সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১


একাত্তরের মা : রওনক খান 


প্রকাশিত:
১৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:৩৫

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৩৪

 

রুনু, তোমার মনে আছে? 
তখন তোমার তেইশ চলছে, 
বাহাত্তরের পাঁচই জানুয়ারী 
তুমি ঝিনাইদহের নিজ পরিবার হতে 
প্রত্যাখ্যাত হয়ে ঢাকায় 
ফিরে এলে,  
তোমার জঠরের উষ্ণভূমে
রক্তমজ্জার সীমাহীন উত্তাপে
ক্রমশঃ পুষ্ট হচ্ছে 
আট মাসের এক জাতক
ধীর লয়ে বেজে চলেছে 
তার আগমন ধ্বনি। 

এক গোধূলী বেলায় তুমি 
ফুলবাড়িয়া বাস স্টেশনে এসে নামলে, 
তোমার সামনে কেবল আসন্ন অন্ধকার।  

এ শহরে তুমি তখন   ঠিকানাহীনা  
ছাদ বলতে ছিল কেবল মাথার উপরে
একটা আদিগন্ত আকাশ। 

সেই কৃষ্ণ পক্ষের রাতে 
তোমায় বুকে টেনে নিল প্রগাঢ় আঁধার।  
অবশেষে মিলেছিল স্বস্তির আশ্রয়। 
কমলাপুরে সদ্য প্রস্তুত এক মাতৃসদন। 
মনে আছে তোমার? 

সেখানে তোমারই মতন 
আরো কিছু নারী তাদের স্ফীত 
গর্ভ নিয়ে অজানা ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। 
তারপর এক সন্ধ্যায়, 
তোমার নাড়ী ছিঁড়ে জন্ম নিল 
একটি ফুটফুটে শিশু 
যুদ্ধ শিশু। 
তুমি কি আপ্লুত হয়েছিলে 
সদ্য মা হবার আনন্দে?
তোমাকে বিন্দুমাত্রও ম্রিয়মান দেখিনি তো। 
আরও অন্যান্যদের মতন! 

দেখিনি আসন্ন অন্ধকার ভবিষ্যতের ভাবনায়
বিচলিত হতে। 
যেদিন হোমের অফিস কক্ষে তোমাকে
ডেকে পাঠালেন সিস্টার জেনিফার
তুমি তখনও স্হির, অচঞ্চল।
 সদ্য ভূমিষ্ট শিশুটিকে পরম মমতায় স্তন্য দানে নিমগ্ন, 
তোমার শিরা উপশিরা বেয়ে মাতৃত্ব যেন চুঁইয়ে পড়ছে। 
তোমাকে ঘিরে রেখেছিল এক অপার্থিব শান্তি 
শিশুটিকে স্তনদান শেষে তাকে যত্নে কাঁথায় পেঁচিয়ে ক্যাম্প খাটটিতে শুইয়ে রেখে 
তবে তুমি উপস্হিত হলে অফিস কক্ষে । 
তেমন তাড়াহুড়ো ছিলোনা তোমার। 

এক বিদেশী দম্পতি সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষমান 
সদ্য ভূমিষ্ট শিশুটির দায় ভার
বয়ে নিয়ে যেতে চায়। 
সুদূর কানাডায়। 
মুক্তির আনন্দে কি তুমি 
উদ্বেলিত হয়েছিলে? 

অযাচিত মাতৃত্বের বাঁধন আলগা হবার
আশ্বাসে কি দুলে উঠেছিল? 

তবে তোমার চোয়াল দুটো অমন ঋজু
হয়ে উঠেছিল কেন?
হাত দুটো ক্রমেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছিল
এক অনির্বচনীয় জেদে,  
শরীরি ভাষা যেন স্পষ্ট বলেছিল
দৃঢ়চেতা রুনু নতশির হতে জানেনা 
তুমি যে একাত্তরের মা। 
ভাবনার অবকাশ দিলেনা কোন
কক্ষে উপস্হিত সবাইকে 
স্তম্ভিত করে দিয়ে
দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠেছিলে 
ও আমার সন্তান, আমার অস্তিত্ব, 
আমার কোলজুড়ে দিনরাতে 
খেলাকরে এক টুকরো স্বদেশ, 
আমি দেব না যেতে কোন বিভূঁইয়ে 
আমার রক্তপিন্ডে গড়া এক পূণ্য প্রাণ 
অবিরাম খেলা করে অযুত সুখে
তাকে আমি আলগা হতে দেবনা 
কোনমতে। 
পরভূমে নয়, 
আমারই উঠোন আলো করে 
বড় হবে সে।

তারপর কত সহস্র দিবস, রজনী
ঊনকোটি পল, অনুপল গেছে কেটে 
রুনু, তোমার খবর আর রাখা হয়নি তেমন করে 
কেমন আছ তুমি? একাত্তরের জননী আমার
কেমন আছে তোমার প্রাণাধিক স্বদেশ? 
খুব জানতে ইচ্ছে করে। 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়: রওনক খান


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top