রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে রেখে দেয়ার প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের : মু: মাহবুবুর রহমান
 প্রকাশিত: 
 ২ আগস্ট ২০২১ ২১:১৬
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:২৬
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ(ইআরডি) কে জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। বিশ্বব্যাংকের দেয়া এ প্রস্তাবের বিপক্ষে মতামত দেয়ার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে চিঠিও দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও বলে রাখা দরকার বিশ্বব্যাংকের ঐ প্রস্তাবে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে খোলাসা করে কিছু বলা হয়নি। শুধুমাত্র উদ্বাস্তু নীতি পর্যালোচনা (Refugee Policy Review Framework) প্রস্তাব বলা হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে বিশ্বব্যাংক ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ কিংবা উদ্বাস্তু নীতি পর্যালোচনা শীর্ষক ঐ পলিসি পেপারটি পাঠায়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে মিলে এবং তাদের সুপারিশের আলোকে সংশোধিত ওই প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে উদ্বাস্তুরা যে সব দেশে রয়েছে সেসব দেশে অন্তর্ভুক্তিকরণ অর্থাৎ তাদের স্ব স্ব দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সহায়ক পরিবেশ তৈরি সংক্রান্ত প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের কথা বলা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কে’ তিনটি প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হয়েছে। এক) উদ্বাস্তু এবং হোস্ট কমিউনিটির জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি । দুই) উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে সেই দেশে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে একীভূতকরণ কিংবা আদিনিবাসে ফেরত পাঠানোর সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা । এবং তিন) হোস্ট কান্ট্রির সক্ষমতাকে এমন পর্যায়ে বাড়ানো যাতে উদার ওই রাষ্ট্রগুলো নতুন করে শরণার্থীর ঢেউ এলে পরিস্থিতি সামলাতে পারে অর্থাৎ আরও বেশি উদ্বাস্তু গ্রহণ করতে পারে ।
প্রস্তাবিত ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ টেকনিক্যাল নোটটি পাঠিয়ে ৩১শে জুলাই’র মধ্যে এ বিষয়ে বাংলাদেশের মতামত চেয়েছে বিশ্বব্যাংক। বলা হয়েছে- নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মতামত না পেলে প্রস্তাবটি বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে বলেই বিবেচ্য হবে। বাংলাদেশ এখনো বিশ্বব্যাংকের চিঠির জবাব দেয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব গ্রহণ করছে না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রস্তাবটির বিষয়ে অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবনার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আশঙ্কা, বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাব মেনে নিয়ে সংস্থাটি থেকে ঋণ নিলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বদলে চিরতরে বাংলাদেশে রেখে দিতে হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাবে পরিবর্তন আনা না হলে উদ্বাস্তু সংক্রান্ত কোনো অর্থ সংস্থাটির কাছ থেকে না নেয়ার কথাও বলা হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার মতে, বিশ্বব্যাংকের দেয়া প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হচ্ছে উদ্বাস্তু ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা, উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে, সেখানকার সমাজে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া অথবা তাদের ফেরত পাঠানো এবং নতুন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আশ্রয়দানকারী দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তাঁর মতে, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে নিলে রোহিঙ্গারা যেকোনো স্থানে চলাচল করতে পারবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বা ব্যবসা করতে পারবে। এ ছাড়া তাদেরকে নিবন্ধনের আওতায় এনে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হবে।
ঐ কর্মকর্তা জানান, আগে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা দেশগুলো এ তিনটি উদ্দেশ্য আকারে-ইঙ্গিতে বা মুখে বলত। এই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা সরকারের কাছে প্রস্তাব আকারে তা উত্থাপন করলো।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনই একমাত্র পথ:
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘‘এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য যদি আমরা এসব প্রস্তাব মেনে নিই তবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হোঁচট খাবে। এ জন্য আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।’’ তাঁর মতে, প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।
উদ্বাস্তু সমস্যা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এটি তিনভাবে সমাধান করা যায়। একটি হচ্ছে তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট (Third country settlement), আরেকটি অন্তর্ভুক্তিকরণ (Integration), এবং অপরটি হচ্ছে প্রত্যাবাসন (Repatriation)।
তিনি বলেন, আমাদের জন্য রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট সম্ভব নয়, কারণ তাদের সংখ্যাটি অনেক বড়। যদি রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৩০ বা ৪০ হাজার হতো তাহলে বিভিন্ন দেশে ভাগ করে দেয়া যেত কিন্তু সংখ্যাটি ১০ লাখের উপরে। এখন পৃথিবীর কোন দেশ এই পরিমাণ মানুষ নেবে না এটাই বাস্তবতা।
উদ্বাস্তু সমস্যার আরেকটি সমাধান হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিকরণ, কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ এবং এখানে প্রচুর শ্রমিক আছে। ফলে বাড়তি শ্রমিকের কোনো প্রয়োজন নেই এবং তাই অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনাও নেই বলে তিনি জানান।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘সুতরাং আমাদের জন্য একমাত্র অপশন হচ্ছে তাদের নিজ ভূমিতে টেকসই ও সম্মানের সাথে প্রত্যাবাসন।’
অন্তর্ভুক্তীকরণের বিষয়ে জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংক চিন্তা করতে পারে কিন্তু বাংলাদেশ এটি করতে পারবে না এবং এটি তাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, ‘গতবারই তারা আমাদের যখন এ ধরনের ভাষা বা পয়েন্ট বলেছিল তখন তাদের আমরা বলেছি যে এটি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের নজরে যেটি আসছে সেটি আমরা পয়েন্ট-আউট করছি এবং সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছে তাদের বলছি যে এ ধরনের শর্ত মানা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।’
রোহিঙ্গাদের শিক্ষার বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘যদি শিক্ষা প্রদান করতে হয় তাহলে মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী করতে হবে। কারণ আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই লোকগুলোর মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া। কিন্তু এমন কোনো ধরনের শিক্ষা যেখানে আমাদের এখানে অন্তর্ভুক্তি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে, এ ধরনের শিক্ষা আমরা দিতে চাই না।’
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্বব্যাংক কিছু অবজারভেশন দিয়েছে। যার কিছু কিছু আমাদের পছন্দ নয়। তাদের মূল কথা হলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন (অন্তর্ভুক্তি) করা। বাংলাদেশ উদ্বাস্তু সংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। তাই এগুলো গ্রহণ করতে আমরা বাধ্য নই। বিশ্বব্যাংক যেসব ইস্যু এনেছে সেগুলো আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আনেনি। ইউএনএইচসিআর সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অবজারভেশনের কথা উল্লেখ করলে আমরা বিষয়টি জানতে পারি। তখনই বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের এসব প্রস্তাব আমরা সংশোধন করতে বলেছি।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশের নেতিবাচক মনোভাব:
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)র অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক উইংয়ের প্রধান আব্দুল বাকী সর্বশেষ গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্বব্যাংক থেকে পাঠানো পলিসি ব্রিফটি শুধু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা বিশ্বব্যাপী যেখানে উদ্বাস্তু রয়েছে সেসব দেশের জন্য প্রযোজ্য। এ বিষয়ে সংস্থাটি বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে।
তিনি বলেন ইআরডি পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চেয়েছে। তাদের মতামত পেলে শিগগিরই ইআরডি থেকে বিশ্বব্যাংকের কাছে মতামত পাঠানো হবে। তবে এখন পর্যন্ত শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই মতামত দিয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের আমরা এখন পর্যন্ত উদ্বাস্তু হিসাবেই স্বীকৃতি দেইনি। সেখানে বিশ্বব্যাংকের পলিসি ফ্রেমওয়ার্কের সঙ্গে এর মিল থাকবে না। কাজেই আমরা নেতিবাচক মতামত দিতে যাচ্ছি।’’
অন্তর্ভুক্তি নয় প্রত্যাবাসনই হোক সবার চাওয়া:
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ যার আয়তন ১৪৮,৪৬০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১৬৩ মিলিয়নেরও বেশি। এমন একটি দেশের পক্ষে নতুনকরে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্তি একেবারেই অসম্ভব। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের তৈরি আর তাই এ সমস্যার সমাধানে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করলেই কেবল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার পথ খুলতে পারে। আর তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করাতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করা।
রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্পদ ব্যয় করছে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য অনেক দেশ তাদের দেখ-ভালের জন্য জাতিসংঘকে অর্থ প্রদান করে। এই অর্থ প্রদানের পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে এবং এর ফলে বাড়তি বোঝা বাংলাদেশের ওপর চাপানোর একটি চেষ্টা আছে বিদেশিদের। গত চার বছর ধরে কোনো প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া, বিদ্যমান করোনা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাইছে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান তথা স্বাবলম্বী করে তুলতে। এ জন্য অবাধ চলাচলসহ তাদের আইনগত সুরক্ষায় জোর দিচ্ছে বিশ্ব সম্প্রদায়।
যদিও বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশ রিফিউজি কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেনি বিধায় রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ বা উদ্বাস্তু’র মর্যাদা প্রদানে দেশটির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্তির পর্যায়েও নেই জনবহুল বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের সবার চাওয়া, অন্তর্ভুক্তি নয় প্রত্যাবাসনই হোক রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।
মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক 
বিষয়: মু: মাহবুবুর রহমান

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: