দশম গ্রেড প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের অধিকার : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
 প্রকাশিত: 
 ৮ মার্চ ২০২২ ২২:৫২
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ১০:৩১
দেশ ডিজিটাল হয়। পাল্টে যায় অর্থনীতির সূচক। দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে চাওয়া-পাওয়া। শিক্ষার আলো সময়ের প্রয়োজনেই প্রতিটি মানুষের দ্বারে দ্বারে। শুধু পাল্টায় না শিক্ষকদের জীবনমান। বেতন স্কেলে তাদের জন্য থাকে না সম্মানিত কোনো স্কেল।
শিক্ষক নীতিবান হবেন, আদর্শকে ধারণ করবেন, জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় অন্যদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকবেন। সেই সঙ্গে দারিদ্র্যের দায়ও বহন করবেন, এটাই সবার ধারণা। ফলে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পার হওয়ার পর যখন বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশে পাল্টে গেছে অনেক চিত্র, তখন সনাতন চিত্র ধারণ করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে শিক্ষক তার স্থানে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের দেশের শিক্ষকদের চারগুণ। আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের চেয়ে একটি ‘এ’ ক্যাটাগরির সংবাদপত্রের পিয়ন, ঝাড়ু–দার, দারোয়ানের বেতন বেশি।
শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আসে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়, শিক্ষার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আর চাহিদার পরিবর্তন আসে, তাহলে যুগ যুগ ধরে শিক্ষাগুরু কেন থাকেন অবহেলিত?
শিক্ষা আর শিক্ষক দুটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার সাফল্য কী করে হবে? শুধু শিক্ষার উন্নয়নে চোখ ধাঁধানো পরিবর্তন সত্যিই কি মানুষের মনোজগতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে? বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে শিক্ষক যখন রাষ্ট্রীয় আর সামাজিকভাবে দিনের পর দিন অবহেলার শিকার হয়েছেন, তখন তিনি খুঁজেছেন বিকল্প পথ।
গুরু দ্রোণের মতো রাষ্ট্রীয় অপক্ষমতার কাছে যুগে যুগে শিক্ষককে নীরবতা পালন করতে হয়েছে। দহনে দহনে মরমে জ্বলে-পুড়ে খাক হতে হয়েছে। তারপরও আমরা দেখি এই শিক্ষকদের জ্বালিয়ে দেয়া জ্ঞানের আলোর প্রজ্বলিত আলোকশিখায় যুগে যুগে জেগে ওঠে মানবতা, আবির্ভাব হয় মুক্তিদাতার।
মানুষের চাহিদার ধরন পাল্টে গেছে। শুধু আদর্শকে ধারণ করে জীবনের সব ভোগ-বিলাস থেকে মুখ ফিরিয়ে জ্ঞানের আলো বিতরণের কাল এখন আর নেই।
শিক্ষকের সংসার-সন্তান আছে। গতিময় সমাজে সে স্বপ্ন দেখে উন্নত সম্মানিত এক জীবনের। সমাজের ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। আর্থিক মাপকাঠিতে মূল্যায়িত হয় মানুষ। সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলার মতো সংস্থান এবং উন্নত মানসম্মত এক জীবনের স্বপ্নই পারে একজন মানুষকে শিক্ষকতা পেশায় আসার অনুপ্রেরণা দিতে। যুগের পর যুগ আর্থিক অবহেলা এবং অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে সামাজিক অবমূল্যায়ন শিক্ষকদের বিকল্প পথ খুঁজে নিতে বাধ্য করেছে। ফলে শিক্ষক আজ ব্যবসায়ী এবং শিক্ষা আজ পণ্য।
পুলিশি প্রহরা, রাষ্ট্রীয় কঠোর আইন আর সামাজিক নীতিবাক্য বর্তমানে শিক্ষকদের তাদের পেশার প্রতি দায়িত্ববান করার জন্য যে প্রচেষ্টা তা কখনো ভালো মানুষ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারবে না।
কথায় আছে, পেটে খেলে পিঠে সয়। শিক্ষাকে যুগোপযোগী এবং মানসম্মত করার জন্য, মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, সর্বোপরি সত্য কথা বলার মানুষ সৃষ্টির জন্য শিক্ষার আগে শিক্ষকের কথা ভাবতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় দেশের সবচেয়ে মেধাবী এবং মননশীলদের সম্পৃক্ত করার জন্য এই পেশার মর্যাদা এবং বেতন স্কেল আলাদা করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, সমাজের সব পেশাই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু শিক্ষকতাকে সব পেশার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। উন্নত দেশের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সেসব দেশের শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান এবং অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকেও আমাদের অনুসরণ করতে হবে। শিক্ষাকে আধুনিক রূপ দেয়ার আগে শিক্ষককে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে অনেক পেশাজীবিদের বেতন স্কেলে। যেমনঃ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ছিল ১৪তম গ্রেডে। তারা এখন ১০ তম গ্রেডে।
ভূমি অফিসের তহশিলদার ১৭ তম গ্রেড থেকে ১০ তম গ্রেডে।
নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারা ১৬ তম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে।
নার্সেরা ডিপ্লোমা করে এখন ১০ ম গ্রেডে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতায় অনেক পেশাজীবিই দশম গ্রেডের কর্মকর্তা। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকবৃন্দ ১৩ তম গ্রেডের কর্মচারী।
মেধাবী শিক্ষক ছাড়া মেধাবী জাতি তৈরির স্বপ্ন দেখা বিফল। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষক দিয়ে প্রথম শ্রেণির নাগরিক তৈরির স্বপ্ন দেখা অন্যায়।
এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হবে। কিন্তু আজো সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। বরং আন্দোলনরত শিক্ষকদের ভাগ্যে জুটেছে মরিচের গুঁড়া। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রতিটি ধাপকে বিন্যস্ত করে সাজাতে হবে এবং সংস্কার করতে হবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘এখানে মেধাবীদের আসার কোনো রাস্তা রাখা হয়নি। বেকারত্বের চাপে বা ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে যদি কেউ শিক্ষক হতে আসেনও, তাকে বিরাট অঙ্কের ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকের নৈতিকতার মেরুদণ্ড থেকে থাকলে তা এর মধ্য দিয়ে ভেঙে পড়ে।’
‘থিওরি অ্যান্ড প্রবলেম’ নামের বইটির অন্যতম লেখক ক্রিস্টোফার জে ব্রডলির মৃত্যুর পর জানা যায় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি শেষ ১০ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ খ্রি. ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, সুইজারল্যান্ডে সর্বোচ্চ বেতন শিক্ষকদের। ৬৮ হাজার ডলার। ওই দেশে এর পরের সর্বোচ্চ বেতন ৫০ হাজার ডলার।
আমেরিকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নিযুক্ত হন বার্ষিক ৩৭ হাজার ৫৯৫ ডলার বেতনে। ১৫ বছর চাকরি করার পর ওই শিক্ষকের বেতন হয় ৪৬ হাজার ১৩০ ডলার। তার সর্বোচ্চ বেতন হতে পারে ৫৩ হাজার ১৮০ ডলার।
বাংলাদেশ আমেরিকা বা সুইজারল্যান্ড নয়। উন্নত দেশের মতো বেতন দেয়া এ দেশে সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের পাশে আছে পশ্চিমবঙ্গ, কথায় কথায় যাদের উদাহরণ আমরা দেখাই। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বেতন আর পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পার্থক্য আকাশ-পাতাল।
ব্রিটিশরা এ দেশের শিক্ষকদের ললাটে অসম্মানজনক বেতনের যে অপমান লেপন করেছিল আজো তার অবসান হয়নি। সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাদটীকা গল্পে পণ্ডিতমশাই তার ছাত্রদের যে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে দিয়েছিলেন আজো সে ছাত্ররা তার সমাধান দিতে পারেনি। পণ্ডিতমশাইয়ের ছাত্ররা মন্ত্রী হন, অর্থমন্ত্রী হন, দেশের কর্ণধার হন কিন্তু পণ্ডিতমশাইয়ের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারেন না।
শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। সুতরাং এ স্তরটিকেই মজবুত করতে হবে সর্বপ্রথম। এই স্তরেই প্রয়োজন সবচেয়ে মেধাবী, সৃজনশীল শিক্ষকের। রাজনৈতিক নগ্ন হস্তক্ষেপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় আনুগত্যের প্রতীক গড়ে তুলেছে।
প্রতিটি সফল মানুষের সফলতার নেপথ্যে থাকে তার আদর্শবান শিক্ষকের অনুপ্রেরণা। একটি জাতিকে সুসভ্য করে গড়ে তোলার পেছনে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সময় বদলে গেছে, বদলে গেছে জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব, পরবর্তী সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বায়নের পথে হাঁটার প্রয়োজনেই আমাদের শিক্ষকদের মেধা, মনন এবং আন্তরিকতায় হতে হবে অন্য সব পেশাজীবী থেকে আলাদা। ব্যবসায়ী থেকে হতে হবে গুরু।
দেশ ও জাতির প্রয়োজনেই দেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জন্য খোলা রাখতে হবে ‘শিক্ষকতা’ পেশার দ্বার। ঈর্ষণীয় বেতন স্কেল, উন্নত জীবনমান এবং মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানই পারে মেধাবীদের এ মহান পেশায় আকৃষ্ট করতে। সুতরাং, ভেবে দেখা উচিৎ তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী শিক্ষক দিয়ে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা কতটুকু যুক্তিসংগত।
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করেছে শিক্ষকবৃন্দ। একটি দেশকে মাথা তুলে দাঁড়াতে নিজেদের বঞ্চিত করেছে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। যে প্রয়োজনটা নীতি নির্ধারকদের এমনিতেই বোঝা উচিৎ ছিল, সে প্রয়োজন নিয়ে শিক্ষকদের আজ দাঁড়াতে হচ্ছে রাজপথে। এ লজ্জা কি শিক্ষকের, না এ জাতির?
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর কলংক তিলক ললাটে এঁকে বহুকাল দরিদ্র আর বঞ্চনাকে পাথেয় করে চলেছে এ দেশের শিক্ষা গুরুরা। এখন তারা গুরু দক্ষিণার আশায় দাঁড়িয়েছে পথে। 
দশম গ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি। এ দাবিকে অগ্রাহ্য করা অন্যায়। অধিকার বঞ্চিত করা পাপ। আশাকরি, এই সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন নীতি নির্ধারকবৃন্দ।
বিষয়: শাকিলা নাছরিন পাপিয়া

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: