সিডনী মঙ্গলবার, ২১শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

চোরাবালি (প্রথম পর্ব) : দীলতাজ রহমান


প্রকাশিত:
১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ২২:৪০

আপডেট:
১৮ মে ২০২০ ২২:৫৫

 

যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, সে আমার একমাত্র বড় ভাইয়ের বন্ধু। মূলত সেই সূত্রেই আলাপ-পরিচয় এবং দীর্ঘদিনের কথাবার্তার পর দু’পক্ষের সম্মতিক্রমে ছিলো এ বিয়ে। এক যুগেরও কিছুটা বেশি সময়ের সংসার আমার। কেমন আছি তা কখনো ফিরে দেখতে চাইনি।

তবে চেষ্টা করে সুখী হওয়ার আগ্রহটুকু আমার লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে আরেকজন। যার সঙ্গে আমার কোনোদিন তেমন কোনো সম্পর্কই ছিলো না। যদিও সে আরো ক’জনের মতো ভাইয়ার আরেকজন বন্ধু। তবে আমার স্বামী মুশফিকের চেয়েও আজো তার সাথেই ভাইয়ার সম্পর্ক বেশি অন্তরঙ্গ ও বিশ্বাসের। আর তাই হয়তো তার ছায়ার সঙ্গেও বিদ্যমান লড়াই মুশফিকের।

তবুও তাকে কেন্দ্র করে দাম্পত্য কলহটুকু কখনো এমন অতল হয়ে উঠেনি যে কৈফিয়তের দাবিতে কখনও ছুটে তার কাছাকাছি হওয়া যায়। তবে তাকে নিয়ে বিষয়টি এমন হয়ে আছে, যে তার নামটি উচ্চারণ করতেও আমি লজ্জিত হই। তা ভাইয়ার সামনে যেমন, তেমনি মুশফিকের সামনেও। তবে তাকে নিয়ে নীরব-ক্ষীণ অপবাদটুকুই আমার জীবনের একমাত্র বাড়তি মাত্রা বলে মনে হয় আমার কাছে। ওটুকু ছাড়া যেন আমার আর একান্ত নিজস্ব অর্জন কিচ্ছুটি নেই। তাই উচ্চবাচ্চ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেয়ে মুশফিকের কাছে তাকে সত্য করে তোলার চেষ্টায় অপরাধী ভাব করে থেকে গেছি।

মুশফিকের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা চলে প্রায় দু’বছর ধরে। চূড়ান্ত হতে আরো কতদিন লাগতো কে জানে? কিন্তু হঠাৎ চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিলো সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সবাই নদীভ্রমণে যাচ্ছে। আয়োজন ছিলো বেশ কয়েকদিনের। কিন্তু যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে এহসান ভাই হঠাৎ ভাইয়াকে লক্ষ করে বলে উঠলো, ‘এ্যই সৌমিক-মৌলিকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে নে!’ ভাইয়ার একেবারে ঝাড়া উত্তর-‘না!’
না মানে মুশফিক যাচ্ছে তাই।

যার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলছে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো...। কিন্তু এহসান ভাই নাছোড়। ধমক দিয়ে বলে উঠলো-‘আরো মেয়েরা যাচ্ছে না? তোর ইয়ে... লোপা আর তার ছোট বোনটিও তো যাচ্ছে!’ ভাইয়া আর আপত্তি করতে জোর পেলো না, কারণ ঘটনাটি ফাঁস হলে মা ভাইয়াকে লোপাবিষয়ক তথ্যাদি ঘেঁটে তুলোর মতো ধুনো করবেন।

ততক্ষণে এহসান ভাইয়ের মতো সঙ্গে মিলে গেছে আরো ক’জন। আমি দলের শেষের জন। আমার সাজগোজ কিচ্ছু হয়নি। ভাইয়ার অনাপত্তি ঘোষিত হওয়ার পরও তা চোখেমুখে স্পষ্ট না হওয়ায় ড্রয়িংরুমের চৌকাঠের এ পাশেই ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম। ভাইয়ার মুখখানা দেখে বোঝবার অপেক্ষা...। কিন্তু যখন ভাইয়া দপদপিয়ে পর্দা ঠেলে এ পাশে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ‘ঠিক আছ...।’ সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ো বাতাসের মতো এহসান ভাইও এসে বললো, ‘শোন, তোর ওই শাড়িটা পর! যেটা পরলে তোকে দারুণ লাগে।’ আমি বিস্মিত হয়ে, তারচে বেশি ভয় পেয়ে বলি, ‘কোন শাড়িটা যেন?’

-‘দেখো তো দেখি, আমি যেন ওর শাড়ির রং মুখস্ত করে বসে আছি! ওই যে, যেটা পরলে তোকে খুব ভালো লাগে!’ আমার অবাক, বিব্রত চেখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেষে খেইহারা কণ্ঠে বললো, ‘ঠিক আছে, তোর যেটা খুশি পর! তোকে সব রঙেই ভালো লাগে!’ বলেই এহসান ভাই চলে গেলো।

আমার মা ওদের সঙ্গে আমার যওয়ার আয়োজন দেখে মরিয়া হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘এমনিতে ভাইয়ের সাথে সব সভা-সমিতিতে যাওয়া, আবার তার বন্ধুদের সথে সমান তালে আড্ডা দেয়ার কারণে পাড়ার মানুষ ধিঙিমেয়ে বলে জানে। তার উপর আবার যার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে, সে যেখানে যাচ্ছে, সেখানেও ঘুরতে যাওয়া? এমনিতে সমন্ধটা কিছুতে জোড়া লাগতে চাইছে না। না, না মানুষ যত দেখে তত মোহ কাটে!’ কিন্তু ভাইয়ার সম্মতি পাওয়ার পর মা’র কথা মানি, মাকে এমন মান্য করা ছেলেমেয়ে আমরা দু’টির কেউ-ই নই। বরং বাবার স্মৃতি নিয়ে আমরা বিভোর! বাবা বেঁচে থাকলে আমরা এতদিন কোথায় থাকতাম, সেইসব স্মৃতি আমরা দু’ভাইবোন হরহামেশাই করি। তবে এখন আমার ভয় ও ঘর থেকে এহসান ভাইয়ের কথাগুলো কেউ শুনে ফেললো কিনা। মুশফিক শুনে ফেললে যা নয় তাই ভাবতে পারে। ওরা নাকি খুব খুঁতখুঁতে। চলাফেরা, সব তাতে যেমন মাপা তেমন মার্জিত। অতি মার্জিত হয়তোবা। যদিও মুশফিকের সঙ্গে আমার বিয়ের কথাটি এহসানই ভাই আগে তুলেছিলো।

আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবার মেয়ের এক এক করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল, শুধু আমার মায়ের এই মেয়েটিই পড়েছিলো। উপযুক্ত বর মেলে তো ঘর মেলে না। স্বচ্ছল বিধবাদের মন বোধহয় ছোট। কারণ, একদিকে নিজেকে যেমন এরা ছায়াহীন ভাবেন, আরেক দিকে আর্থিক অনটন না থাকায় নিজের মেধা ও শক্তি দু’টোর একটিরও অস্তিত্ব টের পান না, কখনো পরীক্ষায় নামতে হয় না বলে। আর মেয়ের বিয়ে তাই তাদের মতো মায়ের কাছে সর্বোচ্চ সমস্যা। মা’র প্যাঁচালে অতিষ্ঠ হয়েই এহসান ভাই একদিন বলেছিলো, মুশফিক ভালো ছেলে, সংসারের অবস্থাও ভালো। ভালো চাকুরিও পেয়ে গেছে। মৌলির সঙ্গে মানাবে। আপনি ক’দিন ভেবে আমাকে বলেন খালাআম্মা। আপনারা রাজি থাকলে আমি নিজে ওকে বলবো।’

আমার মা ভাবতে সময় নেননি। তবে মুশফিকসহ ওদের সবাই প্রায় বছরখানেক গড়িয়েছে পাকা কথা ছাড়তে। ওরা এগোলেই বিয়েটা হয়ে যায়। আমার মা তার সব আত্মীয়-পরামর্শকদের সঙ্গে প্রতিবার আলোচনা করে দেখেছেন, মুশফিকরা সবদিকে ভালো। তাছাড়া মুশফিকের চরিত্রটাও ঝকঝকে। কোনো শত্রুও তার নামে অপবাদ দিতে পারেনি। আমার মা’র সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এখানেই। তার মেয়ের জীবন নির্বিঘœ হবে, যা দিনকাল পড়েছে সব তো খোলা হাওয়ায় ভাসছে!

দীর্ঘদিন ধরে এই বিয়ের বিষয়টি অমীমাংসিত থাকতে থাকতে একটা ভয় সত্যি আমাকেও পেয়ে বসেছিলো। কারণ সবাই জেনে গিয়েছিলো দুই পরিবারের ভেতর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে আছে। কিন্তু ওদের অতোটা শীতল মনোভাবের কারণে আমার নিজের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে নিজেই ভেতরে ভেতরে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। মুশফিক বরাবর আমাদের বাড়ি আসা যাওয়া করলেও, সে যে এ বাড়ির জামাই হতে যাচ্ছে, তেমন আদর আপ্যায়ন পেয়েও তার আচরণে কখনোও কারো কাছে তার রেশও ধরা পড়েনি। বরং আমাদের পূর্বপুরুষ, আত্মীয়-স্বজনের শেকড়-বাকড়সহ তারা সবাই ঝাঁঝরা করে ফেলেছে গোড়ার ইতিহাস জানতে। যা দেখছে এই যেন যথেষ্ট নয়।

সেদিন নদীভ্রমণে গিয়ে এহসান ভাই আমাকে তটস্থ করে ছেড়েছিলো। যেন আমার কিছু হয়ে গেলে ওকেই কৈফিয়ত দিতে হবে মা’র কাছে। পড়ন্ত দুপুরে আরো ক’জন যে যার মতো রিকশা-ট্যাক্সিতে করে সদরঘাট এসে পৌঁছলে, সবার জন্য বিরাট একখানা নৌকা ভাড়া করা হয়েছিলো। সবাই মিলে জনাবিশেক বেশ আয়েশ করেই বসেছিলাম তাতে। আমি আর মুশফিক ছাড়া হই-হল্লা কেউ কম করেনি। নৌকো ডুবে যাক তাতে যেন কারো কিছু এসে যায় না। বরং সেটাই যেন আরো অন্যরকম আনন্দের হবে। আজো মনে আছে, হনহন করে মুশফিক বসেছিলো একেবারে গলুইয়ের উপর গিয়ে। আমাকে ঠিক মাঝখানে বসিয়ে আগলে বসেছিলো এহসান ভাই। অন্যমনস্ক মুশফিকের মুখে তখন হেমন্তের আকাশের মতো আলগা মেঘ ছিলো। যদিও তখন ছিলো কদম ফোটার তুমুল আষাঢ়।

মেয়েগুলো সরাসরি নয়, মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে সদ্য সরকারি চাকুরি পাওয়া মুশফিককে কেমন আড়চোখে দেখছিলো। যেন ও ওদের কলেজের সুদর্শন ব্যাচেলর লেকচারার। দু’একবার তাকিয়ে চমকে উঠেছিলাম আমিও। মানুষ এত নিখুঁত হয়! হয় এত সুন্দর! অপরিমিত গাম্ভীর্য, তবুও...। কিন্তু একবারও ও আমার দিকে মনোযোগী হচ্ছে না। আর এটুকুর জন্যই আমার একটা খটকা তৈরি হয়। অহংকার করার মতো যথেষ্ট ঐশ^র্য ওর আছে। কিন্তু বিনয় থাকবে না একটুও? ওর ওই অবিনয়ী মনোভাবের জন্য আজো আমি ওকে এতটা ভালোবাসতে পারিনি, যতটা বাসলে আর কারো মুখ আমার মনে পড়তো না। দূরের, ওই ভাসমান মেঘের কাছে শীতল বৃষ্টির প্রার্থনা করতে হতো না।

হঠাৎ আকাশ অন্ধকার মেঘে ভারাক্রান্ত দেখে সবাই ভীত হয়ে পড়লেও আমি ভাবছিলাম কিছু মেঘ এনে মুশফিকের কপালে মেখে দিলে ভালো হয়। ওর নিজের অন্ধ অহংকারই আমাকে বহুদূরের করে রেখেছে। অথচ আমি যে এসেছি, তাতো সবটুকুই ওর জন্য। ক্রমে খটখটে রোদের মতো মনে হচ্ছিলো ওর দৃষ্টি। মনে হচ্ছিলো কী যেন নেই ওর মাধ্যে। আকাশে একটু মেঘ না থাকলে, অথবা একটু নীলচে বা কৃষ্ণ আভা না থাকলে বড় ফ্যাকাসে মনে হয়। চোখ ঠিকরে যায় যে বিভোরতায় তাতে মানুষ চোখ পাতেইবা কি করে! মুশফিক আমাকে কী ভাবছে ভেবে, ভাবছিলাম, হ্যাংলার মতো আমি না এলেই ভালো হতো। বুঝতো, সব কিছুতেই আমি অতো আগ্রহের ধার ধরি না!

