বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রনব মুখার্জি চলে গেলেন মহাজীবনের ডাকে : মাহবুবুল আলম
প্রকাশিত:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৫৬
আপডেট:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৫৯
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ‘ভারতরত্ন’ প্রণব মুখার্জি আজ ৩১ আগস্ট ২০২০ বিকাল ৫ টায় দেহ ত্যাগ করে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। করোনা পজিটিভ নিয়ে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ৯ আগস্ট বাড়ির বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পান প্রণব মুখোপাধ্যায়। তারপরই দিল্লির কনটেনমেন্ট সেনা হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। করোনা পরীক্ষা করানো হলে পজেটিভ রিপোর্ট আসে। মাথায় অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। তারপর থেকেই কোমায় আচ্ছন্ন ছিলেন প্রণব মুখার্জি।
এক সময়ের ভারতীয় জাতীয় রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভ প্রণব মুখার্জির প্রয়াণে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমেছে এসেছে। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত নেতা হলেও বিরোধীদের সাথেও সম্পর্ক খুবই আন্তরিক ও গভীর। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। কেবল তা ই নয় এমনকী দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের রাজনৈতিক মহলেও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল সমান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭৫-এর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়োগান্তক হত্যাকান্ডের পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও রেহানাকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। তাদের দুঃসময়ে তিনি তাদের খোঁজখবর রাখতেন এবং যেকোন প্রয়োজনে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফেরার পরও প্রণব মুখার্জির সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক বন্ধ শেখ হাসিনা ও রেহানার অভিভাবক।
প্রনব মুখার্জির মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এক শোকবার্তায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেন, "প্রণব মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রণব মুখার্জির ভূমিকা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত তৈরীতে তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রণব মুখার্জির মৃত্যু উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক অপূরণীয় ক্ষতি।"
বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রনব মুখার্জির মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন।
শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রীর বলেন, ‘ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনীতিক, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি- এর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করছি।
প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান ও স্মৃতিকাতর হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণব মুখার্জির সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও শেখ হাসিনার নিজের বহু স্মৃতি প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন।
শোকবার্তায় শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হবার নয়। আমি সবসময় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারালো একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারালো একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।’
জি-নিউজের সৌজন্যে প্রাপ্ত মুখার্জির সংক্ষিপ্ত জীবনী এখানে তুলে ধরা হলো : জন্ম ১৯৩৫ সালে ১১ ডিসেম্বর। বাবা কামদা কিঙ্কর মুখোপাধ্য়ায় ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্যও ছিলেন। সেই সূত্রেই প্রণবের রাজনীতির হাতেখড়ি ঘর থেকেই।
১৯৬৯ সালে মেদিনীপুর বাই ইলেকশনে প্রচারের জোরে প্রণব মুখোপাধ্যায় একা হাতে জিতিয়ে দিয়েছিলেন ভি কে কৃষ্ণ মেননকে। তারপরই ইন্দিরা গান্ধীর নজরে আসেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কার্যত ইন্দিরা গান্ধী হাত ধরেই জাতীয় কংগ্রেসে প্রবেশ তাঁর। তারপর ১৯৬৯ থেকে ২০০২ টানা রাজ্যসভার সদস্য বাংলার প্রণব মুখোপাধ্যায়। ইন্দিরা ঘনিষ্ঠ প্রণব মুখোপাধ্যায় ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা ক্যাবিনেটের কেন্দ্রীয় ডেপুটি শিল্প উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন।
১৯৭৫-৭৭ যখন দেশে এমারজেন্সি তখনও ইন্দিরা ক্যাবিনেটে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে দেশে ক্ষমতা বদলের পর "জনতা সরকার" শাহ কমিশন নিযুক্ত করে সেখানেও নাম জড়িয়েছিল তাঁর। ১৯৭৯ সালে রাজ্য়সভায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ডেপুটি নেতা হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৮০ সালে জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্যসভার প্রধান নেতা।
১৯৮২ থেকে ৮৪, একাধিক ক্য়াবিনেট পদের পরে অর্থমন্ত্রী হন প্রণব মখোপাধ্যায়। তাঁর আমলেই ভারতের প্রথম IMF লোনের শেষ কিস্তি চুকিয়েছিল ভারত। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে মনমোহনের নিযুক্তিপত্রে সই করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়।
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি রাজীব গান্ধীর থেকে অনেক অভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব নিয়েছিলেন ইন্দিরা পুত্র। রাজীব আমলে ক্যাবিনেট থেকে বাদ পড়েন তিনি, তাঁকে পাঠানো হয় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সামলাতে।
১৯৮৬ সালে নিজের দল প্রতিষ্ঠা করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। নাম দেন রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। তিন বছর পরেই ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর মধ্যস্থতায় ফের জুড়ে যায় দুই কংগ্রেস। ঘরওয়াপসি হয় তাঁর। পরে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তাঁর উত্তর ছিল, "৭, আরসিআর কখনওই আমার গন্তব্য ছিল না।" ৭ আরসিআর প্রধানমন্ত্রী বাসভবনের ঠিকানা।
রাজীব গান্ধী মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে ফের বদল আসে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে। নরসীমা রাওর আমলে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসাবে ইন্ডিয়ান প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন প্রণব মুখোপধ্যায়। নরসীমার সময়েই ১৯৫৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিদেশমন্ত্রকের দায়িত্বভার সামলেছেন তিনি।
সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সারা ভারত জাতীয় কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০০০ সালে ফের পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হন প্রণব তিনি। তারপর টানা ১০ বছর বহাল ছিলেন এই পদে। জঙ্গীপুর লোকসভা থেকে জিতে ২০০৪ সালে লোকসভার নেতা হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০০৯ সালে ফের সেই কেন্দ্র থেকে জেতেন তিনি। ২০০৪ সালেই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস থেকে প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন।
মনমোহন জমানায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতর সামলেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রতিরক্ষা, ফের অর্থ এবং বিদেশ মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ২০১২ সালে সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে রাষ্ট্রপতি ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই মেয়াদ শেষ হয়।
পরিশেষে বলতে চাই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জি মৃত্যুতে আমরাও গভীর শোকাহত। ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান ও আইনে মাস্টার্স শেষ করে কলেজ শিক্ষক আর সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের প্রতিভাগুণে তিনি নিজেকে তুলে এনেছিলেন রাজনীতির শীর্ষে, নির্বাচিত হয়েছিলেন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে কেবল রাজনৈতিক অঙ্গন নয়, গোটা ভারতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এমন একজন সৎ, নির্ভেজাল ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের অভাব সহজেই পূরণ হবার নয়।
তাঁর বিদেহী আত্মা পরম চিরশান্তিতে থাকুক।
বিষয়: মাহবুবুল আলম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: