সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

ভরতখালি কাষ্ঠ মন্দির ও হাড্ডিসার কাচারি বাড়ি : মীম মিজান


প্রকাশিত:
৭ নভেম্বর ২০২০ ২১:৪৪

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ২১:২৩

ছবিঃ মীম মিজান

 

গতবছর ২৭ সেপ্টেম্বর রোজ শুক্রবার দেখতে গ্যাছিলাম বাংলাদেশের সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান গাইবান্ধার সাঘাটায় অবস্থিত শ্রী শ্রী জয় কালী মন্দির। মূলত একটি সাহিত্য সম্মেলনে  যোগদানের জন্য যাওয়া। ফাঁকে শিশুসাহিত্যিক মির্জা নুরুন্নবী নূর এর আমন্ত্রণে ঐতিহ্যের গহীনে ঢুঁ মারা। বালাসী ঘাট, ফ্রেন্ডস সেন্টার ঘুরে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে সিএনজি করে গাইবান্ধা সদর থেকে ভরতখালি যাওয়া। যমুনার বাঁধ দিয়েই উপস্থিত হলাম ভরতখালি। তখন শরতের আকাশ মেঘ হতে খালি। সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে আপন মহিমায়। ভ্যানে করে পুবের যাত্রী হয়ে সাঘাটা অভিমুখী রাস্তার খানিক যেয়েই মন্দিরের গেটে নামলাম।

এই কালী মন্দিরটি যেমন বিখ্যাত তেমনই নানা জনশ্রুতি বা কথিত ইতিহাসের আখ্যানে কিংবদন্তি তুল্য। এলাকার লোকজনের কাছে এটি 'কাষ্ঠ কালীর মন্দির' নামেও পরিচিত। অবশ্য কাষ্ঠ কালী নামকরণের একটা যৌক্তিকতাও আছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভিতরে কথিত ইতিহাসে আছে যে, যমুনা নদীর শাখা নদী ঘাঘট তখন স্রোতস্বিনী ছিলো। সেই স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলো একটি কাঠ। জনৈক কাঠুরে সেই কাঠটিকে ধরে তীরে এনে জীবিকার জন্য খড়িতে রূপান্তরিত করতে কুঠার দিয়ে কোপ দিলে কাঠ থেকে রক্ত বের হতে থাকে। ভয়ে আবার তা ঘাঘটের বক্ষে ভাসিয়ে দেয় কাঠুরে। ঘটনাটি এলাকাবাসিকে আতঙ্কিত করে এবং সেই খবর ভরতখালি জমিদার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায়। সেদিন দিবাগত রাতে জমিদার রহীনি কান্ত রায় স্বপ্নে 'কালী'র সাক্ষাৎ পান এবং স্বপ্নে জানতে পান, জমিদার বাড়ি থেকে সাত মাইল দুরে ঘাঘট নদী তীরে কাষ্ঠখন্ড রূপে 'কালীমাতা' জলে ভাসছেন। জমিদার বাড়ীতে নির্মিত মন্দিরে পূঁজার্চনার মাধ্যমে জাগ্রত হবেন বলে ইচ্ছা পোষণ করেন কালী। স্বপ্নে পাওয়া আদেশ না মানলে জমিদারের সমূহ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। তাই স্বপ্ন অনুযায়ী জমিদার রহীনি কান্ত ঢাঁক-ঢোঁলের সমারোহে ঘাঘট বক্ষ থেকে কাঠখণ্ডটি তুলে এনে বর্তমান মন্দিরটি যেখানে সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে মন্দিরটির নাম 'কাষ্ঠ কালীর মন্দির'। আবার এটি 'ভরতখালি কালী মন্দির' নামেও পরিচিত।

আমি এই মন্দিরের সেবায়েত ও সেক্রেটারি পঁচাত্তর বছর বয়সী অশোক কুমার সিনহার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তারা বংশ পরম্পরায় এ মন্দিরের সেবায়েত। তার চাচা ছিলেন বিজ্ঞ পণ্ডিত মানুষ। তিনিও চেষ্টা করেছিলেন এটির সঠিক ইতিহাস উদঘাটনে কিন্তু সক্ষম হন নি। সিনহা বাবুও উপরোক্ত কিংবদন্তি শুনালেন। তিনি আরও জানান যে, কালীর মূর্তিটি নিয়ে এলাকায় তার সময়কার বয়স্ক মানুষদের মধ্যে নানা মতামত শুনেছেন। অনেকেই মনে করতেন যে, সরাসরি কাষ্ঠখন্ড থেকেই কালীর আবির্ভাব হয়েছে বলে কাষ্ঠকালী নামে পরিচিত। আবার কেউ কেউ মনে করতেন যে, কাষ্ঠখন্ডটি খোঁদাই করে কালীর শুধু মুখ মণ্ডলটি তৈরি করা হয়েছে এবং দেহটি লোহার রড দিয়ে তৈরি। আবার অনেকেই বলতেন যে, প্রতিষ্ঠিত কাষ্ঠখণ্ডটি থেকে পাইকড়ের(পাকুড়) গাছের জন্ম হয়, সেই পাইকড় গাছের শেকড় থেকেই কালীর আবির্ভাব হয়েছে। বিষয়টির যৌক্তিকতাও মেনে নেয়া যায় যে, কালী মন্দিরের উত্তর পশ্চিম কোণ সংলগ্ন বিশাল এক পাকুর গাছ আছে। সেই পাকুর গাছটির নিম্নাঞ্চল শান করা। পূণ্য প্রার্থী সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ বিভিন্ন প্রকার মানত করে এখানে। আলতা, সিঁদুর ও দুধে ভরে আছে পাকুরের নিম্নদেশ।

গাইবান্ধা-সাঘাটা রাস্তার সাথেই একটি উত্তরমূখী উঁচু  গেট। পঞ্চাশ মিটার ভিতরেই মূল মন্দির। মন্দিরের পশ্চিমে অবস্থিত একটি বিশাল স্কুল। মাঠ আছে ঘাসহীন। এখানেই গোহাট বসে। ছেলেদের দেখলাম ক্রিকেটে মত্ত। মন্দিরের পশ্চিমে চারতলা নির্মাণাধীন একটি ভবন। দূর দূরান্ত থেকে আগত পুণ্যার্থীদের জন্য। এটি সরকারি ও মন্দিরের যৌথ অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে। মন্দিরের মূল গেটের সামনেই টিন দিয়ে তৈরি শেড আছে। সেখানে বিশ্রাম নেয়া যায়। লাল রঙ দিয়ে মোড়ানো টিন শেড ঘর পশ্চিম ও উত্তরে। উত্তর দিকেই প্রধান ফটক। ফটকের উপরে টাইলসে কালীর ছবি। ভিতরে ঢুকলেই মাঝ বরাবর একটি গোলাকার লোহায় ঘেরা ঘর। পাঠা বলি দানের সরঞ্জামাদি আছে। এখানে কবুতরও উৎসর্গ করা হয়। এটি পশ্চিম দুয়ারি মূল কালী মন্দিরের দরজার কাছাকাছি। কালী মন্দিরটিতে কালীকে পূবের মুখে করে বসানো হয়েছে। ঠাকুর পশ্চিম দিকে মুখ করে পূজো করে। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে একতলা লাল রঙের ভবন। সেখানে দূরান্তের ভক্তরা যাপন করে। পূর্ব দিকেও একই রকম ভবন একই উদ্দেশ্যে নির্মিত। পুরো এলাকাটি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত।

মন্দির ও সংশ্লিষ্ট এলাকা ৭একর ২৮শতক জমিতে অবস্থিত। জমিদার রমনী কান্ত রায় তার বাবার প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরের জন্য এ জমি কালীর নামে লিখে দেন। তবে জমি নিয়ে নানা সময় লোভী ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন মন্দির সংশ্লিষ্টগণ। সেবায়েত সিনহা বাবুর ভাষ্যমতে, শুধু দেশের অভ্যন্তর থেকে নয় ভারত থেকেও অনেক ভক্ত আসেন। বিশেষ করে বৈশাখ মাসে। মাসব্যাপী মেলা বসে গোহাটের মাঠজুড়ে। মেলায় গ্রামীণ পণ্যের বাহারি পসরা সাজিয়ে বসেন বিভিন্নধরনের মৌসুমি ব্যবসায়ীগণ। জমিদার রমনী কান্ত রায়ের প্রচলিত প্রথানুযায়ী প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রথম শনিবার অথবা মঙ্গলবার থেকে এ মেলা শুরু করা হয়। মেলা উপলক্ষে শনি ও মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় পূজা আরম্ভ হয়ে পূজা ও চন্ডীপাঠ চলে। দুপুর ১টায় শুরু হয় পাঠা বলিদান।

আমরা যেহেতু শুক্রবার গ্যাছিলাম তাই তেমন পূজারির সাক্ষাৎ পাই নি। দ্যাখলাম ঠাকুরকে কালীর সামনে ধূপ কাঠি জ্বালিয়ে অর্চনা করতে। মূল ফটকের পূব দিকের ঘরগুলো সেবায়েত ও অন্যান্যদের জন্য। তারই সামনে চেয়ার পেতে বসে আছেন সিনহা বাবু। আমরা যেতেই উচ্ছ্বসিত বদনে এগিয়ে আসলো শাঁখা-সিঁদুর পরিহিতা পরিচ্ছন্ন কর্মী।

যারা ভ্রমণ পিয়াসু তাদের জন্য এ মন্দিরের পাশেই আরেকটি রমণীয় স্থান আছে। সেটি হচ্ছে এসকেএস নামক এনজিওর প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান কার্যালয়। মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম দিকে দু'মিনিট হাঁটলেই সবুজে ঘেরা যমুনার তীরে মনোরম পরিবেশের স্থানটি। ভিতরে অনেক প্রকার গাছ। অনেকগুলি খামার। এক ধরনের বীর সাইজের লাল মোরগের অভয়ারণ্য। কিন্তু এমনই বীর যে সীমানাজুড়ে কাটাতারের বেড়া উড়ে পেরুতে পারে না। এগুলো এদের ব্রাইডে তৈরি। দুগ্ধখামারভর্তী হাম্বা হাম্বা ডাক৷ লতায় ঘেরা দুটো মনোহরী সুরঙ্গ। এই সুরঙ্গ দু'টোই মূল আকর্ষণ। পাশেই মাছের খামার। ট্রেনিং সেন্টার। কাশফুল সমারোহের তীরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। মনো বৈকল্য দূর হবে। চাঙ্গা হবেন এখানের প্রত্যেকটি নিঃশ্বাসে।

ভরতখালি যে নামে এলাকাটির নাম সেই ভরতখালিতে একটি হাড্ডিসার কাচারি বাড়ি কালের সাক্ষী। হাড্ডি-গুড্ডিতে গজিয়েছে নানাপ্রকার আগাছা। লোকজন গোবর শুকিয়ে জ্বালানি করে। সেই জ্বালানিসহ অন্যান্য খোল-বাকল, কঞ্চি রাখার জায়গা বানিয়েছে কাচারি বাড়িটিকে। দু'টো ঠ্যালা গাড়ি বাড়ির সামনে। একি পরিহাস! য্যানো সেসময়কার টমটম ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে। জমিদারকে নিয়ে ঘুরে আসবে তার জমিদারী এলাকা মাড়িয়ে। আর ঐ জ্বালানি, খোল-বাকল মনে হচ্ছে জমির খাজনা স্তূপীকৃত। অথচ তাদের ইতিহাসের উপর গজিয়েছে ঘাস, লতাপাতা। এটিও ভ্রমণ পিপাসুদের ইতিহাসের মোড়ে নিয়ে উপস্থিত করতে পারে।।

 

মীম মিজান
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কলামিস্ট ও এম.ফিল. গবেষক
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top