মেঘের ঘনঘটায় কেউ কেউ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে এহসান ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘মৌলি সাঁতার জানিস?’ আমি ‘না’ বলতেই এহসান ভাই চিৎকার করে উঠেছিলো, ‘নৌকো ফে-রা-ও...!’ নৌকো ফেরাবে কি? ততক্ষণে আমরা বুড়িগঙ্গা সেতুর একেবারে ওই পাশের গোড়ায় পৌঁছে গেছি। ভারী মেঘের শঙ্কায় নয়, নৌকো কূলে ভেড়ার উন্মাদনায় সবাই হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে পড়ে গেলো কেউ কেউ। কিন্তু আমার পড়ি পড়ি অবস্থা ঠেকাতে গিয়ে এহসান ভাই একেবারে বুকের ভেতর মাখামাখি করে ফেলল আমাকে। অথবা আমি তার শার্ট ওভাবে খামচে না ধরলে নদীতে পড়া থেকে রক্ষা পেতাম না হয়তো।

নিজেকে টেনেটুনে ঠিক করতে করতে ভীত, আড়চোখে দেখে নিলাম, কে কীভাবে তাকাচ্ছে। দেখলাম, আর কারো সময় নেই এ নিয়ে মাথা ঘামানোর। সবাই নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। কেউ কেউ গরম পুরিওয়ালার চারপাশ আগেভাগে দখল করতে গেড়ে বসে পড়লো চুলোর কাছের নড়বড়ে বেঞ্চিতে। কিন্তু ভাইয়াকে ভয় পেতাম বলে আমার আর ওখানে ওদের সাথে ওরকম তৎপরতায় মাততে সাহস হয়নি। যদিও সময় মতো বুঝেছি, ভালোও সে আমাকে কম বাসে না।

আমাকে নিয়ে বিয়ের ভাবনা আমার মা’র শুধু ক’দিনের নয়, বহুদিনের। স্কুল থেকে শুনতে শুনতে ভার্সিটিতে ঢুকেছি। ভাইয়া আমার থেকে ছ’বছরের বড়। তবু আজও তার সঙ্গে সম্পর্কটি তেমনই আছে। ভাইয়া তখন মাঝে মাঝে বলতো-তোর যদি একটা প্রেমও থাকত, তাহলে তাকে ধরে এনে তোকে গছিয়ে দেয়া যেত। আমার পথ পরিষ্কার হতো। লোপাকে ওদের বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে। কিন্তু মা তোকে বিদেয় না করে ঘরে বউ তুলতে দেবেন না। বাগড়া দেয়ার মতো আত্মীয়-স্বজনের ও তো অভাব নেই!’ আমি বলতাম, প্রেমে পড়ার বয়সে তো পাহারা দিয়ে রেখেছিস! ব্যক্তিত্ব ফলাতে গেলে তো আর প্রেম হয় না! দিনে দিনে সে সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ। কারণ এখন মনে হয় সবার ভেতর ভেজাল। অথচ আগে সবাইকে কেমন ইনোসেন্ট মনে হতো, জানিস! যেন হাত বাড়ালেই প্রেম...।

আমাদের ফিরতে রাত হয়েছিলো। তবে নৌকায় করে আর ফিরিনি। সেতুর ওপারে থেকে এপারে দ্রুত হেঁটে এসে যে যার মতো থৈ থৈ মেঘগলা তুমুল বৃষ্টির আশঙ্কা মাথায় করে রিকশা ও ট্যাক্সি করে ফিরেছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য, অমন থমথমে আকাশ থেকে সেদিন ভারী বর্ষণ হয়নি! শুধু দু-একটি ফোঁটা হঠাৎ কপালে, মাথায় তালুতে পড়ে আমাদের আহ্লাদিত করে রেখেছিলো। অবশ্য একজনকে মহাসঙ্কটে রেখে। ভেবেছিলো, এহসান তার কিঞ্চিৎ বাগদত্তাকে না নিজের দিকে ফেরায়! যদিও ভাইয়া আমাদের সাথেই ছিলো। সেদিনের সেই সন্ধ্যার আসন্ন মেঘ আমাদের অযথাই শঙ্কিত রেখে কোথায় গিয়ে ভেসেছিলো আজো আমরা তা কেউ কেউ ভাবি! বৃষ্টির অমন আশঙ্কায় না থাকলে একত্রিত হওয়া আমাদের আনন্দ আয়োজন আরো অনেকক্ষণ চলতে পারতো। আবারও ফিরতে পারতাম নৌকোয় করেই।

আমি এহসান ভাইকে বলেছিলাম, ট্যাক্সি চড়তে আমার ভালো লাগে না। রাত যত হোক, পথ যত দীর্ঘ হোক, আমি হুড ফেলে রিকশায় যাবো। ভাইয়া না গেলে আপনি চলেন আমার সঙ্গে। শেষে উপায় না দেখে ভাইয়া আমার প্রস্তাব মেনে নিলো। এহসান ভাই আমাদের রিকশায় তুলে দিয়ে, তারপর নিজের পথ ধরেছিলো। ঝিকাতলা একটা মেসে থাকত এহসান ভাই। ভাইয়া যেখানে যেত, সম্ভব হলে আমাকেও নিয়ে যেত।

কতদিন দুপুরে ভাইয়ার সঙ্গে খাওয়ার সময়ে গিয়ে পড়লে, আমাকে দিয়ে শাক রান্না করানোর ছল করে না খাইয়ে আসতে দেয়নি। বিকেলের গড়াগড়ি রোদে কতদিন তিনজনে মিলে আমরা নিউ মার্কেটের ভেতর, লালবাগের কেল্লা, বা রমনা পার্কে, আরো অনেক জায়গায় অনেকক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটিও করতাম। ক’দিন এহসান ভাইদের রান্নার লোক ছিল না। মেসের সবাই রান্না শেখার কসরত চালাচ্ছিলো। রান্নার নামে হুলুস্থুল কা- চলতো ওদের। শেষে আমাকেই তরিয়ে নিতে হয়েছে সেই একবেলাও। অবশ্য ওখানে পাঁচতলার ছাদের দু’রুমে বসবাস করা চারজনই ছিলো ওরা বন্ধু। কমবেশি ওদের সবারই আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিলো।

আমার ভাইয়া লেখাপড়ায় তুখোড় হওয়ায় সে তার বন্ধুদের মধ্যমণি ছিল। কিন্তু ভাইয়া এহসান ভাইকে পছন্দ করতো সবচেয়ে বেশি এবং ওকে ভাইয়ার মতো অনেকেই পছন্দ করতো। এহসান ভাইয়ের যেকোনো সিদ্ধান্ত সবাই নির্বিবাদে মেনে নিতো। এহসান ভাইয়ের সঙ্গে মুশফিকের নীরব দ্বন্দ্ব এজন্যই। আর সেটা জিইয়ে রাখতেই বুঝি মুশফিকের শেষ পর্যন্ত আমাকে বেছে নেয়া। কারণ তাদের সবার সম্পর্ক আজো অটুট আছে। দুরত্বের কারণে যারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারে না, কাছাকাছি হলে সেটুকু পুষিয়ে দেয়।

তাই মুশফিকের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে প্রায়ই সেই অন্যান্যদের সাথে পেয়ে যাই নিজের ভাই ভাবীকেও। শুধু এহসান ভাই ছাড়া। আর অন্য বন্ধুদের বাড়ির আড্ডাতে মুশফিক সময় থাকলে অবশ্যই যায়। তবে সুযোগ পেলে আমাকে দেশে বিদেশে বেড়াতে নিলেও, কখনোই কোনো বন্ধুর বাড়ির আড্ডায় নয়। আর তা কেন নয়, তাও আমাকে কৈফিয়ত দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না মুশফিক। কিন্তু আমি জানি কেন। চলবে....

 

দীলতাজ রহমান
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top