সিডনী বুধবার, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অনিমেষ আঁখি : কাজী জাকির হাসান


প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২০ ২২:৪৪

আপডেট:
১১ এপ্রিল ২০২২ ২৩:০৪

ছবিঃ কাজী জাকির হাসান

 

এটাকে গল্প বলা যাবে কিনা জানি না। একবার একটা জরুরি কাজে কিশোরগঞ্জ যেতে হয়েছিলো আমাকে। সঙ্গে তিন-চারজন বন্ধুও ছিলো। ওরা ঠিক করেছিল সড়ক পথে প্রাইভেট কারে যাবে। কিন্তু আমার অসম্মতির কারণে শেষ পর্যন্ত ট্রেনেই যেতে হলো সবাইকে।

রাত এগারোটায় দিনাজপুরগামী মেইলে কমলাপুর স্টেশন থেকে রওয়ানা হলাম আমরা। হইহুল্লোড় করতে করতে রাত প্রায় সোয়া তিনটায় ময়মনসিংহে এসে পৌছলাম। বড় জংশন স্টেশন। আমাদের নামতে হবে এখানেই এবং ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে লোকাল ট্রেন ধরবার জন্য। ঠিক হলো স্টেশন মাষ্টারকে বলে প্রথম শ্রেণীর বিশ্রামাগার খুলে সেখানেই বাকি সময়টা কাটিয়ে দেবো আমরা। কিন্তু ঢাকাগামী দুটো পরিবার থাকার কারণে স্টেশন মাস্টার অপারগতা জানিয়ে দু:খ প্রকাশ করে তাঁর অফিস-কক্ষে সময় কাটানোর আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের।

রসিক ভদ্রলোক। চল্লিশোর্ধ বয়স। ঘন ঘন পান খান জর্দা দিয়ে, তাই ঠোঁট দুটো সব সময় লাল টুকটুকে হয়ে থাকে। তাঁর প্রাণ খোলা হাসি আর আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমরা। বন্ধুত্ব হয়ে গেল অল্প সময়ের মধ্যে।

শীতের রাত। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে পেয়ালার পর পেয়ালা চা চলতে থাকলো। বন্ধুরাও আষাঢ়ে গল্পে জমে গেল স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে।

মানুষের কোলাহল, মালটানা গাড়ির ঘড় ঘড় শব্দ, হকার-ফেরিওয়ালাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে রাত গভীর হলেও স্টেশনের স্বাভাবিক কাজ পুরোদমে চলছিলো তখনও। বাহাদুরাবাদ ঘাট, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট এবং চট্টগ্রামগামী আপ্‌ তিনটি ট্রেনই দাঁড়ানো তখনও স্টেশনে। চোখে ঘুম ঘুম লাগছে। চায়ের পেয়ালায় চুমুক আর কথা বলে কতক্ষণ সময় কাটানো যায়। বন্ধুরা তো জমে গেছে গল্পে। আমি একটু হাঁটাহাঁটি করার ইচ্ছায় গায় চাদর জড়িয়ে স্টেশন মাস্টারের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম বাইরে। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারদিক। ট্রেনের জানালার গ্লাস বেয়ে পানি পড়ছে টপ্‌ টপ্‌ করে। অর্ধউলঙ্গ মানুষগুলো গুটিসুটি মেরে শুয়ে রয়েছে এখানে সেখানে। এক নম্বর প্লাটফর্ম ধরে হাঁটতে লাগলাম উত্তর দিকে। শেষ মাথায় একটি পানের দোকানের কাছে আসতেই গুনগুন শব্দে গাওয়া একটা অতি পুরনো গানের সুর কানে এসে বাজতে লাগলো। থমকে দাঁড়ালাম। গানের কথাগুলো অস্পষ্ট শোনালেও, সুরটা অতি পরিচিত মনে হলো। বহুদিন আগে গ্রামোফোন রেকর্ডে সম্ভবত আঙ্গুর বালার কণ্ঠে শুনেছিলাম গানটি। গায়কী ঢং আর মাধুর্য মেশানো সুললিত কণ্ঠ ভীষণভাবে আকৃষ্ট করলো আমাকে। সুরের রেশ ধরে তাই খুঁজতে লাগলাম চারদিক। বন্ধ পানের দোকানের চৌকির তলে হঠাৎ চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। সর্বাঙ্গ ছালা দিয়ে জড়ানো একটা লোক জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। চোখাচোখি হতেই ফোকলা মুখে একগাল হেসে বেরিয়ে এলো চৌকির তল থেকে। বয়স পঞ্চাশ কি পঁচাত্তর বোঝার উপায় নেই। রসির মত জট পাকানো মাথার লম্বা পাকা চুল কোমর অব্দি ঝুলে পড়েছে। দন্তহীন মুখ দিয়ে লালা ঝরছে অনবরত। ডানপায়ের তালুতে দগদগে ঘা।মিশমিশে কালো চেহারার মুখখানা যে একসময় সুদর্শন ছিলো তা লোকটির অন্তরভেদী চোখ দুটো দেখেই বোঝা যায়। কি যেন এক প্রত্যাশা লুকিয়ে আছে সে চোখে। স্থান কাল পাত্র ভুলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম বৃদ্ধের চোখের দিকে।

-আমার গান আপনার ভাল লেগেছে, বাবু সাহেব? আশ্চর্য কোন জড়তা নেই। স্পষ্ট ঝরঝরে কণ্ঠে কথাগুলো বললো বৃদ্ধ। আমি বিস্ময়ে হতবাক।
-আপনিই গাইছিলেন।
-কই আর আগের মতো গাইতে পারি। বলে হাসতে লাগলো। সরল হাসি কিন্ত তার মধ্যেও মনে হ’লো কতদিনের জমানো কান্না ঝরে পড়ছে যেন।
-কষ্ট না হলে পুরো গানটা একবার গেয়ে শোনাতে পারেন?

আনন্দে চকচক করে উঠলো বৃদ্ধের চোখ। আমার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে বললেন:

-কেউ শুনতে চাইলে তাকে শোনাতে হয়। হয় না বাবু সাহেব? বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা শীর্ণ হাতে চৌকির তলা থেকে একটা মাটির হাঁড়ি বার করে তা কোলের ওপর বসিয়ে ডান হাতে একটা আধুলি নিয়ে তাল দিতে দিতে গান ধরলেন।

কালা তোর তরে কদম তলায় চেয়ে থাকি।

চেয়ে চেয়ে ক্ষয়ে গেল আমার

কাজল পরা জোড়া আখিঁ।।

 

সুরের গভীরে নিজেকে যেন বিলীন করে দিলেন বৃদ্ধ। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের মাঝে পৃথিবীর সব কিছুই যেন তুচ্ছ আর মলিন মনে হতে লাগলো। গান এবং চোখের পানিতে একাকার হয়ে গেল সব। বারবার প্রশ্ন করতে লাগলাম নিজেকে, ‘একি শুধুই গান? নাকি হৃদয় নিংড়ানো আর্তনাদ এ কণ্ঠ দিয়ে ঝরে পড়ছে?’ গান শেষ করে বৃদ্ধ যখন চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে, মনে হলো সদ্যভূমিষ্ট শিশুর মত নিষ্পাপ এ চোখ। মুগ্ধ হলাম। জিজ্ঞেস করলাম।

-কি দেবো আপনাকে?
-কি দেবেন? না কিছুই দিতে হবে না। গাইলাম, আপনাকে আমার ভাল লেগেছে। লেগেছে না বাবু সাহেব? বড় ছোট মনে হলো নিজেকে। এমন উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না সম্ভবত। তাই নিজেকে কিছুটা হাল্কা করার জন্য সহাস্যে বললাম।
-কিছু মনে করবেন না। কথাটা বললাম এ কারণে, আমিও খুব ভালবেসে ফেলেছি আপনাকে।

আমার কথা শুনে বৃদ্ধের হাস্যোজ্জল মুখখানা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। লালা ঝরতে লাগলো আরো জোরে। থরথর করে কাপতে লাগলো তার হাত দুটো। ছলছল হয়ে উঠলো চোখ। বুঝে উঠতে পারলাম না মুখ ফস্কে আবার অন্যায় কিছু বলে ফেললাম নাকি।

-কি জানেন বাবু সাহেব, ভালবাসা জিনিসটা ভাল নয়।
-কি রকম? সাহস করে বললাম।
-যেমন ধরুন আমি। না না অন্য কিছুটি ভাববেন না যেন। আপনাকে আমার ভাল লেগেছে তাই বলছি। আপনি ভদ্রলোক, সমঝদার মানুষ। কারো কথা কোথাও ঘাটাঘাটি করবেন না তা দেখেই বুঝেছি। বুঝেছি না বাবু সাহেব?
-অবশ্যই।

একটা দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করলাম বৃদ্ধের প্রতি। শুধু কণ্ঠের সুরে নয়, ওর কথা বলার ভঙ্গিতেও একটা আশ্চর্য রকমের আর্ট আছে, যা শুধু কাছে টানে, আপন ভাবতে শেখায়। কিছু না বলে কোন রকমের ব্যবধান না রেখে আরো কাছে সরে এসে বসলাম। একেবারে মুখোমুখি। বুঝলাম বৃদ্ধের নিশ্চয় এমন কিছু একটা আছে যা বলতে চাইছেন আমাকে। একান্ত আমাকেই।

-কি যেন বলবেন বলছিলেন? - জিজ্ঞেস করলাম।
-বলেছি বুঝি? হ্যাঁ বলবো। বলবো না বাবু, সাহেব? মুহূর্ত কয়েক নিশ্চুপ থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস টানলেন বৃদ্ধ। তারপর বলতে শুরু করলেন তার কথা।
-যৌবনে যাত্রাদলের গাইয়ে ছিলাম। পিছুটান বলতে ছিলো একমাত্র মা। বাবা গত হয়েছেন আমার জন্মের বছর। শুনেছি, তিনিও যাত্রাদলে ছিলেন। তবে গাইয়ে টাইয়ে নয়, জোগালী। হিরো সাজবার প্রতিভা থাকা সত্বেও ছিলেন নামকরা সব হিরোদের খাদেম। সেই হিরোদেরই একজন, বিনোদ বিহারী নাহা। পরবর্তীতে তিনিই হন বউটুবানী অপেরার স্বত্বাধিকারী। বাবার সঙ্গে একটা সম্পর্কের সুবাদে সদয় হয়ে তার দলে আমাকে টেনে নেন। কিন্ত স্থান হয় আমার সাইড লাইনের বাইরে।

একদিনের ঘটনা।

কি একটা কারণে অধিকারী মেরাজ মোহাম্মদের সঙ্গে হিরো জয়ন্তর খুব কথা কাটাকাটি হয়। সে রাতের নির্ধারিত পালা ছিলো রাধারানী। টিকেটও বিক্রি হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু হঠাৎ করেই জয়ন্ত ঘোষণা দিয়ে বসলো বউটুবানী অপেরায় সে আর থাকবে না এবং এক্ষুনি চলে যাবে প্যাণ্ডেল ছেড়ে। কানাঘুষা চলতে লাগলো চারদিকে । কিন্তু কেউই পারলো না ঠেকাতে। জয়ন্ত চলে গেল।

বৃদ্ধ থামলেন। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে কি যেন ভাবলেন, তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার শুরু করলেন।

