সিডনী বুধবার, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১


প্রধান সম্পাদকের কথা

প্রভাত ফেরী হোক বাংলা ভাষা-ভাষী সকল লেখক ও পাঠকদের মিলন মেলা


প্রকাশিত:
২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫৪

আপডেট:
২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:১৯

ছবিঃ শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী

 

“ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ / দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়? / বরকতের রক্ত।

.........................

প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী / আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি/ জন্মেছি এই বঙ্গে।” (একুশের কবিতা, আল মাহমুদ)

আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদের উপরের কবিতার অনুপ্রেরণায় ২০১৯ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে ‘প্রভাত ফেরী’র নামকরণ এবং যাত্রা শুরু হয়। আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, ‘প্রভাত ফেরী’র বানানটা কি ‘প্রভাত ফেরি’ না ‘প্রভাত ফেরী’ হবে? যেহেতু কবি আল মাহমুদের অনুপ্রেরণায় এ পত্রিকার নামকরণ ‘প্রভাত ফেরী’ করা হয়েছে, তাই কবির ব্যবহার করা ‘প্রভাত ফেরী’ বানানটাই অক্ষুণ্ণ হয়েছে। তথাপি, বাংলা একাডেমি বর্তমানে বানানে ‘ই’ কার বা ‘ঈ’ কারের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা না রাখাতে, সবাই যে বানানেই প্রভাত ফেরীকে ডাকুক না কেন, তাতে কোন দোষ নেই। কারণ প্রভাত ফেরী আপনাদেরই পত্রিকা। 

প্রভাত ফেরীর লোগোটি অনেক যত্ন নিয়ে তৈরী করে দিয়েছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় রম্য সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ও শিল্পী আহসান হাবীব (সম্পাদক ও প্রকাশক, উম্মাদ ম্যাগাজিন)।

এই পত্রিকার উপদেষ্টা পরিষদে আছেন বাংলা ভাষার জনপ্রিয় সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন (সাবেক চেয়ারম্যান- শিশু একাডেমি, স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত), হাবীবুল্লাহ সিরাজী (মহা পরিচালক- বাংলা একাডেমি, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত), আহসান হাবীব (রম্য সাহিত্যিক, কার্টুনিস্ট, সম্পাদক ও প্রকাশক- উম্মাদ ম্যাগাজিন), খালেক বিন জয়েনউদ্দীন (শিশু সাহিত্যিক, বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত), ডঃ তপন বাগচী (কবি ও সাহিত্যিক, উপপরিচালক- বাংলা একাডেমি), সাদিয়া চৌধুরী পরাগ (কবি ও কথা সাহিত্যিক), শাহান আরা জাকির পারুল (কবি, নাট্যকার ও কথা সাহিত্যিক), আবু সাঈদ জুবেরী (কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক), সালেক খোকন (লেখক ও গবেষক), ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান (কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক), নারায়ন চন্দ্র শীল (সাবেক মহা পরিচালক- বাংলাদেশ বেতার), নাসরুল্লাহ মোঃ ইরফান (পরিচালক- বাংলাদেশ বেতার), মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন (উপ পরিচালক- বাংলাদেশ বেতার), ডাঃ হালিম চৌধুরী, ডাঃ মোঃ একরামুল এইচ চৌধুরী, ডঃ মুহাম্মদ ফয়সাল আহমেদ (ইমিগ্রেশন আইনজীবি) এবং মাহবুবা জামান। আমাদের উপদেষ্টা পরিষদ প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন আন্তরিক পরামর্শ, মূল্যবান সময়, লেখা এবং সহযোগিতা। প্রভাত ফেরীর জন্মলগ্ন থেকেই এই পত্রিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন লেখক আনিসুল কবীর। এছাড়া যাদের অবদান অনস্বীকার্য, তারা হলেন অস্ট্রেলিয়ার স্বনামধন্য সাংবাদিক আউয়াল খান, আমার বড় ভাই সমতুল্য শিবলী আবদুল্লাহ, জায়েদ হাসনাইন এবং সিলভিয়া। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

বিগত সময়কালে প্রভাত ফেরী স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বাংলা ভাষা ভাষী কমিউনিটির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম, ইভেন্ট, মেলা ইত্যাদি নানা আয়োজন এবং উদ্যোগের স্পনসর করেছে। এছাড়াও নিজস্ব উদ্যোগে ও অর্থায়নে প্রভাত ফেরী বাংলা ভাষা ভাষী কমিউনিটির জন্য বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্বদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যা ছিল সকলের জন্য উম্মুক্ত। 

প্রভাত ফেরীতে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার অর্থাৎ দুই বাংলার নবীন, প্রবীন ও বিখ্যাত লেখকদের রচিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সহ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নির্বাচিত কলাম ও অন্যান্য সাহিত্য সৃষ্টি প্রতিদিন প্রকাশ হচ্ছে। প্রতি মাসে আমাদের ওয়েবসাইটে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিনশরও বেশি লেখা আপলোড হচ্ছে। গড়ে উঠছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অনন্য ও সমৃদ্ধ একটি সংগ্রহশালা।

আমাদের এ প্রচেষ্টায় আগ্রহ নিয়ে সাড়া দিয়েছেন পাঠকরাও। চলতি বছরের আগষ্ট মাসে প্রভাত ফেরী ওয়েবসাইটে নিয়মিত পাঠকের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ চল্লিশ হাজার জনেরও বেশি। পেইজভিউ এর হিসেবে এই পাঠকের সংখ্যাটি ছিল তিন লক্ষ ষাট হাজারের উপর। প্রতি মাসেই এই সংখ্যাটি বাড়ছে। প্রায় প্রতিটি লেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছেন অসংখ্য গুণমুগ্ধ পাঠক। প্রতি মাসেই ক্রমাগত বাড়ছে পাঠক সংখ্যা। এ বিষয়টি আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার বিষয়। এখন পর্যন্ত আমাদের পাঠকদের ৫০% বাংলাদেশের, ৪০% পশ্চিমবঙ্গের এবং ১০% ভিজিট করেন অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে। অল্প সময়কালের ভেতরে প্রভাত ফেরীর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে, প্রভাত ফেরীর প্রতি লেখক ও পাঠকদের ভালবাসার কারনে।

বর্তমানে ফেইসবুকে প্রভাত ফেরীর পেইজের সাথে যুক্ত আছেন ১,১০,০০০ এর মত মানুষ। এ সংখ্যাটিও প্রতিদিন বাড়ছে। পাঠকদের জন্য নিয়মিত লেখার পাশাপাশি নানা ভিডিও কন্টেন্ট পরিবেশনার জন্য প্রভাত ফেরীর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলটিও বহুল সমাদৃত হয়েছে। আমাদের নিজস্ব স্টুডিওতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর তৈরী করা ডকুমেন্টারী ভিডিওগুলো হাজার হাজার মানুষ নিয়মিত দেখছে প্রভাত ফেরীর ইউটিউব চ্যানেলে এবং ফেইসবুক পেইজে।  

প্রভাত ফেরীর পেইজে পাঠকদের মন্তব্যগুলোও আমাদেরকে উৎসাহিত করে যাচ্ছে এই পথচলাতে। বিশেষ করে দুই বাংলার মানুষ নানা মন্তব্যে তাদের ভাল লাগা, ভালবাসার কথাগুলো এখানে অকপটে বলছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর বুকে আমরা বাঙ্গালিরা বীর ও অনন্য এক জাতি। আমাদের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্যের শিকড় এবং গৌরবময় এক ইতিহাস। এই ভালবাসা আর বন্ধনের জন্য ধর্ম ও ভৌগলিক সীমারেখা কোন সময় বাঁধা হতে পারে না। তাই তো প্রিয় শিল্পী ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন-

গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা।
ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা-
মেঘনা-যমুনা।
একই আকাশ, একই বাতাস-
এক হৃদয়ের একই তো শ্বাস।
দোয়েল-কোয়েল পাখির ঠোঁটে একই মূর্ছনা।
এপার-ওপার কোনপারে জানিনা
ও আমি সব খানেতে আছি।
গাঙের জলে ভাসিয়ে ডেঙা
ও আমি পদ্মাতে হই মাঝি।
একই আশা ভালবাসা
কান্নাহাসির একই ভাষা
দুঃখসুখের বুকের মাঝে, একই যন্ত্রণা।
গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা।

তাই আমরা আশা করি, প্রভাত ফেরীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করার সময় আমাদের সম্মানিত পাঠকরা সচেতন থাকবেন। একে অন্যকে ব্যক্তিগত ভাবে আঘাত করা কিংবা ধর্ম বা কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ে কটাক্ষ করা কখনোই উচিত নয়। পারস্পরিক দ্বিমত, অনুযোগ, অভিযোগ বা মান-অভিমান থাকতেই পারে। তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কথোপকথন ও মতবিনিময় হতে পারে কিন্তু শিষ্টাচারের সীমা অতিক্রম করা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে সব প্রসঙ্গেই সবসময় ধর্মকে নিয়ে আসা কি উচিত? ভাইয়ে ভাইয়ে কি মনোমালিন্য, অনুযোগ, অভিযোগ থাকে না? তাই বলে কি বিভেদকেই প্রাধান্য দিতে হবে?  

একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আবদুর রহমান এবং হরিহর চন্দ্র দু’জন মানুষ। সারা জীবন পরিশ্রম করে আবদুর রহমান ঢাকায় এবং হরিহর চন্দ্র কলকাতায় এক টুকরা জমি কিনলেন। তাদের দুই জনের দুইটি করে ছেলে রয়েছে। আবদুর রহমানের ছেলেরা হচ্ছে রহিম আর করিম। অন্যদিকে হরিহর চন্দ্রের দুই ছেলে গোপাল আর শ্যাম। এক সময় আবদুর রহমান আর হরিহর চন্দ্র মারা গেলেন। তাদের কষ্টার্জিত টুকরো জমিটুকু ভাগ হয়ে গেল। দক্ষিনমূখী জমির অংশটুকুর দাম বেশী। তাই তাদের সন্তানদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল বিভেদ, কে নেবে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমির দক্ষিনমূখী অংশটুকু! এক সময় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জমি ভাগ হল, গড়ে উঠল সীমানা। কিন্তু দুই ভাইয়ের মুখ দেখাদেখি ও কথা বলা এখন বন্ধ। ভাইদের স্ত্রীদের দিনের একটা অংশ কাটছে ঝগড়া করে।

এই যে চিত্র- এটা তো এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার খুবই সাধারণ এক চিত্র। এক রক্ত, এক ধর্ম, এক মায়ের সন্তান, আপন ভাই হয়েও একসময় স্বার্থের কারণে হয়তো অনেকে দূরে সরে যায়। আবার কোন বিপদে বা প্রয়োজনে তারাই একজন আরেকজনের জন্য ঝাপিয়ে পড়ে। আমরা বিভেদটুকু এড়িয়ে যেতে চাই, আমরা সম্প্রীতিকে গুরুত্ব দিতে চাই। তাই আমাদের উদ্দেশ্য হলো, প্রভাত ফেরী হয়ে উঠুক বাংলা ভাষা ভাষী সকল লেখক ও পাঠকদের মিলন মেলা।

দুই বাংলার লেখক-সাহিত্যিক-পাঠকদের মাঝে আগামী দিনের সেতুবন্ধন রচনার কাজ করে যাচ্ছে প্রভাত ফেরী। আমাদের সাথে থাকুন আপনারা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী এই প্রত্যাশাটুকুই থাকল।

 

শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী
প্রধান সম্পাদক, প্রভাত ফেরী

সিইও, অস্ট্রেলেশিয়ান ইন্টারন্যশনাল একাডেমি
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top