সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে অগ্নিঝরা মার্চ মাসের প্রভাব : টুটু রহমান


প্রকাশিত:
১৩ মার্চ ২০২০ ১৬:২৯

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:২৫

 

বঙ্গবন্ধু, বাংলাভাষা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংগ্রামের ইতিহাসে মার্চ মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রভাব অনস্বীকার্য। এই মাস যেমন বঙ্গবন্ধুর জন্মের কারণে বাঙালি জাতির জন্য আনন্দ ও স্বপ্ন সুখের, তেমনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল রাজপথে পুলিশি নির্যাতন গ্রেফতার ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে গণহত্যায় জাতির রক্তক্ষরণ সীমাহীন কষ্টের। অন্যদিকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে জাতি আশান্বিত ঐক্যবদ্ধ এবং মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবর্ননীয় দুঃখ বেদনা ও অগণিত শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বাঙালি জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক মাইল ফলক ও অগ্নিঝরা মাস।

মার্চ মাসের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহঃ
১৭ মার্চ ১৯২০ সাল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম, যাঁর জীবন প্রবাহের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

স্বাধীন পাকিস্তানের শাসনামলের কিছুকাল পরেই অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে পূর্ব বাংলায় তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার ব্যবহারের দাবি জানায়, তাঁর দাবি অগ্রাহ্য হলে ধর্মঘট পালিত হয়। ২মার্চ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে "সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ" পূণর্গঠিত হয়।

১১ মার্চ "বাংলা ভাষা দাবি দিবস" পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ঐদিন সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এ কর্মসূচি পালনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। পিকেটিং করা অবস্থায় শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করলে ঢাকায় ১৩ থেকে ১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন।

২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন, "উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা" । ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনেও তিনি অনুরূপ ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে এবং 'না, না' বলে তার উক্তির প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের উদ্যোগ নিলে প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়। পূর্ব বাংলায় ভাষাকেন্দ্রিক যে আন্দোলন শুরু হয় তা ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থার বহির্প্রকাশ। ১৯৪৭ সালে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালে প্রতিবাদ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপ লাভ করে। এ আন্দোলন বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য ও স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তুলে। পাকিস্তানি শাসনপর্বে এটি তাদের জাতীয় মুক্তির প্রথম আন্দোলন।

২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেন। ইয়াহিয়া খান উক্ত পদে আসীন হন। তিনি ২৮ মার্চ তারিখ এক ঘোষণায় পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। অবশেষে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন ও ৬ দফার পক্ষে গণরায় লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করে। ১ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।

২ মার্চ এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ২ মার্চ ১৯৭১ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আ,স,ম আব্দুর রব। ৩ মার্চ ১৯৭১ সালে পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন শাজাহান সিরাজ। ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণে জনগণকে মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ২৫ মার্চ নিরস্ত্র জনগণের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী "অপারেশন সার্চ লাইট" নামে পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। বাঙালিরা এই গণহত্যার বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ায় এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক একটি দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়।
জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু।

 

টুটু রহমান
সাবেক উপ-পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top