য পাত্রস্থ হতেও তাদের আপত্তি নেই। চেষ্টা সব ধরনেরই হচ্ছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই ঢাকার উপ-শহরে ছোট্ট এই বাড়িটি। তাও রক্ষা করতে বাবাকে এই বয়সে হিমসিম খেতে হয়। তার উপরে তাঁর আয় বলতে শুধু ছোট চাকরির পেনশনের সামান্য ক’টি টাকা আর বাড়ির একটি অংশের ভাড়া। নানান টানাপড়েনের মধ্যে আবার পোহাতে হয় ভজখট ভাড়াটিয়া এবং জামাইদের আস্ফালনও।

শরীরের জোর কমে এলে সবারই মনের জোরে ভাটা পড়ে। সেই হিসেবে বাবাকেও দেখি ইদানিং তার নীতিবিরুদ্ধ হয়ে উঠতে। অনেক কাজই এখন তিনি সবুজের ওপর চাপিয়ে দেন। মা অবশ্য আগেও তাকে আমাদের মতো করে দেখেছেন। মোট কথা সবুজের সঙ্গে আমাদের মানসিক দূরত্বটা ইদানিং একেবারে শূন্যে এসে ঠেকেছে।

আমি এখানে ফিরে আসার পর টের পেলাম খুব অল্প সময়ের মধ্যে বয়সের ব্যবধান উৎরে তার সাহস ও সাবালকত্ব বহুধাপে উন্নীত হয়েছে। এই তো মাত্র ক’দিন আগেও সে আমার সংসারে গিয়ে নিজের থেকে কিছু বলতে পারেনি। যেটুকু জানতে চেয়েছি সেটুকু জড়তা কাটিয়ে ভালো করে বলতে পারিনি। বয়সে সবুজ আমার চেয়ে কম করে হলেও পনেরো বছরের ছোট হবে।

এখন ওর সঙ্গে চলতে পথে দেখা নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি। আমার শৈশব-কৈশোরের দেখা প্রেক্ষাপটটুকু নিয়েই বলি, কী দ্রুত ঘটে গেছে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়। উন্নত চিন্তা-চেতনার প্রতিফলনও যে ঘটছে না তা নয়। তার সুফলও যে আমরা পাচ্ছি না তাও নয়! ওকে বলি, দেখ কী আশ্চর্য! নিরিবিলি ক’টি তরুণকে এখন একত্রে দেখলে আমাদের রক্ত হিম হয়ে আসে। অথচ ওরাইতো আমাদের প্রাণশক্তি! আশার আলো! ওদেরকে দেখেই তো আমাদের উদ্দীপ্ত হওয়ার কথা!’

প্রতিভাবান তরুণ সবুজ, দ্রুত আত্মস্থ করে গূঢ় আলোচনার সবটুকু নির্যাস। ওকে বোঝাতে পেরে, ওর উন্নতি দেখে আমিও তৃপ্তি পাই। ঘরে এসে ও এখন আমার পাশে পাশে থাকে। আগে বাড়ির অন্য সবার চেয়ে আমিই ওর পর হয়ে ছিলাম। কারণ ও যখন আমাদের সংসারে স্থায়ী হয়ে থাকতে লাগলো তখন আমি মাত্র সংসার পেতেছি। ছিলামও দূরে দূরে। বাবা-মায়ের সংসারে জন্য আমার টান অন্য আর দশটা মেয়ের মতো কোনো দিনই ছিলো না। এটা নিয়ে আমার মা সুযোগ পেয়ে এখন বেশি কথা শুনিয়ে দেন।

একদিন ফুটপাত ধরে হাঁটছি। এমনিতে হাঁটতে আমার ভালো লাগে। তার উপর ঘরে ফেরার তাড়া নেই। সবুজও সঙ্গে আছে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সবুজ বললো - আপা, ওই দেখেন ওরা খারাপ মেয়ে। আপনি ইচ্ছে করলে ভিড় থেকে ওদের আলাদা করে চিনতে পারবেন। আরো একটু এগিয়ে ওই যে আপা, দেখেন ওটাও। আমি মজা পাচ্ছিলাম। এ-ও  যেন একধরনের খেলা। এগোতে এগোতে ও অনেকবার বললো, বলেন তো ওই মেয়েটি কী? সঠিক উত্তর পেয়ে আমার অনুমানশক্তিতে ও মুগ্ধ হয়ে যায়। এরপর নিজের ধীশক্তির পরিচয় দিতে আগবাড়িয়ে বলি ওই দেখো সবুজ, ওই যে...। সবুজ সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে হাসে। যেন ‘জিতে গেছেন’ গোছের সে হাসি।

দীর্ঘদিন আমার দাম্পত্য সম্পর্ক নিযে টানাপড়েন চলছিলো। সেই সূত্রে অনেক সুহৃদজনের কাছেও অভাজনে পরিণত হয়ে গেছি।  যোগাযোগ নেই আরো অনেকের সঙ্গে। দুর্যোগে পাশে থেকে থেকে ঘনিষ্ঠ হয়েছে শুধু একজন। নাজমা। এক আধবেলা সেই এসে গড়াগড়ি করে গল্প করে। এখন আমার যা পরামর্শ দরকার তার থেকেই নিই। বাবা অবশ্য নাজমাকে দেখলে ক্ষেপে ওঠেন। বলেন, মেয়ে মানুষের অতো কীসের স্বাধীনতা? ও-ই তোকে ঘর ভাঙতে উস্কে দিয়েছে। বাবা সারাজীবনই মেয়েদের বিপক্ষে এমনতর না-হক কথা বলেন। তাঁর ধারণা মেয়েমানুষের জন্মটাই হচ্ছে পুরুষগণের অধীন হয়ে থাকার জন্য। নাজমা এলে আমি তাই আমার বাবার কোপানল থেকে তাকে রক্ষা করি। সে এলে মাঝখানের দরজাটির সিটকিনি বন্ধ করে বাবার জন্য আমার রুমটিকে নিচ্ছিদ্র করে রাখি। বাবা যদিও নাজমার আগমন টের পান কিন্তু তাঁর উত্তপ্ত সব বাক্য ওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করাতে সক্ষম হন না।

নাজমা আমার মনের অনেকখানি জুড়ে দখল নিয়েছে। কী এক মহিমান্বিত লাবণ্য ওর মুখে ঝরতে দেখি আমি। নাকি পুড়েপুড়ে ও তা অর্জন করেছে বুঝতে পারি না। আমি যদিও ওর নিমিষে পড়ে শেষ করা একটি গল্প। কিন্তু ওকে পড়ে আমি শেষ করতে পারি না। দেখেশুনে শুধু ওকে যা জেনেছি। নিজের মুখে ও কোনোদিন ওর কোনো কথাই বলেনি। না সমস্যার, না সুখের, না কোনো স্মৃতিচারণ। তবু ওর উপস্থিতি আমাকে একধরনের উজ্জ্বল আনন্দ দেয়। তারার আলোতে যেভাবে সন্ধ্যা আলোকিত হয়ে ওঠে বদলে যায় চরাচর।

নিজের বাড়িতে ফিরে আসা পরবাসীর মতো এই আমাকে নিয়ে আত্মীয়স্বজনের যোগসাজশ প্রকাশিত হয়ে গেলো যখন, তখন নাজমা ছাড়া কার এত সাহস ছিলো বলতে, আপস করে দ্বিতীয়বারও যদি সংসার করতে হয় তবে ফিরে যা না আগের সংসারে! সেই মানুষটির কাছে। যার কাছে হাতেখড়ি ঘটেছিলো প্রথম ভুলটির।

হ্যাঁ, আমিও এখন বুঝি শমসের ধোয়া তুলসি পাতাটি ছিলো না। কিন্তু আমিও কি কম দায়ী ছিলাম প্রতিদিনের সেই অশান্তির জন্য। নাজমার কথায় আত্মদহন প্রচণ্ড হলো। ওর কথামতো খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম আমাদের দু’জনেরই ঘনিষ্ঠ এক বিধবা এসে তার দু’টি বাচ্চাসহ সংসারে জোয়াল সুনিপুণভাবে টানিয়ে নিচ্ছে ওকে দিয়ে। এখন স্বস্তিতে আছে দু’পক্ষই। আমার অক্ষম বেদনার কথাগুলো শুনে নাজমা বলে ফেললো ‘বুঝলি না তো, দাম্পত্য মানেও মানিয়ে নেয়া ছাড়া অন্যকিছু নয়! একসঙ্গে থাকতে হলে কিছুটা স্বাধীনতা উভয়েরই বিসর্জন দিতে হয়। আচ্ছা বলতো পাগলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাগল হতে হয়? নির্বোধের সঙ্গে নির্বোধ!’

