কথা সাহিত্যের যুগপুরুষ বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় : আরিফুল ইসলাম সাহাজি
 প্রকাশিত: 
 ২৯ আগস্ট ২০২০ ২২:২৭
 আপডেট:
 ১ নভেম্বর ২০২৫ ০২:১৩
 
                                শরৎ পরবর্তী বাংলা কথা সাহিত্যের যুগপুরুষ, তাঁর যুগের অন্যতম কথাকার বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল তারকা তিনি। তাঁর স্বহৃদয় বীণা নিজস্ব গতিতে বহমান, যা বাংলা সাহিত্য দিয়েছে, এক স্বতন্ত্র প্রবাহ। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতই এক স্বতন্ত্র ধারা সৃস্টিতে প্রবলভাবে সফল হলেন বিভূতি, তার নেপথ্যে রয়েছে, তাঁর অনুভবমুখর মনন, প্রকৃতিকে তিনি দুচোখ ভরে ভোগ করেছে। গণমানবের জীবনের সুখ দুঃখ লেপনের সাথে সাথে তাঁর প্রকৃতিক বর্ণনা ভীষণ রকম জীবন্ত। 'অরণ্যক' উপন্যসের কথা পাঠক নিশ্চয় বিস্মৃত হননি। ওই উপন্যাসে ভানুমতি, রাজু পাঁড়ে দের সাথে প্রকৃতিকও এক অনন্য চরিত্র হিসাবে উঠে এসেছিল। এবার একটু, চাঁদের পাহাড়ের প্রসঙ্গ টানি। উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্য, সাথে বিশ্বসাহিত্যের অনন্য সংযোজন, এ বিষয়ে আশাকরি কেউ দ্বিমত হবেন না। পাঠক, আমার বিশ্বাস আপনারা প্রায় সকলেই পড়েছেন এই অমর লাজবাব উপন্যাসখানি, এইবার একটু ভাবুন, শংকরের ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চময় অভিযানের সঙ্গে আমাজনের কি অপূর্ব বর্ণনা শ্রদ্ধেয় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় দিয়েছেন। শুনলে অবাক হওয়ার মতই বিষয়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় কখনও আফ্রিকা যাননি, এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও তিনি কখনও যাননি। আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন, এই ধরাভূমি তখনও গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তরিত হয়নি। অর্থাৎ, বলবার বিষয় হল, গুগলিং কিম্বা ইউটিউবে সার্চ দিয়ে আমাজনের গভীর অরণ্যে বিভূতিভূষণের ঘুরে আসবার সুযোগ ছিল না, তিনি যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার পুরোটাই পুস্তক পাঠের দৌলতে এবং তাঁর বিস্ময়কর দক্ষতার বলেই 'চাঁদের পাহাড়ের 'বর্ণনা ঘটনা পরস্পরা এত্তটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
কথক বিভূতিভূষণ তাঁর অনুভবমুখর মনন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে দিনলিপির পাতায় লিখেছেন, 'দূর জীবনের পার হতে আমি আমার যে পাখিডাকা, তেলকুচো ফুল ফোটা, ছায়াভরা মাটির ভিটেকে অভিনন্দন করে শুধু জানাতে চাই, - ভুলিনি ! ভুলিনি ! যেখানেই থাকি ভুলিনি ! - তোমার কথায় লিখে যাব - সুদীর্ঘ অনাগত দিনের বিচিত্র সুর সংযোগের মধ্যে তোমার মেঠো একতারার উদার, অনাহত ঝংকারটুকু যেন অক্ষুন্ন থাকে।'
কবিবর জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু মৃত্যুর পরের জীবনেও প্রিয় জননী জন্মভূমি এই বাংলায় ফিরে আসবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ও বাংলাভূমির সৌন্দর্যময় রুপবাহারকে ভুলতে পারেন না, এই না পারার আস্ফালনই তাঁকে বাংলা সাহিত্যের উইকিপিডিয়ায় দিয়েছে বিশেষ স্থান।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি 'পথের পাঁচালী'। পাঠক আপনাদের অবশ্যই স্মরণে আছে, জগৎখ্যাত চলচিত্র স্রষ্টা শ্রী সত্যজিৎ রায় সমীপেষু, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের এই অমর সৃষ্টির চিত্ররুপ দেওয়ার কৃতিত্ব স্বরূপ 'অস্কার' দ্বারা সন্মানিত হয়েছিলেন। উপন্যাসটিতে বিভূতিভূষণ দারিদ্রের ছবি দেখিয়েছেন, কিন্তু ব্যতিক্রমীভাবেই তা নিয়ে তিনি কণ্ঠ উচ্চ করেননি, বিদ্রোহের সুর প্রকটিত হয়নি তাঁর কথন ভঙ্গিমায়। বরং দুঃখকে তিনি অনুভব করেছেন, উপভোগও করেছেন। বিভূতিভূষণ লিখলেন, 'যে জগৎকে আমরা প্রতিদিনের কাজকর্মে হাটে ঘাটে হাতের কাছে পাইতেছি জীবন তাহা নয়, এই কর্মব্যস্ত অগভীর একঘেয়ে জীবনের পিছনে একটি সুন্দর পরিপূর্ণ, আনন্দভরা সৌম্য জীবন লুকানো আছে - সে এক শাশ্বত রহস্যভরা গহন গভীর জীবন - মন্দাকিনী, যাহার গতি কল্প হইতে কল্পান্তরে; দুঃখে তাহা করিয়াছে অমৃতত্বের পাথেয়, অশ্রুকে করিয়াছে অনন্ত জীবনের উৎসধারা।'
এই অনন্য ভাবনায় বিভূতিভূষণকে বিশিষ্টতা দিয়েছে, তাঁর সাহিত্যে জীবনের প্রতি তেমন কোন অভিযোগ নেই। বরং প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ বেদনাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছেন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেননি।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্যের উপাদান এবং বিষয়বস্ত্ত সামান্যই, সাধারণ, চমকপ্রদ নয় একেবারেই। সেখানে বঙ্কিমের মত পান্ডিত্যের আস্ফালন নেই, সহজ সরল গ্রামীণ গণ মানুষের জীবন তাঁর আশ্রয়। ব্যক্তিজীবনে তাঁর পৃথিবী যাপন ছিল সাধারণ মানের। জীবনের শেষ দশবছর কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা এলেও, জীবনের সিংহভাগটাই দারিদ্র সঙ্গী ছিল তাঁর। শিক্ষক হিসাবেই তিনি ছাত্র পড়িয়েছেন কিছুটা কলকাতায় এবং বেশিরভাগ সময় গ্রামবাংলার বিদ্যালয়ে। তাঁকে টানত ঈশ্বর এবং প্রকৃতি। ভ্রমন ছিল নেশা। বাংলার গ্রামে শিক্ষকতা করবার অভিজ্ঞানেই তিনি সাধারণ দারিদ্র গণমানবের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, 'বাংলাদেশের সাহিত্যের উপাদান বাংলার নরনারী, তাঁদের দুঃখ - দারিদ্রময় জীবন, তাদের আশা - নিরাশা, হাসি - কান্না - পুলক - বহির্জাগতের সঙ্গে তাদের রচিত ক্ষুদ্র জগৎগুলির ঘাত প্রতিঘাত, বাংলার ঋতুচক্র, বাংলার সন্ধ্যা - সকাল, আকাশ - বাতাস, ফুল - ফল, - বাঁশবনের, আমবাগানের নিভৃত ছায়ায় ভরা সজনে ফুল বিছানো পথের ধারে যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে - তাদের কথায় বলতে হবে। তাদের সে গোপন সুখ - দুঃখকে রুপ দিতে হবে।'
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের এই পবিত্র হৃদয় নির্মাণ তাঁর সাহিত্যকে মহনীয়তা প্রদান করেছে। মানুষ, প্রকৃতি এবং ঈশ্বর, এই তিন উপাদান মিলে গড়ে উঠেছে তাঁর মানসলোক, যা তাঁর সাহিত্যকথনকে দিয়েছে বিশ্বময় আলোকদ্যুতি।
আরিফুল ইসলাম সাহাজি
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত
বিষয়: আরিফুল ইসলাম সাহাজি

 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: