সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প-০৮; অচিনপুরের ঝিনুকরাণী : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১১ অক্টোবর ২০১৯ ২২:১৮

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ১৯:৪১

 

জানুয়ারীর মাঝামাঝি।  বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে।  অকাল বৃষ্টি। কনকনে শীত।  মেজর শওকত সিগারেট টানতে টানতে রেডিওতে গান শুনছিলেন। দেশাত্ববোধক গান।  দেশ স্বাধীন হয়েছে। লোকজন নতুন করে জীবন গড়ার চেষ্টা করছে।  ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্ত্রী-কন্যাসহ গত সপ্তাহে এসে বাসায় উঠেছেন। একসময়ের সাজানো গোছানো সংসারের কিছুই নেই আজ। সবই নতুন করে কিনে আবার নতুন সংসার সাজাতে হচ্ছে।  স্ত্রী রিনী ঘরের এটা ওটা গোছাতে ব্যস্ত। একমাত্র চার বছরের শিশুকন্যা মিশু, মাকে এটা ওটা দিয়ে সাহায্য করছে। মেজর সাহেব শীতে উসখুস করছে। 

এই রিনী এক কাপ চা দাও না। ভীষণ শীত করছে আজ।  এখন বিরক্ত করো নাতো বাপু। রিনীর এ কথা শোনার পর মিশু বুড়ীর মত চেঁচিয়ে ওঠে।  না, না। বাবা চা খাবে। বাবা আমি বানিয়ে দিচ্ছি। বলে কিচেনে দৌড়ায়। মেয়ের পাকামো দেখে রিনী বাধ্য হয় চা বানাতে। সবাই  মিলে এক সাথে ডাইনিং টেবিলে চা-নাস্তা থেকে বসে।

সন্ধ্যে হয়নি এখনো।  কিন্তু মনে হচ্ছে অন্ধকার রাত হয়ে গেছে। থমথমে আকাশ।  চায়ে চুমুক দিতে দিতেই দরজায় খটখট আওয়াজ শুনে মেজর সাহেব উঠে যান।  কে? কে? কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খোলেন মেজর সাহেব।  আরে, আরে, কে তুমি? ঘরে ঢুকছো ক্যান?

একটা পুটুলি হাতে ষোল সতেরো বছরের একটি মেয়ে জোর করেই ঘরে ঢুকে পড়ে। ঠকঠক করে কাঁপছে।  ভাইজান আমারে ইট্টু আশ্রয় দ্যান। এ পৃথিবীতে আপনারা ছাড়া আমার কেউ নাই।  একদিন সবাই ছেল। যুদ্ধের আগে।  মেয়েটির বিনয় ও মায়াময় চেহারা দেখে মায়া হয় মেজরের।  রিনী কাছে ডাকে।  এই মেয়ে এদিকে আয়তো। কোথা থেকে এই অন্ধকারে শীতের মধ্যে এখানে এসেছিস?

ধানমন্ডি পূনর্বসান কেন্দ্র থেক্যে পলায়া আইছি আপুমনি। আমার মত মাইয়াগো যে যার মত চল্যা যাবার কইছে উহানকার স্যারেরা। 
অনেকের বাপ, মা, ভাই-বোন আস্যা নিয়্যা গ্যাছে। আমার মনে অয় কেউ ব্যাচ্যা নাই ভাইজান। কেউ আমারে নিব্যার আসলো না। 
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটি।  আ-হা-হা কেঁদ-না। তোমার নাম কি বোন? ভয় নাই। কোথায় বাড়ী তোমার?
