সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

মুষল ধারে বৃষ্টি - শায়লা জাবীন এর কবিতার বই : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:১৪

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০১:১৯

 

বহুদিন ধরে লেখালেখি করলেও ‘মুষল ধারে বৃষ্টি’ কবি শায়লা জাবীন এর প্রথম বই। সেই ছোটবেলায় স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখালেখির হাতেখড়ি। এরপর আর তিনি থেমে থাকেননি। লিখে গেছেন একাধারে। পরিবারের কেউ লেখালেখির সাথে যুক্ত না থাকায় সেগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি। খাটের তলার বাক্সে জমা থাকতো সেইসব লেখা। ঠিক যেমন কবি জীবনানন্দের সমস্ত লেখা জমা ছিলো একটা ট্রাংকে। যুগে যুগে কেন জানি কবিরা তাঁদের ভাব প্রকাশ করতে সবসময়ই ইতস্তত বোধ করেছেন। হয়তোবা উনারা সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকেন অথবা কবিতায় উঠে আসে প্রাত্যহিক জীবনের রুঢ় বাস্তবতা যেটাকে আমরা সাধারণত অস্বীকার করতে চাই। যাইহোক আমাদের কবি শায়লা জাবীন একসময় দেশান্তরিও হয়েছেন এবং বর্তমানে বসবাস করছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। দেশান্তরি হবার পর উনার লেখায় বহুমাত্রা যোগ হয়েছে। কবিতায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও পাশাপাশি লিখে চলেছেন গল্প, রম্য গল্প এবং বিষয়ভিত্তিক লেখা৷ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে সেগুলো প্রশংসা কুড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও কবি কখনওই ভাবেননি যে একদিন তার কবিতার বই প্রকাশ হবে।

যাইহোক মুষল ধারে বৃষ্টি'র কাছে ফিরে আসি। এই বইয়ে ছোট বড় মিলিয়ে কবিতা আছে মোট নব্বইটি। প্রত্যেকটা কবিতা বিষয়বস্তু বিবেচনায় একটার থেকে অন্যটা আলাদা৷ এতে একদিকে যেমন উঠে এসেছে বাংলাদেশের চিরায়ত সবুজ প্রকৃতি আবার উঠে এসেছে ঝঞ্চা বিক্ষুব্ধ আধুনিক সমাজ। একদিকে প্রকাশ পেয়েছে বাংলা ভাষার প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসা আবার অন্যদিকে উঠে এসেছে প্রবাসী কবির নিজ দেশের প্রতি টান। পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন সমস্যাগুলোকে নিয়ে হাস্যরসাত্মক কবিতাও লিখেছেন। তাই পড়তে যেয়ে বিরক্তি আসে না। আর বইটির মনকাড়া প্রচ্ছদ করেছেন ব্রত রায়। বইটা হাতে নিলেই মুষল ধারে বৃষ্টি'র সময়কার একটা শীতল অনুভূতি মনের মধ্যে খেলা করে। আপনার মনেহবে যেন আপনি আপনার গ্রামের বাড়ির বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে বসে আছেন। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম নেচে চলা আর উঠানের কোণার বড়ই গাছের পাতায় জমে আছে বৃষ্টির মুক্তোদানা। আর বইয়ের উৎসর্গপত্রটা দারুণ। উনি লিখেছেন 'সবসময়ই লেখালেখি করতে উৎসাহ দিয়ে যাওয়া সব বন্ধুবান্ধবদের'। এ থেকে লেখকের বন্ধু বৎসলতার পরিচয় পাওয়া যায়। আর কবিতা লেখার বিষয়ে কবি লিখেছেন 'কবিতা সবসময়ই দুর্বোধ্য ঠেকত গল্পের চেয়ে। গল্প মাথায় এলে সময় করে চুপচাপ বসে লিখে ফেলা যায় কিন্তু কবিতা একদমই অন্য কিছু। মাথায় দু'লাইন হুট করে চলে আসে, এরপরে না লেখা পর্যন্ত মাথায় ঘুরতে থাকে।'

এইবার কবিতার বিষয়বস্তুর দিকে নজর দেয়া যাক। বইয়ের প্রথম কবিতার নাম 'রোজা'। রোজা বিষয়ে আমাদের মধ্যে যেসব ভ্রান্ত ধ্যান ধারণা আছে সেগুলোর উল্লেখ করে কবি লিখেছেন

"সওয়াব কামানের ধান্দা
নতজানু কেন বান্দা?
অন্যায় আর জুলুম না করলেই তো
শিরদাঁড়া থাকতো উঁচা।"

এরপর জীবনের বিভিন্ন টানাপোড়েনের কথা উল্লেখপূর্বক অহেতুক কবিতায় লিখেছেন

"খালি খালি মিছে মিছি এত ভেবে কি হবে
যার যা হওয়ার ছিলো তার তো তাই হবে
অহেতুক ভেবে ভেবে সময়ের শ্রাদ্ধ
যা হয় তা ভালোই হয় সকলে যদি বুঝতো।"

এরপর কবি মনকে মেঘ বানিয়ে ভেসে বেড়ানোর কল্পনায় 'মেঘ' কবিতায় লিখেছেন

"শুধুই মেঘ জানে কত কষ্ট পুষলে
বরফ গলে কান্না আসে।
শুধুই পবন জানে ধুলিকণা ছেড়ে
ভারী পানি বইতে কেমন লাগে।
শুধুই আকাশ জানে কেমন লাগে
শূন্য হৃদয় নিয়ে মহাশূন্য শূন্যে ভাসতে।"

এরপর নিজের অস্তিত্বের খোঁজে 'আয়না' কবিতায় লিখেছেন

"আমি আসলে আয়নার মতো
পুরোটাই সত্য কিন্তু উল্টো প্রতিবিম্ব
সোজা দেখতে চাও
একটু মনের গহীনে তাকাও
সেখানে আমি নেই জানি
তবুও সেখানে থেকেই শুরু"

আবার 'আমি' কবিতায় লিখেছেন

"আমি তোমার চোখের পাতা মনের গোপন খবর
আমি তোমার শান্ত পুকুর সকাল সন্ধে খাঁ খাঁ দুপুর
..........................................................
............
আমি তোমার পূবের আকাশ মেঘহীন সাদা রোদ্দুর
আমি তোমার হিম ঠান্ডার কুয়াশা মোড়া চাদর।"

প্রেম এবং ভালোবাসাও মূর্ত হয়ে এসেছে কবির কবিতায়। 'প্রেম' কবিতায় কবি লিখেছেন

"প্রথম প্রেম সবসময় ভুল মানুষের সাথেই হয়
বুকের পাঁজর ঝাঁঝরা ক্ষতবিক্ষত হৃদয়"

আবার 'ভালোবাসা' কবিতায় লিখেছেন

"ভালোবাসার দেশ বিদেশ নেয়
থাকে সে হৃদয়ে
আর থাকে চোখের তারায়
যদি পারো বুঝে নিও"

'দিবস' কবিতায় লিখেছেন

"ভালোবাসতে লাগে হৃদয়, যা ৩৬৫ দিন সচল,
শুধু হারিয়ে ফেললে খুঁজতে থাকি বিশেষ কোন দিবস।"

এছাড়াও বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশের ইতিহাস স্বমহিমায় উঠে এসেছে কবিতায়। 'বাংলা' কবিতায় কবি লিখেছেন

"তোমাতেই শুরু,
তোমার মাঝেই স্বস্তি,
তোমাতেই মাধুর্য,
তোমার কাছেই শান্তি।"

এরপর স্বরবর্ণ কবিতায় লিখেছেন

"হ্রস্ব উ-তে উঠোন
দীর্ঘ ঊ-তে ঊনসত্তর
ঋ-তে ঋণ
উঠোনে ছড়ানো ঊনসত্তর থেকে ঋণ।"

এরপর আধুনিক সমাজের উপর ইথারিয় মাধ্যমের অনিবার্য হস্তক্ষেপের বিষয়গুলোও এসেছে কবিতায়। ফেসবুক নামক একটা অণু কবিতায় কবি লিখেছেন

"ঘুমানোর আগে ফেইসবুক দেখি
যেনো আঁখিতে ঘুম চলে আসে,
সকালে উঠেও ফেইসবুক দেখি
কেন নয়নে ঘুম না আসে।"

এছাড়াও ছুরুত মিঞা কবিতায় আধুনিক সমাজের বায়বীয় সম্পর্কগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। কবির ভাষায়

"ছুরুত মিঞা চুরুট খায় খেতে খেতে চুল আচড়ায়
এদিক সেদিক ও তাকায় মনের দুঃখে ধোঁয়া নাচায়"

এছাড়াও কবি নিজেকে হারিয়ে অহর্নিশ খুজেছেন মনের অলিতে-গলিতে। আবার কখনও বা অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোর প্রকাশ করেছেন কবিতার শব্দে। হারিয়ে পাওয়া কবিতায় লিখেছেন

"মাঝে মাঝে খুব হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে
কোথায় জানি না, কিন্তু দূরে, বহু দূরে
......................................................
না ফিরি যদি খোঁজ করো না, আছি মিশে ইথারে ইথারে
শ্বাস নিতে গেলে খুঁজে পাবে তবুও করেছিলে অবজ্ঞা।"

'জন্মান্তরে' কবিতায় আবার জন্ম নিলে ফিরে আসার আকাঙ্খা নিয়ে লিখেছেন

"রাজহাঁস ডানা লুকালো, পানকৌড়ি মুখ লুকালো
সকাল বেলার নরম আলো ঘাসের উপরের কুয়াশা শুকালো
ছোট ছোট ডিঙি নৌকা ছলাৎ ছলাৎ নদীর পানিতে
বড় জাহাজ নোঙর বিশাল সমুদ্রের বুকে।"

বইয়ের মুখবন্ধে কবি কবিতা পাঠের বিষয়ে বলেছিলেন যে কবিতা পাঠ সবসময়েই কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক পাঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই বইটা পড়ে আমার মনেহয়েছে এটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পাঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। কারণ এই বইয়ের শব্দ চয়ন, বাক্য গঠনে কবি কোন দুর্বোধ্য অলংকারের আশ্রয় নেননি। খুবই সহজ ভাষায় চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তাই পাঠক মাত্রেই কবিতাগুলোর সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস। পরিশেষে 'মুষল ধারে বৃষ্টি'র বহুল প্রচার কামনা করছি।

 

মো: ইয়াকুব আলী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top