একসঙ্গে ওর এত বুদ্ধির পরামর্শ গিলে গিলে আমারও চোখ খুলতে থাকে। বুঝতে পারি বেপরোয়াকে পোষ মানিয়ে রাখার আলাদা আনন্দ থাকতে পারতো আমার। নাহয় সবাই জানতো আমি ভালো আছি। যে জীবন থেকে আমি অগ্নিদগ্ধের মতো ছুটে এসেছি, আমার বাবাও কি তার চেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছেন আমার মায়ের মতামতকে? তবু এটা বুঝি না বেদবাক্যের মতো যার প্রতিটি কথা আমার কাছে খাঁটি মনে হয়, সেই নাজমা কেন তিন-তিনবার সংসার বদলালো এবং এখনো কেন সে একা দু’টি সন্তান নিয়ে লড়ে যাচ্ছে জীবনযুদ্ধে। বদল করছে একটা পর একটা চাকরিও।

যতদিন তার চাকরির প্রয়োজন হলো ততদিন সরকারি চাকরির বয়স শেষ। তাকে দেখছি এই উত্তর চল্লিশে এসে তরুণীটির মতো সেজেগুজে থাকতে। মুখে মাখানো মেকাপের পুরুপরতে ঢাকা পড়ে থাকে তার অসাধারণ মেধার চাকচিক্য। তবু।

একদিন নিজের বুদ্ধির ধার ফলাতে একই সঙ্গে খেতে বসে নাজমাকে বললাম জানিস, সবুজ আমাকে দারুণ একটি বিষয় শিখিয়েছে।

নাজমা বললো, কী শিখিয়েছে?

বললাম খারাপ মেয়েদেরকে চিনতে।

খারাপ মেয়েদেরকে চিনতে? ঝরঝর করে প্লেটে পড়ে গেলো মুখের কাছে নেয়া ওর ভাতগুলো। নাজমা আচমকা ক্ষুদ্ধস্বরে কিছুটা চেঁচিয়ে বললো, সবুজ তোকে খারাপ মেয়ে চিনতে শিখিয়েছে? ওকে বল দু-একটা খারাপ পুরুষমানুষ আলাদা করে দেখাতে? ভয় পেয়ে চুপসে থাকি আমি। ওর হম্বিতম্বিটাও যে এত মারাত্মক তা আমি জানতাম না। এখন সবুজ সামনে এসে না পড়লে হলো। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বলে যায়,আচ্ছা বলতো, একজন মেয়েমানুষ খারাপ হয় পেটের দায়ে। বাবা, মা, সংসার, ভাই-বোনের জন্য। কিন্তু একজন পুরুষ কেন খারাপ হয়?

তোর মতো অতো কিছু বুঝি না আমি। অত কিছু ভাবিওনি। এতদিন তো ভেবেছিলাম শুধু আমাকেই নিয়েই জগৎ।

আমিও কি তার বেশি ভাবতাম। কিন্তু ঠেকে শিখেছি। দেখে তবেই এখন বিশ্বাস করি। জানিস ভুল করেও কোনো কোনো মেয়ে নষ্ট হয়, কিন্তু সেখানেও সর্বনাশা হাতছানিটি পুরুষেরই থাকে।

বাইশ-তেইশ বছর বয়সে শমসের-এর সঙ্গে বিয়ে হয়ে কেটে গেছে দীর্ঘ বিশটি বছর। একমাত্র সন্তান আমার, নাম সাগর। স্কুলের হোস্টেলে থেকে সে লেখাপড়া করে। আর্থিক স্বনির্ভরতা না থাকার দরুন ওকে নিয়ে আমি আর টানা-হেঁচড়া করিনি। তার পিতাই সব খরচ বহন করে। পিতামাতার ওপর শ্রদ্ধা হারিয়েও সে শিক্ষার উপোযোগী একটা পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছে, সেটুকুতে অন্তত আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত। মাঝে মাঝে দেখা করতে গেলে মায়ের সঙ্গে কেমন সব বেয়াড়া কথা বলে। তবু যাই। না গিয়ে থাকতে পারি না বলে। পৃথিবীতে ওই তো আমার একমাত্র অবলম্বন, হারানো গৌরবের উদ্ধারকর্তা।

খাবার ফেলে নাজমা আগেই আমার ঘরে চলে গেছে। বাবা আজ বাড়ি নেই। ফিরতে দেরি করছে বলে ওকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ডাইনিং টেবিলে বসেছিলাম। আমি ইচ্ছে করে একটু দেরি করে ওর কাছে গেলাম। ততক্ষণে ও নিভে গেছে। তবে আমার প্রতি ওর ধারণাটি একেবারে এতটুকু হয়ে গেছে বুঝলাম। যেন আনাড়ি কোনো মেয়েকে বলছে,-আচ্ছা বলতো তনিমা, যতগুলো মেয়েকে তোর খারাপ মনে হয়েছে, তাদের কারো মুখখানিই কি প্রসন্ন মনে হয়েছে? সুখের রেশ ঝরতে দেখেছিস?

নাতো! অনভ্যস্ত উত্তর আমার।

আবার যখন ও রকম কাউকে দেখবি, লক্ষ করিস দু’চোখ দিয়ে ওদের ঘৃণা ঠিকরে বেরুচ্ছে! সে ঘৃণা কার প্রতি জানিস?

কার? আমার শুকনো কণ্ঠের পাল্টা প্রশ্ন।

এই বৈরি সভ্যতার প্রতি। সেদিন দিনে-দুপুরে কী দেখলাম জানিস?

বল! ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে বললাম।

একটি ব্যস্ত রাস্তার আইল্যান্ডের ওপর একটি যুবতী মেয়ে কাপড় ফেলে উদোম বুকে শুয়ে আছে। কতটা অত্যাচার ওদের এমন বেপরোয়া করতে পারে জানিস? ঘরে-বাইরে কর্মক্ষেত্রে সবখানে আপস না করতে পারলে, অনেকেরই পরিণতিই ওখানে গিয়ে ঠেকবে।

ক’দিন ধরে সবুজের জ্বর কমছে না। এমনি এমনি সেরে যাবে ভেবে আমরা সবাই পালা করে সেবা-যত্নে করছি। বাবাও মাঝে মাঝে এসে ওর কপালে হাত রাখছেন। জ্বরের সঙ্গে ভিড় করছে নানান উপসর্গ। অগত্যা ডাক্তারের কাছে নিতেই হলো। ডাক্তার বিরাট অংকের একগাদা টেস্ট লিখে দিলেন। মড়ার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো একটা ধকল পেলো তাতে নিত্য অনটনের সংসারটি। কিন্তু রিপোর্ট দেখে চমকে উঠলেন ডাক্তার। চোখ বড় বড় করে বললেন, এইটুকু বয়সে আপনার ভাই মারাত্মক একটি  যৌনরোগে ভুগছে। রোগটি দারুণভাবে ছোঁয়াচে। ওর গ্লাস-প্লেট আলাদা করে দেবেন। এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। আপাতত বিশ্রামে থাকতে দিন। ডাক্তারের চিকিৎসাসংক্রান্ত আরো ফিরিস্তি আমার আর কানে ঢুকলো না। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে উঠলো। 

সবুজের বাবা কাজ করতো আমার দাদার সংসারে। গ্রামেই থাকত সে। মাঝে মধ্যে আমাদের জন্য ফলফলারি, চাল, পিঠা, বয়ে আনতো। মাঝে মাঝে সবুজও আসতো তার সঙ্গে। মজিদ চাচা ওকে সবুজ্যা বলে ডাকলেও আমরা ঠিকই বুঝে নিয়েছিলাম ওর নাম সবুজ। সবুজ এলে আর ফিরে যেতে চাইতো না। তা দেখে মজিদ চাচা আমার মায়ের হাতে ওকে সঁপে দিয়েছিলো। বলেছিলো, আপনেরা ওরে রাইখ্যা দ্যান ভাবীসাব। ছেলেমানুষ, দোকান থেকে ম্যাচ আনা থেকে ওকে দিয়ে মা’র অনেক কাজ হতো। লেখাপড়া শিখিয়ে মা অতবড় ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে বেশি বয়সেও দু-দুবার এসএসসি পরীক্ষার দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়বুদ্ধিতে পাকা আর নাটকীয়তায় মেধাবী ছেলেটির লেখাপড়া ধাতে সইলো না। তবু তাকে কিছু করে খাওয়ার পথটি অন্তত ধরিয়ে দেবার জন্য বাবার সঙ্গে মার খুনসুঁটি লেগেই থাকত। বাবা দায়িত্ব অস্বীকার করতেন না। তাই বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু টাকা তাকে দিয়েছেন আত্মীয়-স্বজন যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে। কিছু একটা হচ্ছিলোও। কৈফিয়ৎ অবশ্য কেউ চাইতো না। কেননা বনের পাখিকে খাঁচায় পোরার বিড়ম্বনা অনেক। সে বিষয়ে আমার বাবাকে আজীবন এতটাই সচেতন দেখেছি যে, সেটার সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে মানুষের চরিত্রে কোমলতা বলে আর কিছু থাকে না। আমার ছোট দু’টি বোনের কাছে সবুজ ছোট ভাইয়ের দাবী নিয়ে যায়। সব ছোট বোন-দুটিও তার সঙ্গে পিঠেপিঠি ভাইবোনের মতো প্রশ্রয়, স্নেহ আর সহমর্মিতার এক কঠোর দয়ার্দ্রবোধে একাকার হয়ে মানুষ হয়েছে। তিনজনের কেউ কাউকে মানছে না। তাদের থামাতে এই সেদিনও মাকে বেগ পেতে হলো। খেতে দিয়ে মা আজো একসঙ্গে ডাকেনÑরুমু, ঝুমু, সবুজ টেবিলে খাবার দিয়েছি।

