সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

এক চিলতে রোদ : ড. মীনা মুখার্জী


প্রকাশিত:
২৪ জানুয়ারী ২০২০ ১১:১৩

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:০৭

 

বাইরে ব্যস্ত হাওয়ার চপল ডাক,আনীল আকাশে মেঘেদের দিনান্ত ভ্রমণ,খোলা আকাশে মেঘেদের নীরব পায়চারি আবার কখনও বা ইশারায় ডাক,হয়তো বা কথা বলা পাখিদের সাথে৷কি সুন্দর বসে আছে তারা ন্যাড়া মহুলের ডালে!বুঝিবা মেঘের ইশারা বুঝল তারা জনান্তিকে৷
টানটান বিছানায় শুয়ে খোলা দরজার ফাঁকে বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘেদের মন্রণার বিভিন্ন আকার৷পাখিদের দেখাদেখি আমারও মস্তিষ্কে যেন রক্তক্ষরণ—কোনও অভিপ্রায় মাথা চাড়া দেয়—যদিবা ফুঁ মন্তর ছুঁড়ে দিয়ে আকাশের বুক থেকে ছুঁয়ে ছেনে আনা যায় অমৃতময় বৃষ্টির আশ্চর্য শান্তির স্বচ্ছ জল৷

 "তখন তৃষিত প্রেম"
"ঠিক তখনই এক চিলতে মিস্টি রোদ
নেমে আসে পায়ে পায়ে,নিবিড়    অন্তরঙ্গতায়!"——
স্বপ্নের মত পসরা সাজিয়ে চলে গেল আরও সপ্তাহ দুই৷তারপর??
রক্তপ্রবাহে তখন তৃষিত প্রেম যেন প্রায়শ্চিত্ত্য সেরে একমুঠো আলো চায়—অন্তরের নিবিড় তাগিদে৷তারপর সেই একবুক যন্ত্রণা নিয়ে বহুকাল জাগা৷চোখে ঘুম নেই৷কেউ বলেনা আর "এত রাত জাগা?আর না ,চলো এবার শুতে চলো৷শরীর ভেঙ্গে যাবে যে!"ডাকে শুধু  অন্ধকার আর গভীর নীরবতা!ওৎ পেতে চেয়ে আছে খোলা জানলাটা৷কিছু জোনাকির দাপাদাপি বুকের অন্ধকারে৷আচমকা জ্বলে ওঠে অতীতের স্মৃতি৷উপেক্ষিত প্রেমের বিরৎ যন্রণা এখনও বুকের পাশে টনটন করে৷বোবা কান্নারা মনকে ঝাঁঝরা করে ফেলছে৷অনুভবগুলো তীব্র দাহে মরুভূমিতে যেন শুষ্ক বারিবিন্দু!
বিষাদে যন্ত্রণায় আত্মহত্যার কথা ভাবি৷আর ঠিক তখনই অরূপ তার অপরিমেয় আনন্দরাশি চোখের সামনে ঝুলিয়ে আমাকে লোভাতুর করে৷চমকে উঠে আমি বিচার করতে বসি মর্ত্ত্যের অমৃত ছেড়ে
হতভাগা আমি কোন্ নরকের বিষপানের কথা ভাবি!আর ঠিক তখনই বাঁচার আনন্দে উদ্বেল হয়ে পুরনো হিসাব নিকাশ নস্যাৎ করে দিই;ধূর যাঃ,ব্যর্থ প্রেমের ছন্নছাড়া স্মৃতিরা ছারখার হ 'বিষম অগ্নিদাহেরে'— আর মজা কা জানো অরূপ—ঠিক যেন স্বপ্নের পসরা হাতে তুমি বলে ওঠো—"আরে!আমি তো এই খানেই—সেই কৃষ্ণচূড়ার শিরীষ শাখে বসে তোমার প্রেমের প্রগাঢ়তা মাপছিলাম৷"
          বাইরে নিস্তব্ধ চরাচরে ঝিঁঝিঁ পোকারা আমার সাথী হয়ে আনন্দগান গাইতে থাকে,মহুলের ডালের জোনাকি গুলো আমার কানে নতুন করে বাঁচার মন্র শুনিয়ে আনন্দ-দীপ শিখাটিকে জ্বালায় দপদপ  করে!আমি আবার নতুন ভোরে মৌমাছিদের আনন্দ-কাহিনী শোনার অপেক্ষায়!

"মাতাল স্মৃতিরা ও মদির অপেক্ষায়"                      
        
এই তো সেদিন ছোট মামার মৃ্ত্যুর পর  সব ভাইবোনেরা একসাথে হওয়ায় পুরনো বাড়ীর গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছিলাম,সেই আমড়াতলা,সেই চাতাল,সেই শান বাঁধানো পুকুর-ঘাট,আঙিনা,দিদিমণির আচার-পাঁপড় শুকোনোর প্রিয় ঝুল বারান্দা,বৈঠক খানায় হরিণের শিং,রবীন্দ্রনাথের সেই লাইভ ছবি খান,দাদুর তানপুরা,বাঁশি ,বেহালাদি;কত স্মৃতি বিজড়িত বাঁশ বনের ধারে দাদুর চিলে কোঠাটির হাতছানি,স্নিগ্ধ বাতাসের অফুরান মুগ্ধতা!স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে কত চিত্রকল্প,হৃদয় ছুঁয়ে যায় এলোমেলো কত সুর,সে সুরের তানে কখনও বা চোখের কোণে বর্ষিত হয় সন্তপ্ত অশ্রুর প্লাবন,নিথর নিঃশব্দ রাতের ধ্যানানিমগ্ন অন্ধকারে —দেখি দাদু এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে —"সোনা দাদা পারবে কি......?"হঠাৎ অনাবিল সে স্পর্শে সুখের কাতরতা!মোহময় স্বপ্নালু চোখে আকাশচুম্বী আকাঙ্খার বিপুল বিস্তার—ঝুল বারান্দার গ্রিলের সে রঙীন স্বপ্নেরা  অপেক্ষায়!অলৌকিক বার্তালাপ শেষে সে অফুরান ভাল লাগারা জেগে থাকে জনমভোর৷
...........খুঁজেই চলেছি আজও আমি মায়ের নিবিড় সে কোল!শিশুত্বে ফিরে যেতে চাই মাগো!চুলের বিলি কাটা নখের সে ভিতরে৷কতকাল চুমোর গন্ধ আঁকড়ে আমি ধুইনি কপালের এ ভাঁজ৷চড়াই পাখিদের সাথে জোড় শালিখটাও ইলেকট্রিকের তার পেরোচ্ছে৷মহুলের ডালগুলো কিশলয় ও কুসুমের অপেক্ষায় ন্যাড়া৷পরিযায়ী পাখিরা উড়ে চলেছে দখিনের পথে,বসন্ত বাতাস খোঁজে!হয়তো বা প্রেমের অপেক্ষায় শুভ শালিখেরা!

 "এবং অপেক্ষায়"

          দুরারোগ্য ক্যান্সারাক্রান্ত পিসী মৃত্যু শয্যায় যখন করুণ দিনাতিপাত করছেন তখন হয়তো বা মৃত্যুর হাতছানি টের পেয়ে সরবে ডাক দিলেন আমাকে—
           —"বৌমা আমার ব্যাগখান আনোতো৷"
সেখানি হস্তগত হলে কম্পিত হস্তে পন্জ্ঞিকা দেখে নাতির পৈতের দিন স্থির করলেন৷তারপর ব্যাগ থেকে কাশ্মীরি শাল ,কাঁসার থালা,বাটি,,পাঁচ টাকা,ও একটি রুপোর কয়েন পরিপাটি সহকারে রেখে থালখানিতে ফল ও আতপ চাল সাজিয়ে দিতে নির্দ্দেশ দিয়ে আদরের দাদুভাইকে ডেকে আর্শীবাদ করে  নাতিকে দ্বিজত্বের সম্মান প্রদর্শন করে মাধুকরী দান করলেন———
           পিসীর দু'চোখে তপ্ত অশ্রুধারা!......
           করুণ চোখে তাকালেন মাথার একপার্শ্বে সুসংরক্ষিত তাঁর মনে না থাকা ৯ বছর ১০ মাস বয়সের হৃত প্রয়াত স্বামীর প্রতিকৃতির দিকে৷
স্তূপীভূত শ্রান্তির পাহাড় বেয়ে দূরের ধূসর কুয়াশার ঝাঁক যেন এগোলো খানিকটা,বক্র হাসি মেখে গুটি গুটি পায়.....
           দিন কয় পরে বাল্যবিধবা সতী সাধ্বী পিসী শেষ দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন তাঁর ছোটভাই ও ভাসুরপোকে৷ভাইকে দেখার ইচ্ছে অপূর্ণ থাকল কিন্তু 'ভাগ্যমন্তী' সাধ্বী রমণী 'সুখী পিসীর' শ্বশ্রূ। 

 

ড. মীনা মুখার্জী
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top