ঠিকানা জান? আমার নাম ঝিনুক। বাজানে ঝিনুক রানী কয়া ডাইকতো।  আবার কান্না। 
কেঁদে কেঁদেই বলে বিড়বিড় করে, আর গেরামের নাম অচিনপুর; দ্যাশ? দ্যাশের নামতো বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ। দ্যাশের জন্য আমার সব দিছি। হি, হি, হি করে পাগলের মত হাসতে লাগলো মেয়েটি।  মেজর সাহেব খুব সহজেই সব বুঝতে পারলেন। রিনীকে ইশারা করলেন ভেতরে নিয়ে যেতে। 
এই ঝিনুক। আয় ভেতরে আয়। 
দৌড়ে এল মিশু। 
বাবা, এই পাগলটাকে ঘরে ডাকছো ক্যান? আমার ভয় লাগছে তো। 
কুনো ভয় করো না সোনামনি। তুমারে আমি অনেক আদর করবো। 
এভাবেই ঝিনুকের আগমন হলো মেজর সাহেবের বাসায়। ঠাঁই, আশ্রয়-যাই বলা যায়। তাদের মায়াময় আচরণে ঝিনুক আস্তে আস্তে সুস্থ জীবনে ফিরে আসে। 
মেজর সাহেব অনেক খোঁজ খবর নিয়েও জানতে পারনে নাই ঝিনুকের ঠিকানা বা তার কোন আত্নীয় স্বজনের কথা। 
সেই থেকেই ঝিনুক মেজরের বাসাতেই কাজকর্ম করতে থাকে। 
মাঝে মাঝে মেজর সাহেব খেয়াল করতেন, আর্মীর পোষাক পরা দেখলেই ঝিনুক কেমন অ্যাঁৎকে উঠতো। সবই বুঝতে পারতো মেজর। 
সহজ সরল কিশোরী মেয়েটিও পাকশয়তানদের হাত থেকে রেহাই পায় নাই। 
রেহাই পায় নাই ওর পুরো পরিবার। ও ওর নারীত্বকে বিসর্জন করেছে। 
ভয় নেই, ঝিনুক। তুই আমাদের একটা অচেনা বোন। এখানে তুই নিরাপদেই থাকবি। 
মেজর ঝিনুকের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ঝিনুক এখানেই মানুষ হতে থাকে। 
মিশুর সব দেখাশোনা ঝিনুকেই করে। রিনীও খুব খুশী। 
দেশের এই দুঃসময়ে ভাল একটা বিশ্বাসী মেয়ে পেয়ে মনে মনে খুশীয় হয় রিনী। 
ঝিনুক পড়ালেখাও জানে। মিশুকে ছড়ার বইগুলো সুন্দর করে পড়ানো দেখে একদিন রিনী জিজ্ঞেস করে-ঝিনুক তুই পড়া লেখা জানিস?
হ’ আপুমনি। গেরামের স্কুলে কেলাস টেনে পড়তাম। স্কুল থেইক্যা আওনের সুমায়ই তো... চিৎকার করে ঝিনুক। 
ঐ শযতান শামছু মিয়া, আমার বাজানের মতন; যারে চাচা বইল্যা ডাকতাম, ঐ হারামজাদায় আমারে আর্মীগো গাড়ীতে উঠাইয়া দ্যায়। 
রাস্তার ব্যাবাক মাইনষে চাইয়া চাইয়া  দ্যাখলো, ডরে কেউ আমারে রক্ষা করব্যার জন্য আগাইয়া আইলো না। যার যার জীবন লয়্যা পলায়া গ্যাল। রাজাকার শামছু হারামজাদা। সব মানুষই শয়তান, বেঈমান, রাজাকার....ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলো ঝিনুক। 
কাঁদিস না ঝিনুক। আমরা তো তোকে ফেলে দেইনি। ঝিনুক শান্ত হয়। এ ভাবেই দিন কাটছিল ঝিনুকের। 
মাঝে মাঝে মিশুকে কোলে নিলে ছোট বোনটির কথা মনে পড়ে খুব। মনিমালা। ফুটফুটে চাঁদের মত। দুই বোন ছিল ঝিনুকরা। দু’জনই সুন্দর। বাবা’মা তাই তাদের ঐ নাম রাখেন। 
কর্মহীন সময়ে মাঝে মাঝে আরও একজনের কথা খুব মনে পড়ে ঝিনুকের।

কবীর। ছোট বেলার খেলার সাথী। রাজপুত্রের মত গড়ন। দু’জনের খুব ভাব দেখে কবীরের বাবা প্রতিবেশী ঝিনুকের বাবাকে বলতো- শোন ভাই ভাবী, তোমার ঝিনুক তো পরীর ল্যাহান সুন্দরী অইবো বড় অইলে। অরে গেরামের স্কুলে ভর্তি কর‌্যা দ্যাও। ল্যাহাপড়া শিখাও। বালো বিয়া হবিনে। 
