সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


ক্রাইস্টচার্চ হামলার তদন্ত প্রতিবেদন

ক্ষমা চাইলেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী


প্রকাশিত:
৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:৫০

আপডেট:
৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:৫৯

 

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মুসলিমদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার প্রকৃত কারণ উদঘাটনে তদন্ত কমিটি ব্যর্থ হওয়ায় এবং মুসলিমদের ওপর হামলা এবং তদন্তের ঘাটতির জন্য ক্ষমা চাইলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন। 

২০১৯ সালের ১৫ই মার্চ। এক উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গের নারকীয় হামলায় স্তম্ভিত হয়েছিল গোটা বিশ্ব। জুমার নামাজের সময় নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে চালানো হামলায় নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন মুসল্লি। এবং আহত হয়েছিলেন আরো অনেকে। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা। অস্ট্রেলীয় নাগরিক শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী ব্রেন্টন ট্যারেন্ট ঐ হামলা চালায়। চলতি বছরের আগস্টে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলাকারী ২৯ বছর বয়সী ট্যারেন্টকে প্যারোলে মুক্তির সুযোগ না রেখে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় নিউজিল্যান্ড আদালত। 

২০১৯ সালে ঐ হামলার পর মুসলমানদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন। এবং মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করায় বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হন আরডর্ন। ঐ সময় প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন ঘোষণা দেন এ হামলার প্রকৃত তদন্ত হবে। এবং তদন্তের জন্য গঠন করা হয় রয়েল কমিশন। সেই রয়েল কমিশন ক্রাইস্টচার্চ হামলার প্রায় ১৮ মাস পর ৭৯২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়।  

তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিউজিল্যান্ড পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিলো, তবে হামলা আটকানো ছিলো অসম্ভব ব্যাপার। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ঐ সময় নিউজিল্যান্ড পুলিশের পুরো মনোযোগই ছিলো ইসলামি সন্ত্রাসবাদের দিকে। মুসলিমরাও যে অন্য ধর্মের মানুষের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন, তা তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।  

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চাইলেই ঐ হামলা বন্ধ করা যেত, এমন কথা বলা যায় না। কারণ আক্রমণকারী ব্যক্তি কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। জঙ্গি মতবাদ নিয়ে সে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে এমনও নয়। এক সময় সে অস্ট্রেলিয়ায় থাকতো তার বাবার সঙ্গে। সেখান থেকে বিশ্ব ভ্রমণে বেড়িয়েছিলো সে। শেষ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে থাকতে শুরু করে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে মাঝেমধ্যে উগ্র কথা বললেও সন্দেহ করার মতো কোনো ঘটনা সে ঘটায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 

ঐ প্রতিবেদন নিয়ে ৮ই ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে নিউজিল্যান্ড সংসদে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন বলেন, রয়েল কমিশনের প্রতিবেদনে মুসলিমদের ওপর হামলার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে ব্যর্থতার পরিচয় মেলে। তিনি আরো বলেন, হামলার বিষয়টি নিয়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ও তদন্ত কমিটির ব্যর্থতা রয়েছে। গোয়েন্দাবাহিনীসহ সরকারি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চান নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন। 

জেসিন্ডা আরডর্ন বলেন, "প্রতিবেদনে সরাসরি কোন প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়নি। এবং কমিশন তার রিপোর্টে এমন কোনো তথ্য পায়নি, যার ভিত্তিতে ওই হামলা থামিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু সেখানে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, সেজন্য ব্যর্থতার দায় আমাদের ওপরই বর্তায়। এবং এসব কারণে সরকারের পক্ষ থেকে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।" তবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে নিউজিল্যান্ড বিশ্বের যেকোন স্থানের থেকে নিরাপদ বলেও উল্লেখ করেন। 

রয়েল কমিশনের রিপোর্টে বেশ কিছু (৪৪টি) সুপারিশ করা হয়েছে এবং এগুলোর মধ্যে রয়েছে নতুন একটি জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা প্রতিষ্ঠা এবং পুলিশ যাতে খুব দ্রুত বিদ্বেষমূলক অপরাধ চিহ্নিত করে সেসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে তার উদ্যোগ নেয়া। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং ইউটিউবে নজরদারি বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে রিপোর্টে। উগ্র মতামত যারা প্রকাশ করছে, তাদেরকেও নজরে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নিউজিল্যান্ড সরকার বলছে যে তারা রয়েল কমিশন রিপোর্টের সব সুপারিশই গ্রহণ করবে। 

রয়েল কমিশন রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় দেশটির মুসলিম কমিউনিটির নেতারা নিরাপদ নিউজিল্যান্ডের দাবি জানিয়েছেন। ক্রাইস্টচার্চ শহরের যে দুটো মসজিদে হামলা চালানো হয়েছিল তার একটি আল নূর মসজিদ। সেই মসজিদের ইমাম গামাল ফৌদা বিবিসি কে বলেন, তদন্ত রিপোর্টে নিশ্চিত করা হয়েছে যে মুসলিমদের রক্ষার পরিবর্তে তাদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ ছিল বেশি। তিনি বলেন, "আমরা অনেক দিন ধরেই জানি যে মুসলিমরা ঘৃণা ও বিদ্বেষ-জনিত বক্তব্য ও অপরাধের শিকার হচ্ছে। এই তদন্ত রিপোর্ট দেখিয়ে দিয়েছে যে আমরা সঠিক।" 

হামলায় নিহত একজনের বোন আয়া আল-উমারি বিবিসিকে বলেছেন, কমিশনের সুপারিশমালায় "সঠিক বিষয়গুলো" তুলে ধরা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, "প্রধানত: নিউজিল্যান্ডের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কার্যক্রমকে আরো উন্নত করা, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল, সামাজিক সম্প্রীতি এবং জনগণের মধ্যে জাতিগত যে বৈচিত্র্য বাড়ছে সেসব বিবেচনা করে নিউজিল্যান্ড সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।" নিউজিল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে অন্যান্য দেশগুলোও শিক্ষা গ্রহণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। 

 

মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top