সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বুকটা শূন্য হয়ে উঠছিল : মীম মিজান


প্রকাশিত:
৯ এপ্রিল ২০২০ ২২:৩০

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:১২

মীম মিজান

 

সবার ভেতর একধরনের উৎসব আমেজ। প্রায় মাসখানেক পরে নিজদেশে ফেরা হবে। চোখগুলি তাই আনন্দে চিকচিক করছিল। এইতো এখান থেকে সোজা যাবে ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট। তারপর ইমিগ্রেশনের ঝামেলা চুকিয়ে বিমানে চড়ে ইরানের আকাশ দেখতে দেখতে চলে যাবে চিরপরিচিত দেশ, মা, মাটি, মানুষের কাছে।

২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষান্ত। মাসব্যাপী ফারসি ভাষা কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে দুপুরবেলা। গ্রুপ ফটোসেশন হয়েছে। আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছবি তুললাম। যেন একটি বৃন্তে অনেক কুড়ি। সন্ধ্যে হয়েছে মাত্র। আমার খাবগাহ(হল) থেকে বাংলাদেশী এগারজনের পাঁচজন এগিয়ে গেলাম বানাত খাবগাহর দিকে। ইংল্যান্ড আর ভেনিজুয়েলা থেকে যারা এসেছিল তারা এখন চলে যাচ্ছে। আমরা তাদের লাগেজ গাড়িতে তুলে দিয়ে সহযোগিতা করব। তাদের একটু এগিয়ে দিব। বিদায় জানাব। কী সহাস্যমুখ সবার! কোলাকোলি করছে। বলছে, 'জান, ইমেইল বেকুন!'(প্রিয়, ইমেইল কোরো)।

বিশ্বের সাতাশটি দেশের ১২১ জন শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইরানের কাজভিন প্রদেশের ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছিল ৭৯তম ফারসি ভাষার কোর্স। আমরা বারোজন বাংলাদেশী ছিলাম। ছিল ভারত, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, রাশা, তার্কি, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, আজারবাইজান, জর্জিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ইত্যাদি দেশের ১০৯ জন।

বাংলাদেশী একজন মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল। যে অন্যান্য নারী শিক্ষার্থীদের সাথে খাবগাহে বানাত বা মহিলা হলে থাকত। আমরা হলে বা আবাসিক এলাকায় থাকতাম। আবাসিক এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কিলো দু'য়েক দূরে অবস্থিত। বাসে করে যেতাম। ইরানের ঐতিহাসিক কত যায়গা ঘুরেছি একসাথে। সিনেমা দেখেছি। গল্প করেছি। ফুটবল, হ্যান্ডবল খেলে ক্লান্ত হয়েছি। বাজার করেছি। বই কিনেছি। আড্ডা দিয়েছি। জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা সময় কাটিয়েছি সেখানে।

কত সৌজন্যবোধ ঐসব শিক্ষার্থী বন্ধুদের ভেতর দেখেছি। পেয়েছি নিজেকে বিশ্বমানব করার দীক্ষা। কখনো ঘুণাক্ষরেও মনে উদিত হয়নি যে তাদের থেকে আলাদা হবো। আনন্দ, উচ্ছ্বাস যেন হুটোপুটি খেত আমাদের মাঝে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির মানুষ ছিলাম। ছিলাম ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের। তবুও কী বন্ধুপ্রীতি ছিল পরস্পরের ভিতর।

শুধু একজনই একটু ঝামেলা করতো। নাম তার চন্দ্রগুপ্ত ভারতীয়া। রিলেটেড ফারসি পড়া বডি বিল্ডো চন্দ্র ছিল নিরামিষভোজী। খেতে বসে তার বিরক্তির একশেষ। 'ইনজা হামিয়ে গুশত আস্ত! মান চে মিখোরাম!'(এখানে সবকিছুতেই গোসত। আমি কী খাব!) কোর্সের মাঝামাঝি সময়ে তাই চন্দ্র ভারত অভিমুখে যাত্রা করেছিল।

আগেই আমাদের রিটার্ন টিকেট করাই ছিল যা ছিল সবার শেষে ফেরার তারিখের। ভেনিজুয়েলা আর ইংল্যান্ডের বন্ধুদের বিদায় জানাচ্ছে অনেকে। হাসছে। আর হঠাতই আমি দৌড় শুরু করেছি আমার খাবগাহর দিকে। প্রায় সবাই খাম্বিত। 'চে শুদ অগা? চেরা দাবিদি?'(কী হলো জনাব? দৌড়াচ্ছেন কেন?)

আমি তাদের কথায় কোন কর্ণপাত করিনি। একদৌড়ে হলে আসি। আমার চোখথেকে নোনাজলের ধারা ঝরে সান্ধ্যকালীন আঁধারের সমীরণে মিশেছে। তারপর বিছানায় ধপকরে শুয়ে বালিশে মুখগুজে হু হু করে কেঁদেছি। আমি পারিনি তাদের বিদায় জানাতে। আমার বুকটা শূন্য হয়ে উঠছিল তাদের যাওয়া দেখে।

 

মীম মিজান
লেখক ও সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top