হ’বাই, ইচ্ছে আছে দুইডা মিয়ারই ল্যাহাপাড়া শেখাবো। 
হ’হ’ শেখাও। দেখ না, আমার কবীর কেমন সুন্দর বই ব্যাগ কাঁধে লয়া ইস্কুলে যায়। কী সুন্দর লাগে। যত কষ্টই হউক  কবীররে আমার বড় কিছু বানাবার চাই। 
আমার কবীরের সাথে তুমার ঝিনুকরে মানাইব খুব। 
কি কন বাই। আমরা তো আপনের মত অত বড়লোক না। 
তাতে কী! তুমারে আমি সাহায্য করবনে, যাও। নিশ্চিন্তে থাক। ঝিনুকরে ইস্কুলে ভর্তি করাও। ঝিনুক আমারও মিয়া। আমার তো ঐ একডাই ছাওয়াল। 
কবীরের বাবা কিসের ইঙ্গিত দেয় বুঝতে পারে, ঝিনুকের মা-বাবা। 
ঝিনুকরে তার ছেলের বৌ করার ইচ্ছা ভবিষ্যতে। ঝিনুকের মা-বাবা দু’জনেই খুব খুশী। 
সেই থেকে ঝিনুক ইস্কুলে যাওয়া শুরু করে। গেরামের প্রাইমারী শেষ করে একটু দূরে হাই ইস্কুলে ভর্তি হয়। 
পড়াশোনায় খুব ভাল। শিক্ষকরা আদর স্নেহ করেন। একই স্কুল থেকে কবীর এসএসসি পাশ করে শহরে যায় পড়তে। 
প্রতি সপ্তাহেই ঝিনুকরে চিঠি দিত। ঝিনুক কবীরকে সাগর বলে সম্ভাষন করে চিঠির উত্তর দিত। 
কবীর খুব খুশী হতো। এভাবেই স্বপ্নের জাল বুনে যাচ্ছিল ওরা। 
এরপর শুরু হলো দেশে উত্তাল বাতাস। ঝিনুক তখন ক্লাস টেনে টেষ্ট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। প্রতিদিন স্কুলে যেত কোচিং করতে। গ্রামে থেকে দেশের এত খারাপ অবস্থা বুঝতে পারতো না তারা। তবে মুক্তিফৌজ-রাজাকারের নাম শুনেছে।
সেদিন স্কুলে যেতেই টিচাররা ক্লাস নিলেন না। ঝিনুককে খুব সাবধানে বাড়ী চলে যেতে বললেন। দেশের অবস্থা খুব খারাপের দিকে।
ঝিনুক দৌড়ায়ে বাড়ি ফিরতে লাগলো। কিন্তু বাড়ি পৌছানোর কিছুদূর বাকি থাকতেই, রাজাকার শামছু মিয়া তুলে দিল মিলিটারীদের গাড়িতে। 
এরপর দুর্বিসহ অন্ধকার জীবন। 
ষোড়শী, নিস্পাপ ঝিনুকের প্রস্ফুটিতে জীবনের ফুল ফুটতে না ফুটতেই দলে-মুচরে কলংকিত করে দিল পাক আর্মীরা। তার অপমৃত্যু হলো। 
দিনের পর দিন। এ জায়গা থেকে ও জায়গা। 
একেকদিন একসাথে তিন চারজনেও ধর্ষণ করতো ঝিনুককে। অল্পবয়সী সুন্দরী ঝিনুককে সবারই পছন্দ। ভালো খাবার, পোষাক দিত। 
এরপর দেশ স্বাধীন হলো। 
একটি বাংকারে প্রায় দশ-বারোজন মেয়ে ছিল তারা। বোমারু বিমানের আক্রমণের সময় এখানে লুকিয়ে রাখে পাকি শয়তনরা। সবাই উলঙ্গ। 
মুক্তিফৌজরা লুঙ্গি গেঞ্জি দিয়ে সাহায্য করে। ঝিনুকও লুঙ্গি গেঞ্জি পড়ে সব মেয়েদের সাথে বেরিয়ে আসে। এরপর ধানমন্ডি পূর্নবাসন কেন্দ্রে আনা হয়। ঝিনুক তখন অপ্রকিতিস্থ। 
কিছুদিন চিকিৎসার পর একটু ভাল হয়। দেখে, প্রতিদিনই কেউ না কেউ অনেককেই দেখতে আসছে।  
কেউ কেউ তাদের মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ ক’দিন পরে এসে নিয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিয়ে আর কোনদিন আসে নাই। 
ঝিনুক পথ চেয়ে থাকে। 
কেউ না কেউ তো তার খোঁজ করবেই। এখানকার কর্তৃপক্ষ তার ঠিকানা দিয়েছে। 
ঝিনুক দিন গোনে। 
এই বুঝি আজ আসবে তার বাজান; কিংবা স্বপ্নের সাগর। 
কিন্তু না। 
মাস পার হয়ে গেল। 
কেউ-ই এল না তাকে নিতে। হয়তো কেউ-উ-বেঁচে নেই। মাথাটা ঝিম ঝিম করে। আর দেরী না করে সুযোগ বুঝে সবার অলক্ষ্যে একদিন পালিয়ে আসে ঝিনুক। 
তারপর থেকেই মেজর সাহেবের বাসায় আশ্রিত। 
কিন্তু বাইরের কেউ বুঝতে পারে না ঝিনুকের প্রকৃত পরিচয়। টানা টানা ডাগর চোখের পটে আাঁকা ছবির মত ঝিনুককে, রিনী ও মেজর সাহেব বোনের মত আদর স্নেহ করেন। 
শিশুর দেখাশোনা, ঝিনুকেই করে। ঝিনুকের সবকিছুই ভাল লাগে। তার হারানো অতীতকে মুছে ফেলার প্রাণান্ত চেষ্টা করে। 
ভুলে থাকতে চায় সব। কিন্তু মেজর সাহেব যখন তার সামরিক পোষাক পরে কর্মক্ষেত্রে বের হন, ঝিনুক তখনই কেমন যেন উদভ্রান্তের মত ছটফট করেত থাকে। 
এই পোষাকধারী ব্যক্তিদের উপর তার দারুণ ঘৃণা। তার নারীত্বকে হরণ করেছে এই পোষাকধারী মানুষ। 
সমাজ সংসার সব কেড়ে নিয়েছে। মনে পড়ে যায় পাকআর্মীদের পাশবিক নির্যাতনের কথা। কিন্তু, তাহলে কি হবে। 
মেজর সাহেবের দয়াতেই তো সে আজো বেঁচে আছে। আজও অপেক্ষায় আছে, যদি তার কেউ আসে কখনো। 
কিরে ঝিনুকরানী-চুপচাপ কেন?
আর্মীর পোষাক পরে মেজর জিজ্ঞেস করে ঝিনুককে। এই পোষাক দেখে ছুটে ঘরের মধ্যে চলে যায়। হৃৎপিন্ডটা যেন লাফাতে থাকে। 
কেউ বোঝে না। বোঝে না রিনী কিংবা মেজর সাহেব। বোঝাতে পারে না তার এই যন্ত্রণার কথা। এ যন্ত্রণার কোন চিকিৎসা নেই। 
কাউকে না বলা যায়; না বোঝানো যায়। 
দিনে দিনে, মাস-বছর যুগ পার হয়ে যায়। ইতোমধ্যে মেজর সাহেব পদোন্নতি পেয়ে কর্ণেল হয়ে অবসর গ্রহণ করেছেন। বনানীতে বাড়ী কিনেছেন। 
ঝিনুক এখন মধ্যবয়সী। চুলে পাক ধরেছে। চোখের কোটোরে কালো কালো ছাপ। 
নিরাশার সাগরে ডুবে যাওয়া এক দিক চিহ্নহীন জাহাজের মত তলিয়ে যেতে থাকে জীবন নামের প্রদীপটি। 
মিশু এখন পূর্ণ বয়স্কা একজন মেয়ে। 
বিয়ের কথাবর্তা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। পাকাপাকি হয়ে গেছে বিয়ে। শুনছে ছেলে একজন বড় কর্মকর্তা। বড়লোকের একমাত্র ছেলে, সুদর্শন। এর বেশি কিছু জানে না ঝিনুক। 
এত কিছু জানার দরকারই বা কি?
কোন কিছু জানার বা বলার আগ্রহ এখন তার একেবারেই নেই। আগের মত ক্ষণে ক্ষণে সবার কথা আর বড় বেশি মনে পড়ে না ঝিনুক এর। সয়ে সয়ে কষ্টগুলোও বুড়িয়ে গেছে। এমনি করেই বুঝি দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে বেচেঁ থাকে মানুষ। 
দিনক্ষণ ঠিক করে মহাধুমধাম করে বিয়ে হলো মিশুর। 
সিদ্বান্ত হোল মিশুর সাথে শ্বশুরবাড়িতে ঝিনুকও যাবে সঙ্গে। মিশু খুব খুশী। 
ঝিনুক তোর সব গুছিয়ে নে। জানিসই তো মিশু একা। রিনী ঝিনুকের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। 
ঝিনুক জিজ্ঞেস করে,
আপুমনি, ছেলের বাড়ি কুনখানে?
হঠাৎ তোর এ  প্রশ্ন কেন রে ঝিনু?
রিনী অবাক হয়। তবুও বলে,
ছেলের বাড়ি পাবনা। দাদা দাদীর বাড়ি গ্রামে! সাঁথিয়া। 
অ্যা? ঝিনুক কেঁপে ওঠে। 
কেন রে, তুই চিনিস নাকি? তুই তো আজও তোর গ্রামের নাম বললি না। 
না, না আপুমনি। আমার বাড়ি তো অচিনপুর। 
হয়েছে, নাও রেডি হও। এখন মিশুর শ্বশুর বাড়ি চিনে আস, যাও। 
আপুমনি, ছেলের দাদার নাম কি?
এইরে, হয়েছে। এত কথাতো আমি জানি না বাপু। 
আমি জানি। ছেলের দাদার নাম তোরাব আলী খান। 
কর্ণেল সাহেব জবাব দিয়ে, তাড়াতাড়ি ঝিনুককে তৈরি হতে বলে। ঝিনুক এর মাথার তালু গরম হয়ে ওঠে। 
এ ছেলে তো মনে হয় কবীরের বড় চাচার নাতি। কবীরের বাবা রমজান আলী আর তোরাব আলী দুই ভাই। 
কি সর্বনাশ। 
ঝিনুক কি করবে বুঝতে পারে না। 
মাথা ঘুরতে থাকে বোঁ বোঁ করে। 
এদিকে সবাই বরপক্ষ কণেকে নিয়ে গাড়ি ছাড়ার জন্য তাড়া দেয়। ঝিনুক মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। হৈ-চৈ পড়ে যায়। 
শেষমেষ ঝিনুকের আর যাওয়া হলো না। 
তিনদিন পর ফিরানী আনতে যাওয়ার কথা শুনে ঝিনুক যেতে রাজী হলো। ছেলের বাড়ি বৌভাত। প্রথমে রিনী আপত্তি করলেও কর্ণেল সাহেব ওকে যেতে সম্মতি দিলেন। 
সকালে রওয়ানা হয়ে দুপুর নাগাদ পৌছে গেল সবাই। 
যাবার পথে যমুনা নদী পার হয়ে বেড়া কাশিনাথপুরের সাইনবোর্ড চোখে পড়ায় চমকে ওঠে ঝিনুক। সবকিছুই অচেনা। 
বিশ পঁচিশ বছর পর গেরামের কত কিছু বদলে গেছে। বিজলী আলো, পাকা রাস্তা। তারপরও মাঝে মাঝে রাস্তার আশপাশে, সবুজ বাতাসে দোলা ধানক্ষেত, সরিষাক্ষেত, হলুদ ফুলে ঢাকা যেন বিছানো চাদর। 
ঝিনুক হারিয়ে যায় অতীতে। কবীরের সাথে হাত ধরে দৌড়াচ্ছে সরিয়া ক্ষেতে। 
আইল থেকে বৌ-টুবানী, বতুয়া শাক তুলে শাড়ীর কোঁচা ভরছে। কলমী শাক। 
কবীর কলমী ফুল, সরিষা ফুলের গোছা ঝিনুকের খোপায় গুছে দিচ্ছে। 
ঝিনুক হঠাৎ হি হি করে হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। পাশের ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন এই বেটি পাগল নাকি? হাসছো কেন? নাম তাড়াতাড়ি। 
ঝিনুক তাড়াতাড়ি নামে। ছেলের বাবার বাড়ি পাবনা শহরের শালগাড়িয়ায়। বিরাট তিনতলা বাড়ি। 
বৌ-ভাত এর আয়োজন করেছে শহরের কম্যুনিটি সেন্টারে। সেখানেই সবাই যায়। 
স্টেজে সেঁজে গুঁজে বসে আছে মিশু। ঝিনুক সবাইকে ঠেলে ঠুলে মিশুর কাছে যায়। 
মা’মনি! পরীর লাহান দেখাচ্ছে। 
মিশু চমকে ওঠে। ঝিনুক খালা, তুমি এসেছো? পাশ থেকে বর সালাম দেয় ঝিনুককে। 
এতকাল পর কেন যেন বুকটা ভরে যায় তার আনন্দে। বরের মাথায় হাত রেখে বলে সুখী হও বাবা। 
বৌ-ভাত শেষে মিশু ও বরকে নিয়ে সবাই চলে এল ঢাকায়। আসার আগে মিশুর শ্বশুরবাড়ি অগুণতি মেহমানের মাঝে চেনাজানা কতজনকে খুজলো ঝিনুক। 
এতকাল পরের কথা!
কাউকেই-চিনতে পারলো না।
হয়তো ঝিনুকের কেউ থাকলেও চিনতে পারে নাই। 
কেউ-ই বাঁচ্যা নাই মনে হয়। বিরবির করে ঝিনুক। মিশুকে দেখতে যায় ঘরে। 
কি? ঝিনুক খালা, আমার বরকে তোমার পছন্দ হয়েছে? খিলখিল করে হাসে মিশু। 
এক গাল হেসে ঝিনুক বলে-বাজানের নাম কি মা’মনি?
প্রবাল। 
প্রবাল মানে কি মা’মনি?
ওরে বাবা! এই, খালাকে তোমার নামের মানেটা বলে দাও না। 
তুমিই বলে দাও না প্লিজ! প্রবাল ঝিনুককে কানে কানে বলে।
ঝিনুক প্রাণভরে দু’চোখ ভরে দেখে, মিশু ও প্রবালের যুগল মুখ দু’টি।
খালা, তোমার নামের খুব কাছাকাছি প্রবাল থাকে বুঝলে? প্রবাল আর ঝিনুকের আদি জন্ম সাগরে?
ও.........। 
হঠাৎ মাথাটা আবার ঘুরে ওঠে ঝিনুকের। 
সাগর?
তার স্বপ্নের সাগর তো কোন মহাসগরে তলিয়ে গেছে এতদিন! মা-বাবা, আদরের বোন মনিমালা.....। 
ডুৃকরে কেঁদে ওঠে ঝিনুক। মাথায় হাত দিয়ে পড়ে যায়। মিশু দৌড়ে আসে। 
বুঝতে পারে হয়তো পুরনো স্মৃতি মনে পড়ছে। 
বাজানরে আমার খুব পছন্দ হয়েছে মা’মনি।
মিশুর দিকে তাকিয়ে ঝিনুক বলে ওঠে। 
ঠিক আছে ঝিনুকরানী। এখন তুমি যাও তোমার ঘরে। একটু বিশ্রাম নাও। 
ঝিনুকরানী! মাঝে মাঝে আদর করে কর্ণেল সাহেব এ নামে ডাকে। কি হোল আজ ঝিনুকের?
পুরনো সব স্মৃতি কেন এভাবে আজ আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে? এ নামে তো বাজান আমারে আদর করে ডাকতো... বড় বড় চোখে মিশুর দিকে তাকিয়ে ঝিনুক দৌড়ে যায় নিজের ঘরে। 
মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে। সাধারনত, ঝিনুককে মাঝে মাঝে এ রকম কান্নাকাটি করতে দেখলে রিনী বা কর্ণেল সাহেব কখনো ওকে বিরক্ত করে না। 
আজ হঠাৎ করে ঝিনুকের এ অবস্থায় দেখে রিনী মাথায় হাত বুলিয়ে বিছানায় উঠে শুয়ে থাকতে বলে। 
বাড়িতে আনন্দ। মিশুর জন্য দোয়া কর ঝিনুক। ওরা যেন হাসি আনন্দে থাকতে পারে। ঝিনুক চোখ মুছে একলাফে উঠে পড়ে। 
কি বলেন আপুমনি! দোয়া করবো না। প্রাণ ভর‌্যা মা’মণির জন্য আমার দোয়া আছে। জেবনে আমি যা পাই নাই, তার বদলে আল্লাহ যেন আমার মা’মনিরে সব সুখ-শান্তি দেয়। ঠিক আছে?
ঠিক আছে। আজ তোমাকে কিছুই করতে হবে না। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়। 
সকালে আমাকে সাহায্য করলেই হবে। প্রবাল এখান থেকেই অফিস যাবে আগামী কাল। 
ঠিক আছে আপুমনি। 
ঝিনুক মাথা নেড়ে বলে। 
পরদিন সকালে রিনীর উঠতে একটু দেরী হয়। মেয়ের বিয়ে-শাদীর ধকল গেছে এ কয়দিন। টেবিল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে নয়টা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে কিচেনে আসে।
ওমা সে কি?
ডাইনিংটেবিল সাজানো নাস্তা। মাংস পরোটা, চাউলের গুড়ির রুটি, সেমাই, জরদা। রিনী অবাক হয়ে যায়। 
আপুমনি, আইজ পোরথম বাজান শ্বশুর বাড়ি থেক্যা অফিস করবো, তাই একটু বেশি নাস্তা বানাইছি। ভাবলাম, অনেক ধকল গেছে এ কয়দিনে। আপনার শরীর খারাপ, তাই ডাকি নাই। রাগ করেন নাই তো আপুমনি? আপনে তো আমারে সব রাঁধনই শেখাইছেন। 
না, না, কি যে বলিস! রাগ করবো মানে। তুই তো আমার লক্ষী বোনরে! আদর করে রিনী ঝিনুককে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। 
খুশীতে ঝিনুক কেঁদে ফেলে। চোখ মোছে, শাড়ীর আঁচলে। কেউ একটু মিষ্টি মুখে কথা বললেই ঝিনুকের চোখে পানি আসে। 
আকাশ জোড়া মেঘ যেন তার দু’চোখের কোলে হঠাৎ করেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে চায়। ঝিনুক লুকিয়ে লুকিয়ে কত যে চোখের পানি ঝরায়। তবুও যেন শেষ হয় না। 
মিশু ও প্রবাল নাস্তার টেবিলে আসে। রিনীর সাথে ঝিনুক ও এটা ওটা তাদের প্লেটে তুলে দেয়। 
হুঁ। খুব মজা হয়েছে। এই-তোমার কেমন লাগছে?
মিশু প্রবালকে মাংসের টুকরো ও পরোটা তুলে দেয়। 
আমার পছন্দের নাস্তা। প্রবাল মিষ্টি হেসে বলে। 
রিনী কিচেন থেকে বলে-সবকিছুই কিন্তু আজ আমাদের ঝিনুকরানী করেছে।
ঝিনুক দৌড়ে আসে। বাজান, আর একটা পরোটা দেই। চাউলের রুটি।
দাও, দাও। তোমার বাজানের পছন্দের খাবার বানিয়েছ খালা। 
ঝিনুক মুচিকি মুচিকি হাসে। 
সবকিছুই ঠিকঠাক মত চলছিল। 
হঠাৎ করে বিপর্যয় ঘটে গেল, প্রবাল অফিসে যাওয়ার সময়। সামরিক পোষাকে বুটজুতা পায়ে রীতিমিত আর্মি অফিসার। চেহারাই যেন পাল্টে গেছে। 
ঝিনুক জানতো না মিশুর স্বামী কি চাকুরী করে। প্রথম যে দিন, এই সংসারে আসে, মনে পড়ে সেদিনও মেজর শওকতকে এই পোষাকে দেখে হঠাৎ আঁৎকে উঠেছিল।
কিন্তু তাদের কথায় যে আশ্বাস ঐ সময় সে পেয়েছিল, বিপদের দিনে আশ্রয় পাওয়াই তখন তার জন্য আসল প্রয়োজন ছিল। তারপরও মেজর সাহেবকে ঐ পোষাক পরাবস্থায় দেখলেই সে তাড়াতাড়ি তার রুমে চলে যেত। 
কিন্তু আজ?
আজ কেন সে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছেনা? বুকের মধ্যে গুমরে গুমরে উঠছে তার একাত্তরের বিভীষিকাময় স্মৃতি। 
মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড ঘৃনায় বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে ক্যাপ্টেন প্রবালের দিকে। 
মা’মনি, তোমারে এই পশুটার সাথে বিয়া দিছে?
কি বলছো খালা? তুমি কি পাগল হলে নাকি?
কি হয়েছে মিশু মা’মনি?
দৌড়ে আসে রিনী ও কর্ণেল শওকত। 
মা’মনি দেখ ঝিনুক খালা প্রবালকে দেখে কেমন আবোল তাবোল বকছে?
রিনী ও শওকত সাহেব এগিয়ে আসতেই ঝটকা টান মেরে রক্তবর্ণ চোখে চিৎকার করতে থাকে ঝিনুক। 
এত বছর ধর‌্যা ভাইজানের ঐ পোষাক পরনে সহ্য করছি। আবার নতুন কর‌্যা দেহা লাগবি ঐ বিভৎস পাপীদের পোষাক? ঐ পোষাক পিরথিবীর যে দ্যাশে, যারাই পিন্দে, তারাই অমানুষ হইয়া যায়। ঘাতক, পশু, দুর্বৃত্ত, ডাকাইত হয়া যায়।
আর না, আর আমি সহ্য করতে পারবো না আপু মনি, ভাইজান আমারে বিদায় দ্যান...দ্যান.. আমারে বিদায় দ্যান....। 
চিৎকার করে সবাইকে ঠেলে ঠুলে গেট খুলে প্রচন্ড বেগে প্রাণপনে রাস্তার পাশ দিয়ে দৌড়াতে থাকে। পেছন পেছন লোকজন দৌড়ায়। 
ও তো কর্নেল সাহেবের আত্নীয়। এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন?