-তাই বলে পালা তো আর বন্ধ থাকতে পারে না। অধিকারী সিদ্ধান্ত দিলেন নির্ধারিত পালাই গাওয়া হবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল শ্রীকৃষ্ণ সাজবে কে? এই অল্প সময়ে কাকে দিয়ে সম্ভব জয়ন্তর অভিনয় করানো। তাও আবার শ্রীমতি রাধারূপী ডাকসাইটে অভিনেত্রী ললিতার বিপরীতে। স্বত্বাধিকারী বিনোদ বিহারী দুহাতে মাথার চুল ধরে বসে পড়লেন। দিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন সবাই। এমনি সময় অধিকারীর তাঁবুতে ডাক পড়লো আমার। ছুটে গেলাম। মদের নেশায় টুইটুম্বুর অধিকারী ঢুলুঢুলু চোখে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন আমায়। তারপর হঠাৎ চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, - 'মিলগিয়া। আজ রাতে শালা তুমিই শ্রীকৃষ্ণ সাজবে।’ হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। বুঝতে পারলাম না নেশার ঝোঁকে আমাকে নিয়ে অধিকারী বাবুর এ রসিকতার অর্থ কি? তেমনিভাবে ঠায় দাড়িয়ে থাকলাম সেখানেই। উনি রেগে হুংকার দিয়ে উঠলেন। - ‘যা বলেছি ফাইনাল বলেছি। যাও পার্ট মুখস্ত কর গিয়ে।’ আর কথা চলে না, ফিরে এলাম তাঁবুতে। সাইড লাইনের বাইরে থাকার কারণে প্রায় সব চরিত্রই মুখস্ত রাখতে হ’তো আমাকে।। শ্রীকৃষ্ণের পার্টও মোটামুটি আমার জানা ছিলো। কাজেই হঠাৎ করে পাওয়া এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করতে মন চাইলো না। পাশাপাশি জেগে উঠলো বাবাকে অবহেলা করার প্রতিশোধস্পৃহা। দুটো মিলে আমি হয়ে গেলাম এক অন্য মানুষ।

রাত এগারোটা।

হ্যাজাগ বাতির আলোয় ঝলমল করছে যাত্রা প্যাণ্ডেল। বসে আছেন হাজারো দর্শক। প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন সবাই। বুকের ভেতর টিপটিপ করতে লাগলো আমার। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এলো। ঘেমে নেয়ে ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে এলো সমস্ত শরীর। এক সময় বুকফাটা আওয়াজ করে কনসার্ট বেজে উঠলো। প্রথম দৃশ্যের অভিনয় করতে সখি সাথে মঞ্চে প্রবেশ করলেন ললিতা। সঙ্গে সঙ্গে প্যাণ্ডেল প্রকম্পিত হলো মুহুর্মুহু করতালিতে। এর মাঝেই গান ধরলেন শ্রীমতি রাধে, কালা তোর তরে – তারপর - দৃশ্যের পর দৃশ্য - জুয়ার টেবিলে বাজি ধরার মতো অভিনয় করে গেলাম ললিতার বিপরীতে ।

শেষ হলো পালা। কনসার্ট বেজে চলছে তখনও । মেকআপ রুমে অধিকারী জড়িয়ে ধরলো আমাকে, আবেগ আপ্লুত বিনোদ বিহারী চুম্বনে চুম্বনে কপাল ভরিয়ে দিলো। কিন্তু আমি চোখের পানি লুকোতে ছুটে পালিয়ে এলাম তাঁবুতে। কতক্ষণ কেঁদেছি জানি না। হঠাৎ পেছনে শব্দ শুনে সামলে নিলাম নিজেকে। চোখ মুছে তাকাতেই দেখি মেকআপ অবস্থায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে ললিতা। অবাক হলাম। অবাক হলাম ললিতাকে আমার তাঁবুতে দেখে। অপরূপ সুন্দরী নামীদামী আর্টিস্ট ললিতা ভুলেও তো কোনদিন সংলাপের বাইরে একটা কথা বলে নি আমার সঙ্গে। এ সেই ললিতা যার হাজারো বায়না মেটাতে অধিকারী থেকে স্বত্বাধিকারী পর্যন্ত তটস্থ থাকেন সব সময়।

-কি হলো শ্যাম, অমন করে পালিয়ে এলে যে? বীণার তারের ঝংকার উঠলো ললিতার কণ্ঠে। যেন সহস্র গোপীর কলতানে মুখোরিত হলো রাইকুঞ্জ। আর সেই কুঞ্জদ্বারে দাঁড়ানো ভিখেরি যোগীকে ভিক্ষে দিতে অভিমানিনী রাই কিশোরী স্বয়ং দুহাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। অভিভূত আমি অস্বাভাবিক কণ্ঠে হোঁচট খেয়ে বললাম:

-আমি বুঝতে পারছি না কিছু।
-বুঝতে কি আমরাও পেরেছিলাম কালা। এমনি এক প্রতিভা বড় অনাদর আর অবহেলায় লুকিয়ে ছিলো এতদিন আমাদেরই মাঝে।
-কি করেছি আমি জানি না।
-সত্যিই তুমি জানো না কি করেছ। যদি জানতে –
-না না অমন করে বলবেন না।

অবাক বিস্ময়ে ললিতা তাকালেন আমার দিকে। পলকহীন দৃষ্টি তার। লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেলাম আমি। মাথা নিচু করে তাকালাম মাটির দিকে।

-বসতে বলবে না শ্যাম?
-বসবেন! আমার এখানে?
-তুমি আসলেই একটা ছেলেমানুষ। শীতের রাতেও ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছ দেখছি। কই বোস। আমিও বসছি।

খিলখিল শব্দে হেসে উঠলেন ললিতা। দুনিয়া কাঁপানো হাসি। এ হাসির দমকে বড় অসহায় আর ছোট মনে হতে লাগলো নিজেকে । পালিয়ে গিয়ে হয়তো নিজেকে রক্ষা করতে পারতাম, কিন্তু পা দুটো যেন আটকে গেছে ললিতার সামনে।

-‘আহা লজ্জা কিসের এত, বোসতো।’ হাত ধরে টেনে বসালেন তার পাশে।
-একি করছেন আপনি!
-বড্ড ঘামছো তুমি। আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে ক্লান্তির ছাপগুলো তোমার মুছে দিচ্ছি।
-ললিতাদি!
-উ হুম, শুধু ললিতা।

বিচিত্র ভঙ্গিতে নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলে আমার তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল ললিতা।

যাওয়ার সময় বাইরে চাপা গলার একটা আওয়াজ কানে এলো আমার। বেরিয়ে এলাম। তাকাতেই মনে হলো একটা ছায়া দ্রুত সরে গেল আমার তীবুর পাশ দিয়ে।

এমনিভাবে পেরিয়ে যেতে লাগলো সময়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যাত্রা জগতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে গেলাম আমি। পরিবর্তন হলো অনেক কিছু। ভূলে গেল সবাই জয়ন্ত'র কথা। সবার মুখে মুখে ফিরতে লাগলো শুধু শ্যাম-ললিতার কথা। শ্যাম-ললিতা জুটি ছাড়া কোন পালাই যেন আর জমতে চায় না। শ্যাম-ললিতার নামেই টিকিট বিক্রি হয়। শিল্পী সত্তার বিকাশ দায়িত্বশীল করে তুললো আমাকে ।

ললিতাও হাত বাড়ালো আমাকে আরো সমৃদ্ধ করতে। কাছাকাছি হলাম দুজনে।

সাতদিনের চুক্তিতে উত্তর বঙ্গের রায়গঞ্জে প্যাণ্ডেল পড়েছে আমাদের। পাটেশ্বরী থেকে বাসে মাত্র এক ঘন্টার রাস্তা। জায়গাটা ধান পাটের আড়ত। মানুষজনও খুব ফুর্তিবাজ সেখানকার। পালাও জমেছে বেশ। ওখানে বসেই বায়না হয়ে গেল নাগেশ্বরী, পাটেশ্বরী, জয়মনিরহাট, ভূরুজ্গামারি আর ফুলবাড়িতে। টানা এক মাস। একরাত বাকি থাকতেই রায়গঞ্জের মহাজনরা অধিকারীকে এসে ধরলেন বাড়তি আরো দুরাত গেয়ে যেতে।

কে চায় হাতের লক্ষ্মী পা’য় ঠেলতে। রাজি হলেন অধিকারী। ঠিক করলেন নতুন পালা নামাবেন। সেই সুবাদে বিকেল বেলা নদীর ধারে একটা আম গাছের ছায়ায় মাদুর পেতে বসে নতুন পালা “চাঁদ সুলতানার” সংলাপ মুখস্ত করছিলাম। এমন সময় ললিতাও এসে হাজির হলো সেখানে।

-কালা।
-বসো ললিতা।
-সন্তুকে বললাম চা’টা এখানেই দিয়ে যেতে। দুজনে এক সঙ্গেই খাবো আজ।
-আর কখনো একসঙ্গে খাই নি বুঝি?
-তবুও আজকের পরিবেশটা অন্য রকম, কালা। - ম্লান হেসে উত্তর দিল ললিতা।
-আচ্ছা শ্রীমতি তুমি আমায় “কালা” বলে ডাকো কেন বলতো?
-তুমি আমাকে “রাই কিশোরী” ডাকো তাই। তাছাড়া তুমি যে আমার শুধুই কালা। জন্মজন্মান্তরের কালা।
-যদি তাই যদি হয়, তাহলে শুধু শুধু ললিতাকে এত কাছে টেনে কি লাভ।
-বিসর্জন দেবে?
-তা কেন। ললিতাকে রাধিকা করে নেব রাই কিশোরী।
-সত্যি বলছো কালা! সত্যিই তুমি আমাকে রাধিকা করে নেবে? বলো সত্যি?

মুহুর্তে কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলো ললিতা। বিবর্ণ হয়ে গেল দুধে-আলতায় মেশানো তুলতুলে নরম দেহটা। গোলাপের পাঁপড়ির মতো আরক্ত ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগলো থরথর করে। বেদনার্ত নি:শ্বাস যেন গুমরে গুমরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চারদিকে। অসহায় চোখ দুটো কেমন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইলো আমার দিকে।
-বিশ্বাস য় না আমাকে?
-হয় কালা হয়। তবে –
-তবে কি?
-মুখেই যা কিছু বলে সবাই, এগিয়ে আসে না কেউ সাহস কর।
-কি বলছো।
-সত্যি বলছি কালা। আমি বাঁচতে চাই। স্বামীর সোহাগ, সন্তানের ভালোবাসা নিয়ে আমি ঘর বাঁধতে চাই। যদি সত্যিই তুমি আমাকে ভালোবাস, আমাকে নিয়ে যদি সংসার পাততে চাও তাহলে আর একটি মুহুর্ত এখানে নয়, আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাও এক্ষনি।
-পালিয়ে যাবো, কেন?
-সে অনেক কথা, পরে বলবো।
-তোমার সব কথা না শুনে আমি এক পা-ও নড়বো না এখান থেকে।
-আমাকে ভুল বুঝ না কালা।
-কথা তা নয় ললিতা।
-কথা যাই হোক, সর্বনাশের মুখে তোমাকে ঠেলে দিয়ে বাঁচতে আমি চাই না। না না কিছুতেই না।

প্রবল কান্নার বেগ চেপে আমার সামনে থেকে ছুটে চলে গেল ললিতা । অনেক ডেকেও আর ফেরাতে পারলাম না তাকে। বুঝতে পারলাম না কিসের থেকে কি হয়ে গেল। ললিতাও বললো না কিছু স্পষ্ট করে।

পালায় মন বসলো না আর। শূন্যে দৃষ্টি মেলে বসে রইলাম সেখানেই। হঠাৎ করে হরিবাবু, মোজাম্মেল, তফাজ্জল হোসেন, জয়ন্ত এদের দল ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই মনটা কেমন টনটন করে উঠলো ব্যথায়। কিন্তু এ পর্যস্তই। এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। সে রাতের পালা তেমন জমলো না। ললিতার অভিনয়ে আড়ষ্টতা লক্ষ্য করলাম। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। বুঝলাম খুব কেঁদেছে ও। অন্য দিনের মতো পালা শেষে চা খেতে এলো না আমার তাঁবুতে। দূর থেকে গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে সোজা চলে গেল নিজের তাঁবুতে। বড় অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক মনে হলো তার আচরণ। ভাবলাম একবার যাই। গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হয়েছে ললিতা?’ কিন্তু ইচ্ছে হলো না কেন জানি। তাঁবুতে ফিরে এলাম। চেষ্টা করলাম ঘুমোবার। কিন্তু ঘুম এল না। কেবলই কানে বাজতে লাগলো ললিতার কথাগুলো। চোখে ভাসতে লাগলো তার শুকনো জৌলুসহীন দেহ। উঠে দাঁড়ালাম বিছানা থেকে। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে খ্যাতির মোহ ত্যাগ করে ললিতাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার দৃঢসংকল্প নিয়ে বেরিয়ে এলাম তাবু থেকে। কিন্তু এগুতে পারলাম না বেশিদূর। পাশের তাঁবু থেকে লোকজনের গুঞ্জন কানে ভেসে এলো। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আমাকে দেখে গুঞ্জন থেমে গেল হঠাৎ। ভীত সন্তস্ত চোখে সবাই তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই মোচড় দিয়ে উঠলো বুকের ভেতরটা। ললিতা নেই। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ললিতাকে। ছুটে গেলাম অধিকারীর তাবুতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম অধিকারী আর বিনোদ বিহারী পাঁড় মাতাল হয়ে পড়ে রয়েছেন মেঝেতে । কোন হুঁশ নেই তাদের।

পুলিশ লাগিয়ে পুরো রায়গঞ্জ ওলোট-পালোট করেও কোন খোঁজ পেলাম না ললিতার। ভোজবাজির মতোই হাওয়া হয়ে গেল।

বউটুবানী ত্যাগ করলাম।

ললিতার খোজেঁ ঘুরে বেড়াতে লাগলাম গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দর, পার্টিতে-পার্টিতে। অবশেষে একদিন ক্লান্ত হয়ে এখনে এসে আশ্রয় নিলাম। যদি কোনদিন রাই কিশোরীর দেখা পাই।

চোখের পানি আর মুখের লালা ঝরতে লাগলো সমানভাবে। জ্বালা করে উঠলো আমার চোখ। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামলে নিলাম নিজেকে।তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। পকেটে হাত দিয়ে একটা একশ টাকার নোট বার করে এগিয়ে ধরলাম বৃদ্ধের দিকে।

-আমাকে দিচ্ছেন? দিচ্ছেন না বাবু সাহেব?

হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে ট্যাকে গুঁজে রাখলেন। তারপর কৃতজ্ঞচিত্তে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-ভালোবাসার দান কখনো ফিরিয়ে দিতে নেই। ফিরিয়ে দিলে তা হারিয়ে যায়। যায় না বাবু সাহেব?

উত্তর দিতে পারলাম না। কি উত্তর দেবো? কতটুকু জ্ঞান আছে আমার এ সম্পর্কে?

তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম একরকম। আমাকে দেখে স্টেশন মাস্টার হেকে উঠলেন সহাস্যে।

-কথা বলতে বলতে হঠাৎ কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন বলুন তো?

বন্ধুরা উৎসুক হয়ে উঠলো আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কেন জানি আমি সহজ হতে পারলাম না। গস্তীর কণ্ঠে উত্তর দিলাম।

-বাইরে হাঁটাহাঁটি করলাম একটু।
-এই নাকি একটু! বলেন কি সাহেব? সাংবাদিক মানুষ। অভ্যেসটা আপনাদের গোয়েন্দাগিরির চেয়ে কম নয়। আমি তো ভাবলাম কিছু পেয়ে টেয়ে গেলেন নাকি আবার।

নিজের রসিকতায় হা হা করে নিজেই হেসে উঠলেন স্টেশন মাস্টার।

-গাড়ি ছাড়তে এখনো কিছুটা সময় বাকি আছে। চলবে নাকি আরেক কাপ?

উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না স্টেশন মাস্টারের কথার। সৌজন্যমূলক হাত মিলিয়ে সোজা গিয়ে গৌরীপুর লাইনে দাঁড়ানো ট্রেনে উঠে বসলাম।

ট্রেন ছেড়ে দিলো।

জানালা দিয়ে মুখ বার করে তাকিয়ে থাকলাম ময়মনসিংহ স্টেশনের দিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো এক সময়। ট্রেনের গতির সঙ্গে পেছনে হারিয়ে গেল বৃদ্ধ। কিন্তু তখনও আমার কানে কেবলই ভেসে আসতে লাগলো বৃদ্ধের গুনগুন করে গাওয়া সেই সুর,

কালা তোর তরে কদম তলায় চেয়ে থাকি।
চেয়ে চেয়ে ক্ষয়ে গেল আমার
কাজল পরা জোঁড়া আখি।

 

কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top