মজিদ চাচা আজো আসে  যেমনি আগেও আসতো। কিন্তু সবুজকে আমাদেরকে দেয়ার পর থেকে সে আসামাত্রই চলে যায়। কারণ ছেলেটি  যেন আর ফিরে  যেতে না চায়। মায়া বাড়াতে চায়নি মজিদ চাচা। ছেলেটি ভদ্রলোক হয়ে উঠছে যে! গ্রামে ফিরে গেলে এ উন্নতি রহিত হয়ে যাবে।

আমার উদ্দেশ্যে বলা ডাক্তারের কথাগুলো শুনে সবুজ ভয় পেয়েছে কি লজ্জা পেয়েছে তা বোঝা গেল না। কারণ মরণের ভয়েই সে সেঁটিয়ে আছে। মা ছুটে এসে জানতে চাইলেন, কী অসুখ। বললাম, কিছু না, ডাক্তার শুধু বিশ্রাম নিতে বলেছেন। বাবাকে সত্যি কথাটি কোনোদিনই জানানো যাবে না। কারণ তিনি এমনি একজন পুরুষ, কোনো পুরুষেই তার বিশ্বাস নেই। আসল সত্যটি প্রকাশিত হয়ে গেলে তিনি নিজের বিয়ের যোগ্য মেয়ে-দুটির উপরও বিশ্বাস হারাবেন। সবুজের প্রতি দুর্বলতা তিনি কোনোদিনই স্বীকার করেননি। দায়টা যদিও ইদানিং স্বীকার করতে শুরু করেছিলেন। আমার আদিখ্যেতাকেও তীব্রভাবে কটাক্ষ করবেন। এ বাড়ির কেউ-ই আর পূত পবিত্র থাকবে না তাঁর চোখে। শেষে কিনা হার্ট অ্যাটাক করেন।

আমার চিঠি পেয়ে মজিদ চাচা ছুটে এসেছে। তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে শান্ত হতে বললাম। বললাম, উচ্চবাচ্য করো না চাচা। গ্রামে নিয়ে ওর সেবা-যত্ন করো। ওর অসুখ এমন কিছু নয়। তবু বাবা অসুস্থ। মা’রও শরীর কুলোবে না। আমরা কে কখন ঘরে থাকি না থাকি। সবাই তো ব্যস্ত। অনেকদিন ও ওর মা-ভাইবোনদের সঙ্গেও দেখা হয় না। সবার সঙ্গে দেখাও তো হওয়া দরকার। আমরাও গিয়ে ওর খোঁজ নেবো। ঘাবড়াচ্ছো কেন?

সবুজের জিনিসপত্র আমার মা-ই গোছগাছ করে দিচ্ছিলেন ছলছল চোখে। রুমু, ঝুমু কাতর হয়ে বসে আছে ওকে ঘিরে। বাবা একটা কিছু আঁচ করতে পেরেও কথা বাড়াচ্ছেন না। কারণ এখন এমনিতেই বাবা ওর এখানে না থাকাটাই শ্রেয় মনে করে আসছিলেন। শুধু বার্ধক্যের ধকলে তা বলার জোর পাচ্ছিলেন না।

জীবনে আমি কোনোদিন হারতে চাইনি। ঠকাতে চাইনি। চাইলে আমার জীবনটা অন্যরকম থাকত। কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে এনেছি নিজের সন্তানের পিতার কাছ থেকেও মোহরানার টাকাগুলো। বাবাকে দেখি আর্থিক অনটনে তার সোমত্ত মেয়ে-দুটির বিয়ের জন্যও অগ্রসর হতে ভয় পান। তবু তাঁকে অভয় দিই না। পিতা-মাতার প্রথম সন্তান হিসেবে নিজেকে আমার অন্যভাবে নির্মাণ করা উচিত ছিলো। সব বুঝেও আমি কারো কাছে আজো নমনীয় হই না। সেই আমি আজ, এ সময়ে কাঁপা কাঁপা হাতে চেক বইটা বের করলাম এবং সবুজের নামে একটি নির্দয় স্বাক্ষরে আমার কাবিনের টাকার মোটা একটি অংশ মজিদ চাচার হাতে ধরিয়ে দিলাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম নাজমার খোঁজে, অন্তত এ বেলাটি পার করে তবেই ঘরে ফিরবো।

 

দীলতাজ রহমান
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top