একজন পথচারীর কথা শুনে হি হি করে হেসে ওঠে ঝিনুক। লোকজন থেমে যায়। পাগল হলো নাকি?
দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। রাস্তার পাশ দিয়ে। এত শক্তি সে কোথায় পেল আজ।
একটা রিকসা বেল দেয়। কোন লাভ হয় না। বেডী পাগল নাহি?
এই চুপ! পাগল! হ‘হ পাগল। হি...হি...হি...। 
এই রিক্সা আস্তে চালাও তো। 
রিক্সাযাত্রী বলে। 
দ্যাখছেন স্যার, পাগল হইলে কি অইবো, এই বয়সে অহনও কেমন সোন্দর চেহারা। চোখ দ্যাখলেই মায়া লাগে। আহারে... কার বা ফ্যামিলির, কেডা। 
রিক্সাওয়ালা টুংটাং চলতে থাকে। 
ঝিনুক ফুটপাতের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় থেমে যায়। সকালের সূর্য্যটা লাল আভা ছড়িয়ে বিচ্ছুরিত রোদ্রের তাপ ছড়াতে শুরু করছে। ঝিনুক দু’হাত প্রসারিত করে দীঘল, চুল ছেড়ে সূর্য্যরে দিকে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। 
আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে। 
হঠাৎ রিক্সাযাত্রী বলে, এই রিক্সা দাঁড়াও তো। 
আসলে রিক্সারযাত্রীটি ছিলেন সাংবাদিক। ঝটপট ক্যামেরা বের করে ঝিনুকের ছবি তুলতে থাকলো। 
রিক্সাওয়ালা মনে মনে বলে- আইজ সক্কাল বেলাই কোন পাগলের খপ্পরে পড়লামরে বাবা। 
সাংবাদিক ছবি তুলছেই। ঝিনুকের কোন নড়াচড়া নেই। 
দেখি মা, এইদিকে একটু ঘুরে দাঁড়ান তো। 
সাংবাদিকের কথায় সম্বিত ফেরে ঝিনুকের। 
তুমি কেডা বাজান?
আমি সাংবাদিক। 
আপনি কে? এমন করে দৌড়াচ্ছেন ক্যান? আপনার বাড়ি কোথায়? দেশ কোথায়?
আমার বাড়ি? হি, হি, হি, আমার বাড়ি অচিনপুর। দ্যাশ বাংলাদেশ। ঐ যে লাল সূর্যটা দ্যাখছো না? ঐখানে আমার বাড়ি, হি... হি... হি...। ঐ যে, লাল সবুজ পাতাকা। ঐখানে আমার ঠিকানা। 
সাংবাদিক আবার ছবি তোলে ঝিনুকের। ঝিনুক আপনমনে দৌড়াতে থাকে তার কল্পনার রাজ্যে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে। 
হলুদ সোনালী শর্ষ্যে ক্ষেত, পুকুরে শাপলা, বিলে কলমি ফুল। সে তার সাথী কবীরের হাত ধরে দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গাড়ী এসে ধাক্কা মারে। ছিটকে পড়ে যায়। ঝিনুকের মাথা দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরে। 
পথচারীর ভীড় দেখে হারায়নি ঝিনুক। সে তার সাথী কবীরের হাত ধরে দৌড়াচ্ছেই শস্যে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে। লালটুকটুকে শাড়ী পড়ে। মুকুট পরা কবীরের সাথে পালকী চড়ে গাঁয়ের পথে বধূ হয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে সে। 
হুম না হুম পালকী চলে, হুম না হুম.... হুম না হুম। ঝিনুকের নিথর দেহটি একটু নড়ে উঠে স্থির হয়ে যায়। 
পথচারীরা হৈচৈ করতে থাকে। 
সাংবাদিক ঝিনুকের আর একটি ছবি তোলে, আর তার কানে ভেসে আসে-“তুমি কেডা বাজান?” দু’চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে সাংবাদিকের। পরদিন খবরের কাগজে বড় বড় হেড লাইনে ছাপা হয়- “দুর্ঘটনায় গাড়ী চাপা পড়ে এক পাগলীর মৃত্যু”। 
তার বাড়ি অচিনপুর। লাল সুবজ পতাকায় তার ঠিকানা, দ্যাশের নাম বাংলাদেশ। 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top