সিডনী শুক্রবার, ১০ই মে ২০২৪, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩১

জলপাই রঙের দুঃখ : শফিক নহোর


প্রকাশিত:
১ নভেম্বর ২০১৯ ২২:২৭

আপডেট:
৩০ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৫০

 

আষাঢ় মাস ঘরের ঢোয়া একদিন গোবর দিয়ে লেপলে এক বেলার বেশি থাহে না । বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নেয় । জল বসন্তের মতো টেকরা-বেগরা দাগ হয়ে থাহে । আমার জল্লাদ শাশুড়ি তবুও বলবে , -আলপনা, বৌমা তোমার মা কাজকাম শিখাই নাই । কেমন করে ঘরের ঢোয়া লেপো এক দিনের বেশি থাহে না , কাম চোর কোথাকার ।

আমি কথা না শোনার ভান করে মনের আনন্দে কাজ করে যাচ্ছি , সকালে একমুঠো চাউল চাবিয়ে দুপুর পার করছি , শরীরের তেজ নাই আজ। রাতে জানোয়ার টা তিন-চারবার কাছে টানবে । আজ থেকে শুরু হয়েছে রক্ত ভাঙা । চোখ ঘুম ঘুম ভাব ধরছে ,খুব ক্ষুধা লাগছে ।শাশুড়ি সকালবেলা খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ।পাতিলের ভেতরে হাতের আঙুল দিয়ে , চাপ দিয়ে ভাতে হাতের ছাপ বসিয়ে রাখে । আমি যাতে চুরি করে একমুঠো ভাত না—খেতে পারি । খুব আউশ করে বাপের বাড়ি থেই-ক্যা এক খান শাড়ি আনছিলাম , গোসল করে কাপড় ছাড়াইয়া দিবার পরে সন্ধ্যায় শাড়ি খান অনেক খোঁজাখুঁজি র পর পেলাম না । আমার সাধের শাড়ি কিডা চুরি করছে , তা আমি জানি । একথা প্রমাণ করতে গেলে স্বামীর ভাত খাওয়া আমার জনমের মতো বন্ধ হয়ে যাবে । এ কথা সেকথা ভাবতে— ভাবতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হল । ঘরের ঢোয়া ঠিক আগের মত হয়ে গেল ।

জমিন থেকে আমার স্বামীর আসার সময় হল । দুঘরের মাঝখান থেকে জোড়ে একটা ডাক দিবে , আলপনা , - আমার জন্ন্যি এক গিলাশ পানি নিআঁয় । বুকের ভিতরে আমার ছ্যাঁত করে ওঠে । কাঁপা-কাঁপা হাতে পানির গিলাস তার সামনে ধরলে , ঢকঢক করে পানি খেয়ে আমার হাতে গিলাস দেয় , নিজের কাঁধের গামছা দিয়া মুখ-মোছে , আমার দিকে চোখ বড় করে চ্যাঁয় । গোরুর চাড়িতে পানি দে । দেখিস না সারাদিন গোরু পানি না খেয়ে পেট কেমন পড়ে আছে শিগ্‌গির গোরুর চাড়িতে পানি-দে কচ্ছি । 

- হারামজাদী মাগি বৃষ্টির ভেতর ধ্যান ধরে বসে আছিস ক্যা-নলো ।বৃষ্টিতে সবকিছু ভাসাই নিয়ে গেল ।কাপড়চোপড় গুলি ঘরে তোল, পোড়ামুখী। -এমন আনমনে হয়ে গিয়েছিলাম , আমার জল্লাদ শাশুড়ি জোরেশোরে ডাক না দিলে বুঝতেই পারতাম না , কখন যে এমন অন্যমনস্ক হয়ে বসেছিলাম । শ্বশুর সারাদিন বারান্দায় শুয়ে চিৎকার করবে , আমার শাশুড়ি একবারও অসুস্থ মানুষটাকে দেখতে আসবে না । পিছনের দরজা দিয়ে রান্না ঘর , কোনাকাঞ্চছি যাবে , তবুও স্বামীর দিকে ফিরে তাকাবে না । পাষাণ একটা মানুষ। ‘ছোটবেলায় আমার শাশুড়ি র মুখে মধু-দিয়েছিল না বলে তার মুখের সব কথা নিম পাতার মত ।’ এমন খারাপ মানুষ আমি জীবনে ও দ্যিহি নাই ।

