চোদ্দো শাক : সিদ্ধার্থ সিংহ
 প্রকাশিত: 
 ২ নভেম্বর ২০২১ ২৩:৩২
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৩৫
                                
কালীপুজোর আগের দিন সকালে রীতি মেনে ‘চোদ্দো শাক’ কেনার ভিড় এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। প্রবীণদের আক্ষেপ, ‘ভূতচতুর্দশী’তে দুপুরের পাতে চোদ্দো শাক আর সন্ধ্যায় বাড়িতে চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানোর চল প্রায় ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম। তবু ভূতচতুর্দশীর আগে বিভিন্ন সব্জি বাজার ঘুরলে দেখা যায়, সব্জি বিক্রেতারাই মনে করে চোদ্দো রকম শাক কুঁচিয়ে, হয় পলি প্যাকে করে, আর তা না হলে ভাগা হিসেবে বিক্রি করেন। কেউ কেউ চোদ্দো রকম শাক একসঙ্গে বেঁধে আঁটি করেও বিক্রি করেন।
কালীপুজোর আগের দিন এই চোদ্দো শাক খাওয়াটা দীর্ঘদিনের রীতি। যদিও কালীপুজোর সঙ্গে চোদ্দো শাকের কোনও সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের মতে, শাকগুলোর প্রত্যেকটিতেই বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের প্রভূত গুণ রয়েছে। যদিও অধিকাংশ শাকই স্বাদে তেতো হওয়ায় অনেকেই সেগুলো পছন্দ করেন না।
ভুতচতুর্দশীতে প্রচলিত চোদ্দো শাক খাওয়ার কথা পাওয়া যায় ষোড়শ শতাব্দীর স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দনের লেখা 'কৃত্যতত্ত্ব' গ্রন্থে। যেখানে তিনি প্রাচীন স্মৃতির গ্রন্থ 'নির্ণয়ামৃত'-র অভিমতই অণুসরণ করেছেন। শ্লোকটি হল---
"ওলং কেমুকবাস্তুকং সার্ষপঞ্চ নিম্বং জয়াং।
শালিঞ্চিং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলূকং গুড়ুচিন্তথা।
ভণ্টাকিং সুনিষন্নকং শিবদিনে যদন্তি যে মানবাঃ
প্রেতত্বং না চ যান্তি কার্তিকদিনে কৃষ্ণ চ ভূতে তিথৌ।''
--- কৃত্যকৃত্ত্ব / রঘুনন্দন।
শাস্ত্রে উল্লিখিত এই চৌদ্দ শাক হল---
১ ওল (Amorphophallus campalunatus)
২ কেঁউ (Cheilocostusspeciosus)
৩ বথুয়া (Chenopodiam album)
৪ কালকাসুন্দে (Senna occidentalis)
৫ সরষে (Brassica campestris)
৬ নিম (Azadirachta indica)
৭ জয়ন্তী (Sesbania sesbans)
৮ শালিঞ্চে বা শিঞ্চে (Altemanthera sessilis)
৯ গুলঞ্চ (Tinospora cordifolia)
১০ পটল বা পলতা (Trichosanthes dioica)
১১ শেলুকা (Cordia dichotoma)
১২ হিলমোচিকা হেলেঞ্চা (Clerodendrum splendens)
১৩ ভাঁট বা ঘেঁটু (Enhydra fluctuans
১৪ সুনিষণ্ণ বা শুষনি (Marselliaquadrifolia)।
ভূতচতুর্দশীতে চোখে পড়ার মতো হলেও, আশ্বিন সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি এবং পয়লা বৈশাখেও চোদ্দো শাক খাওয়ার চল রয়েছে। 'চৌদ্দ' সংখ্যাটি এ দিক থেকে প্রতীকী। 
অনেকেই মনে করেন, এটা চালু হওয়ার পিছনে আসল কারণ ছিল, সারা বছর ধরে যে 'চাষ' হয়, তাতে অনাবাদী জাতি বা প্রজাতির গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণীর কী অবস্থা দাঁড়াল, তার খোঁজ নেওয়া।
কারণ, চাষ করতে গিয়ে আগাছা হিসেবে ধরে যে সব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণীদের কৃষক দমন করেছে, গজাতে দেয়নি, গজালেও উপড়ে ফেলে দিয়েছে, যাতে তার রোপন করা গাছপালা পর্যাপ্ত খাবার, সার এবং জল পেয়ে তরতর করে বেড়ে ওঠে, অন্য গাছপালা সেখানে থাবা বসাতে না পারে। 
এই চোদ্দো রকম শাক তোলা ও খাওয়ার মধ্যে দিয়েই বছর শেষে অন্তত একবার খতিয়ে দেখে নেওয়া হয়, ফসলের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে অনাবাদী ফসলের বিশাল ক্ষেত্র নষ্ট বা উপেক্ষিত হয়নি তো!কৃষিকাজ ঠিকঠাক মতো পরিবেশসম্মত হয়েছে তো!
গ্রাম বাংলার মানুষ বিশ্বাস করেন, চোদ্দো রকম শাক একসঙ্গে মিশিয়ে রান্না করে খেলে ঋতু পরিবর্তনজনিত নানান রোগব্যাধির হাত থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া হয়। 
এ ছাড়াও বাংলায় আরও অনেক অনাবাদী শাক পাওয়া যায়। যেমন আমরুল, কলমি, কুলেখাড়া, খারকোন বা ঘাটকোল, ব্রাহ্মী, ঢেঁকি, নুনিয়া বা নুন খুড়িয়া, তেলাকুচা, দণ্ডকলস, গিমা, থানকুনি, কাঁটানটে বা খৈরাকাটা, কচু, মালঞ্চ, কালমেঘ বা আলুই, বাসক, চুকোর বা টক ভেন্ডি, কস্তুরী, মোরগফুল ইত্যাদি। জায়গাভেদে যেমন এই শাকগুলোর নাম বদলে যায়, ঠিক তেমনি এগুলো ছাড়াও আরও নানা ধরনের শাক পাওয়া যায়। এই সব শাকের যে কোনও চোদ্দোটি জোগাড় করেও রীতি অনুযায়ী 'চৌদ্দ শাক' পালন করা হয়।
এই ধরনের অনাবাদী, মানে নিজে থেকে গজিয়ে ওঠা এই সব শাকপাতা সাধারণত বাড়ির আশপাশে, এমনকী খাল, পুকুর, ডোবা, খেতের আলে কিংবা যাতায়াতের পথের ধারেও পাওয়া যায়।
আগেকার দিনে এই শাক কুড়োনোর জন্য বাড়ির মেয়ে-বউরা রাত থাকতে উঠে এক-দু'মাইল, এমনকী তারও বেশি পথ পাড়ি দিত।
চৌদ্দ শাক রান্নার কোনও নির্দিষ্ট প্রণালী নেই। এক এক জায়গায় এক এক রকম ভাবে এই শাক রান্না করা হয়। আমিষ অথবা নিরামিষ যে কোনও ভাবেই এই শাক খাওয়ার রেওয়াজ আছে।
এ ক্ষেত্রে কোথাও কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা, ফোড়ন দিয়ে, কোথাও রসুন-শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, আবার কোথাও শুধু পাঁচফোড়ং দিয়েও চৌদ্দশাক ভাজা খাওয়া হয়। কোথাও কোথাও চৌদ্দশাক শুধুই ভাজা খাওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে আলু বা বেগুন দিয়েও ভেজে খাওয়ার প্রচলন আছে।
এই শাকগুলো আগাছার মতো জন্মালেও আয়ুর্বেদ মতে, এর খাদ্যগুণ এবং ভেষজগুণ অভাবনীয়। কোনও শাক খিদে বাড়ায়, কোনও শাক হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়। কোনও শাক বহুমূত্র, শ্বেতী, জ্বর এবং কৃমি নাশকের কাজ করে।
কোনও শাক আবার সদ্য প্রসূতিদের জন্য ভীষণ উপকারী, তো কোনও শাক খেলে বাত, রক্তচাপ, একজিমা জন্ডিস নির্মূল হয়। কোনও শাক আবার যে কোনও শ্বাসের রোগে ব্যাপক কার্যকরী।
কোনও শাক রক্তবর্ধক ছাড়াও লিভার ও চামড়ার রোগ সারাতে সাহায্য করে। কোনও শাক ক্যানসার দমনে সহায়ক। কোনও শাক স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে। কোনও শাক খেলে খুব ভাল ঘুম হয়, মেধা এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ে। কোনও শাক হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ এবং মানসিক অস্থিরতা কমানোর জন্য একেবারে অব্যর্থ ওষুধ।
উপেক্ষিত এই শাকপাতাগুলো রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে এবং মানুষকে সজীব, তরতাজা, প্রাণ চঞ্চল এবং সুস্থ রাখার জন্য যে কী পরিমাণ সাহায্য করে সেটা বলে শেষ করা যাবে না।
যেহেতু ঋতুর প্রকোপ অন্য প্রদেশের তুলনায় বাংলায় অনেক বেশি, তাই আগেকার দিনে আশ্বিন ও কার্তিক মাস দুটিকে যমদংস্টা কাল বলা হত। ফলে দেশের আপামর জনগণকে সুস্থ রাখার কথা ভেবেই মুনিঋষিরা বিধান দিয়েছিলেন, শুভদিনে এই সব শাক যে মানুষ খাবে, কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথির ভূতচতুর্দশীতে তার কাছে কোনও ভূতপ্রেত ঘেঁষতে পারবে না।
পঞ্জিকায় বর্ণিত আছে, আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথিতে কালীপুজোর একদিন আগে চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চৌদ্দ পুরুষের আত্মাকে তুষ্ট করে অশুভ শক্তিকে দূর করার প্রথা পালন করা হয় বলে এই দিনটাকে ভূতচতুর্দশী বলা হয়।
অনেকে অবশ্য মনে করেন, যখন সে ভাবে কীটনাশক বা সারের প্রচলন হয়নি, পাশাপাশি পোকামাকড়ের প্রচুর উৎপাত ছিল, তখন বছরের যে কোনও একটি বিশেষ দিনে, দিনের আলো সম্পূর্ণ চলে গেলে, সন্ধেবেলায় যখন কীটপতঙ্গদের ঘুমোবার কথা, তখন একই সঙ্গে সবাই মিলে, অনেকগুলো প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই সব ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে, ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে, তাদের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্যই চাষিরা এই রীতি পালন করা শুরু করেছিলেন।
সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
বিষয়: সিদ্ধার্থ সিংহ

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: