সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৬ই মে ২০২৪, ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


বিশ্বস্ত কর্মচারীর হাতে নিউ আমিন জুয়েলার্সের ৬৮০ ভরি স্বর্ণ চুরি


প্রকাশিত:
১৯ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫৫

আপডেট:
১৬ মে ২০২৪ ১১:৩৮

বিশ্বস্ত কর্মচারীর হাতে নিউ আমিন জুয়েলার্সের ৬৮০ ভরি স্বর্ণ চুরি

চার দিন আগে রাজধানীর গুলশান এলাকার ডিসিসি মার্কেটের নিউ আমিন জুয়েলার্সের ৬৮০ ভরি স্বর্ণসহ ২২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা চুরি হয়। কিন্তু কে বা কারা চুরিটি করেছে তা গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত জানা যায়নি। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এলো সেই ঘটনার খুঁটিনাটি।



চুরির এ ঘটনায় জুয়েলার্সের মালিক যতটা না চিন্তিত ও বিস্মিত হয়েছেন, তারও চেয়ে বেশি অবাক হয়েছেন মূল চোরকে দেখে। কারণ চুরির ঘটনার মূল নায়ক তারই ১৮ বছরের বিশ্বস্ত নিরাপত্তাকর্মী মো. আব্দুস সোবাহান মোল্লা (৬১)।



পুলিশি তদন্তে প্রকাশ, অনেক দিন ধরেই এই চুরির পরিকল্পনা করে আসছিলেন মো. আব্দুস সোবাহান মোল্লা। তিনি এক রাজমিস্ত্রির সহায়তায় চুরিটি করতে সক্ষম হন। আর এ ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৪ এপ্রিল রাতে। ঘটনার পর থেকেই চোরদের গ্রেফতার করতে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চার দিন পরে গতকাল ১৭ এপ্রিল, মঙ্গলবার চুরির ঘটনার মূল নায়ক সোবাহানসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে গুলশান থানা পুলিশ। এ সময় চুরি হওয়া স্বর্ণের মধ্যে ৪৯৮ ভরি স্বর্ণ এবং ২০ লাখ ২৬ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।



 



 



গ্রেফতারকৃত অন্য ব্যক্তিরা হলেন—মো. আবুস সোবাহান মোল্লার স্ত্রী আলেয়া বেগম (৫১), তার মেয়ে মোছা. সীমা বেগম (২৭) ও মেয়ের জামাই মাদরাসা শিক্ষক হাফেজ মো. বিল্লাল হোসেন। তবে সোবাহানের সঙ্গী রাজমিস্ত্রি মো. সাদ্দাম মিয়াকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।



গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চুরির ঘটনার নাটকীয় কাহিনি।



যেভাবে জানা গেল চুরির ঘটনা



চুরির ঘটনার পরে নিউ আমিন জুয়েলার্সের ডিসিসি মার্কেটের এক্সিকিউটিভ শাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।



মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, পহেলা বৈশাখের দিন দোকানে বিক্রি শেষে রাত ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে সবাই চলে যান। দোকান বন্ধ করে যাওয়ার সময় সেদিন ক্যাশ বাক্সের ৪৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা রাখা ছিল। পরের দিন ১৫ এপ্রিল, রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় দোকানে কেউই আসেননি। পরদিন ১৬ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে আবারও নিউ আমিন জুয়েলার্সের দোকানটি খোলা হয়। দোকান খোলার ৪৫ মিনিট পর দোকানের ক্যাশ বাক্সে থাকা টাকার দিকে তাকালে অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এরপর টাকা গুনে দেখা যায় ৪৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকার মধ্যে থেকে ২২ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা নেই। এ সময় একজন ক্রেতাকে স্বর্ণের জিনিস দেখানোর সময় বাক্স খুলে দেখা যায় সেই বাক্সে স্বর্ণের জিনিসও নেই। তখন তাৎক্ষণিক কর্মচারীরা বিষয়টি মালিককে জানান। এরপর বোঝা যায় দোকানে চুরি হয়েছে। তখন হিসাব করে দেখা যায় যে, গলার হার ৩৬ পিস, কানের দুল ৩৬ জোড়া, টিকলি ১৭ পিস, নথ ৭ পিস, আংটি ১৫ পিস, মুকুট ২ পিস, মানতাসা ৩ পিস, ঝাপটা সাত পিস। সর্বমোট স্বর্ণ ও টাকাসহ প্রায় পৌনে চার কোটি টাকার চুরি সংঘটিত হয়।



 



 



এজাহারে আরও উল্লেখ করা আছে, ঘটনার পর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ তখন ঘটনাস্থলে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখে দোকানের ওপরের ছাদ কাটা। তখনই ধারণা করা হয় সেখান দিয়ে চোর এসে চুরি করে পালিয়েছে।



ছাদ ঢালাইয়ের নামে চুরির ফাঁদ



পুলিশের অনুসন্ধান ও দোকানের অন্য কর্মচারীদের কথামতো বেরিয়ে আসে চোর কীভাবে দোকানে এই চুরির ঘটনা ঘটিয়েছিল।



গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক প্রিয়.কমকে বলেন, ‘চুরির ঘটনার পরেই আমরা যখন ওই দোকানে তদন্তে যাই, তখন দোকানের ভিতরে ওপরে তাকিয়ে একটি  ছিদ্র দেখতে পাই। তবে সেটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। এরপর আমরা ভবনের ছাদে গিয়ে দেখি সেটা প্লাস্টার করে দেয়া। কিন্তু ওই প্লাস্টার খোলার পরে দেখা যায় সেখানে বিশাল একটি ছিদ্র করা ছিল, যা দিয়ে যে কেউ ভিতরে নামতে এবং বের হতে পারবে। তখন জানা যায়, মাত্র কয়েক দিন আগেই দোকানের মালিক ওই দোকানের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করেছিল। কিন্তু ছাদ ঢালাই করার পরেও পহেলা বৈশাখের বৃষ্টির সময় দোকানে পানি পড়েছিল। তখন দোকানের নিরাপত্তাকর্মী সোবাহান ওপরে দেখতে গিয়েছিল। সে ফিরে এসে জানায় তেমন কিছুই হয়নি, সামান্য সমস্যা, মিস্ত্রি ডেকে ঠিক করালেই হবে। কিন্তু সেখানে রাজমিস্ত্রি সাদ্দাম ও সোবাহান মিলে আগে থেকেই একটি বড় ছিদ্র তৈরি করে রেখেছিল। আর ছিদ্রটি যেন দেখা না যায় সে কারণে সেটার ওপরে তারা একটি ড্রাম দিয়েছিল। আর পহেলা বৈশাখের ওই রাতেই তারা সেই ছিদ্র দিয়ে নেমে গিয়ে দোকানের মধ্যে  থেকে স্বর্ণ ও টাকা চুরি করে।’



নিউ আমিন জুয়েলার্সের মালিক ডা. সিরাজুল ইসলাম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘দোকানের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ দেয়া হয়েছিল সাদ্দামকে। কয়েক দিন আগে সে কাজ শেষও করে ফেলে। তবে শুনতাম যে ছাদ থেকে পানি আসে নিচে। এই নিয়ে সাদ্দাম সোবাহানকে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় প্লাস্টারে মনে হয় একটু ঝামেলা হইছে, সেটা দ্রুত ঠিক করা হবে। কিন্তু তারা যে এভাবে চুরি করতে নিজেরাই ইচ্ছা করে এটা বানিয়েছিল সেটা এখন স্পষ্ট হলো।’



যেভাবে ধরা পড়ল চোর



গুলশান থানায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ খেয়াল করে এই দোকানের নিরাপত্তাকর্মী সোবাহানের দুই হাতে ও গায়ে চামড়া ছড়ে যাওয়ার দাগ। তখন পুলিশের সন্দেহ হয় ছাদে তৈরি করা গর্তের মধ্যে থেকে ভেতরে নামতে ও উঠতে গিয়ে এমন দাগ তৈরি হতে পারে। এরপর তারা সোবাহানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে প্রথমে সে স্বীকার না করলেও পরে চুরির কথা স্বীকার করে। তার দেওয়া তথ্যমতে স্বর্ণ উদ্ধার ও চুরির সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে মাঠে নামে পুলিশ। সোবাহানের দেওয়া তথ্য মতে গোপালগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাওয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে সোবাহানের স্ত্রী, মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে চুরি হওয়া স্বর্ণ ও টাকা উদ্ধার করা হয়।



পুলিশি অভিযান



অভিযানে অংশ নেওয়া গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ফেরদাউস প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সোবাহানের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সাদ্দামকে খুঁজতে আমরা বাগেরহাটের চিতলমারী গ্রামে যাই। তবে সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি । এরপর গোপালগঞ্জের নিলফা গ্রামে যাই; সেখানে থেকে সোবাহানের স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তার কাছ থেকে ২৫৩ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এরপর তার দেওয়া তথ্য মতে তাদের মেয়ে ও জামাইকে গ্রেফতার করা হয়।’                  



মিষ্টির প্যাকেটে স্বর্ণ



গুলশান থানার এক কর্মকর্তা জানান, ওই রাতে মার্কেটের সিসি ক্যামেরাতে কিছুই পাওয়া জায়নি। তবে ডিএমপির একটি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে যে মার্কেট থেকে বাইরের মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে সোবাহান ও আরও এক ব্যক্তি বেরিয়ে গেছেন। তার চুরির সঙ্গী সাদ্দাম ঘটনার কিছুক্ষণ পর মার্কেট থেকে বের হলেও তার হাতে কিছু ছিল না। অর্থাৎ সাদ্দাম হাতে করে কোনো প্যাকেট নিয়ে বের হননি। আসলে ওই মিষ্টির প্যাকেটেই ছিল চুরি করা স্বর্ণ ও টাকা। চুরি করার পর স্বর্ণ ও টাকা মিষ্টির প্যাকেটে ভরেই তিনি মেয়ে-জামাই ও স্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। পরে পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করে। তবে সাদ্দামের কাছে থাকা টাকা ও স্বর্ণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সাদ্দাম পলাতক।



 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top