শ্বশুর সারাদিন বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে এক গিলাস পানি চাইলে , এ বাড়িতে কেউ নিয়ে দিবে না ।বাঁদির মত আমি সারাদিন এ বাড়িতে খাটুনি করে কিছুই জোটেনি আমার কপালে । এ সংসারে এসে জীবনটা একেবারে জলাঞ্জলি দিয়ে দিলাম । ভরাপুরা গোলাম , চোখে দেখে —না সারাদিন এ সংসারে কি ভাবে খেটে মরি । ওর বাপ হয়েছে , আমার জানের আজরাইল আমি মরতেও পারছিনা কিছু বলতে ও পারছি না , আমার গলায় বিঁধে আছে পুঁটি মাছের কাঁটার মত । বুড়া মরলে তবুও একটু বাঁচতাম । সকালে ওঠে সারা বাড়ি ঝাড়ু দেওয়া গরু ছাগল বের করা , বাসনকোসন ধোয়ান ,বুড়ার গু , মুত ধোয়ান আমার হয়েছে যতো জ্বালা ।

‘ আল্লাহ্ এত মানুষের মরণ দেয় আমারে চোখে দেখে না , বাজারের ব্যাগ ছিঁড়া হলে বাজার করে কোনদিন পোষায় না, সংসারের আয় উন্নতি হয় না । মানুষটা সারাদিন মাঠে কাজ করে , সংসারের দামি জিনিস পত্র নবাবের বোন চুরি করে , তার শ্বশুর বাড়ি পাঠায় , তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আমার নিজের শাশুড়ি । ছেলের চেয়ে মেয়ে আপন হয়েছে , ‘ এক চোখে তেল আর এক চোখে পানি বিক্রি করে আমার দজ্জাল শাশুড়ি ।’ 

নাঙল জোয়াল গোয়াল ঘরে নাই রাখতে , আমার শাশুড়ি তার ছেলের কানঙানোনি দিচ্ছে , -কাশেম তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক আসছিল ,  খালি হাতে ,বল বাজান , কেউ কারো বাড়িতে খালি হাতে যায় , ছোটলোক কোথাকার ?' - তোমরাই তো আমার বিয়ে দিছো , তারা গরিব মানুষ , টাকা পাইবো কই , তাছাড়া তো আলপনাদের,বাড়ির লোকজন কেউ খারাপ না । - ইরে আল্লাহ্ রে ,আমার কাশেম কয় কি ?' তোর কি যাদু টাদু কিছু করছে না কি রে বাজান, আজই তোকে আমি মান্নান কবিরাজের কাছে নিয়ে যাবো ।' সর্বনাশ কেবা কথা কচ্ছিসরে গ্যাদা । -মাগি পোদ্দার বাড়ি পুকুর ঘাটে গোসল করে সন্ধ্যায় ভিজে কাপড়ে যেভাবে নাদুস নুদুস পাছা দুলিয়ে পাটক্ষেতের আইল দিয়ে আসে , কবে যেন শুনি । মাগিরে পাট ক্ষেতে নিয়ে বেহুঁশ করে ফেলে রাখছে । মণ্ডল বাড়ির ছাওয়াল পল এখন যে খারাপ হয়েছে। আমার ছাওয়ালের যাদু করে একেবারে বস করে ফেলছে , এর মজা আমি দেখাবো ।

কল পারে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেয়ে , আমার শাশুড়ি এগিয়ে এসে বলল , -আলপনা , ঢেঁকিতে ধান ভানতে হবে । তাড়াতাড়ি কিছু কাঁথা-কাপড় পরিষ্কার করে আমার সঙ্গে চলো । মুখখানি এমন কালো করে রাখবে মনে হবে গেরন লাগছে ।

আমার শাশুড়ি আমার কাজ মন্দ চোখে দেখবে , আমার কোন কাজ তার পছন্দ হবেনা । যখন যে কাজ করব তার একটা ভুল ধরবেই , এটা তার স্বভাবজাত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে । সকাল , সন্ধ্যা ,রাত সব সময় একই কথা , - বৌমা বাঁজা বাচ্চাকাচ্চা হয়না । ছেলেরে অন্য জায়গায় বিয়ে দিবে । আমার আড়ালে আবডালে অনেক কথা হয় । কিছু কথা কানে আসে ; ‘তখন মনে হয় সীসা গরম করে আমার কানের ভেতরে কেউ ঢালছে হরদম ।’ -ভাবি , তুমি কিন্তু ভাইকে বলবে , রফিককে যেন হাতঘড়ি কিনে দেয় ।‘ আমার স্বামী স্কুলের মাস্টার , তার হাতে ঘড়ি না থাকলে মানায় , সময় দেখে স্কুলে যাবে আসবে । আমাদের সংসারে নতুন অতিথি আসবে । তার জন্যি কত কিছু করতে হচ্ছে । তুমি বাঁজা , কখনো তোমার বাচ্চাকাচ্চা হবে না । ভাইকে বলো না কিছু জমি রফিকের নামে লিখে দিতে । মা তোমার ভয়ে , ভাইজানকে কিছু বলে না ।

-মা আমারে ভয় পায় ! -ভাবি তুমি এমন অবাক হয়ে চেয়ে রইলে কেন ?’ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে । আমি শেফালিকে কোন জবাব না দিয়েই ঘরে চলে গেলাম। ছোটবেলায় , মা –বাবাকে হারিয়ে ছিলাম , ভেবেছিলাম । শ্বশুর ,শাশুড়িকে নিজের বাবা মায়ের মতো দেখব । কিন্তু?' এসে যা পেয়েছি , পুকুর ভর্তি কুমির । মা মরে যাবার আগে জলপাই রঙের এক খান শাড়ি আমাকে দিয়েছিল । সেই শাড়ির লোভ আমার শাশুড়ি সামলাতে পারেনি । চুরি করে তার মেয়েকে দিয়েছে । শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে আছে আমার মায়ের ভালবাসা । মায়ের শাড়ি ছুঁয়ে  দেখলে মনে হয় , মাকে ছুঁয়ে দেখছি ; সেই শাড়ির কষ্টটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয় ক্ষণে- ক্ষণে। আমার শাশুড়ি নিজেরে ছেলেকে

ঠকিয়েছে , ছেলের বউকে ঠকিয়ে , অনাগত যে আসবে তাকে ঠকিয়েছে , শেফালির স্বামীর নামে যেদিন জমি রেজিস্ট্রেশন করল , ঠিক তার দুদিন পরে , আমার বমিবমি ভাব , টকের প্রতি লোভ বেড়ে গেল । বুঝতে বাকী রইল না , আমি মা হতে চলছি , হায়রে নিয়তি ।সবাই মা হলেও সত্যিকার মা কেউ-কেউ হতে পারে —না । আমার শাশুড়ি এক চোখে তেল এক চোখে পানি বিক্রি করেছে । শেফালি আজ আমার চুরি হয়ে যাওয়া জলপাই রঙের শাড়ি পরে ওর শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে— মা হতে ; আমি পথের দিকে অপলক চেয়ে রইলাম , আমার চোখ জলে ভরে আসছে

সবকিছু মলিন মনে হচ্ছে আমার কাছে ।

 

শফিক নহোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top