জীবনে সুখী হওয়ার উপায় : মোঃ শামছুল আলম
 প্রকাশিত: 
 ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:৫৮
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:১৪
                                
আমাদের ভালো কাজগুলোর প্রতিদান কি আমরা শুধু পরকালেই পাবো? নাকি এ দুনিয়ায়ও আমাদের জন্য কোন প্রতিদান আছে? কুরআন থেকে দেখে নেওয়া যাক এর উত্তর-
“পুরুষ বা নারী যেই সৎকর্ম করবে এবং ঈমান আনবে, আমরা তাদেরকে উত্তম জীবন (দুনিয়াতে) প্রদান করবো এবং তাদের উত্তম কাজের বিনিময়ে আমরা তাদের উত্তম প্রতিদান দান করবো।” (সুরা নহল, আয়াত-৯৭)
সুতরাং আমরা জানতে পারলাম এই পৃথিবীতেও একটি প্রতিদান রয়েছে এবং সেটি হচ্ছে উত্তম জীবন। কিন্তু উত্তম জীবন কী? উত্তম জীবনের অর্থ হল, প্রশান্ত জীবন যাপন করা। অর্থাৎ জীবনের সব দিক দিয়েই শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনযাপন করা। 
হযরত আলী (রা.) একে আত্মসন্তুষ্টির জীবন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। একইভাবে ব্যা্খ্যা করেছেন ইবনে আব্বাস, ইকরিমাহ এবং ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ। আলী বিন আবু তালহার সূত্রে ইবনে আব্বাসের অপর একটি মত এই সম্পর্কে পাওয়া যায় যাতে তিনি একে ‘সুখী জীবন যাপন’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
আপনি কি আপনার জীবনের আনন্দের চেয়ে বেশী অশান্তি অনুভব করেন? এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো এই ধরণের অনুভূতির কারণ কী?
কিছু বদ অভ্যাস দূর করতে পারলে সুখী জীবনযাপন করা সম্ভব তা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে দেখানো হল।
১. সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার ইচ্ছে ত্যাগ করুনঃ
আপনি কি সবসময়ই কোনো কাজে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি আপনার অনূকুলে নিয়ন্ত্রণ করতে চান এবং তা না করতে পারলে ভেঙে পরেন? আল্লাহর উপর ভরসা করে আপনার সম্পূর্ণ চেষ্টা করুন এবং ফলাফলের জন্য একমাত্র তারই উপরই নির্ভর করুন লাউৎসের ভাষায়-
‘যা চলে গেছে, তাকে চলে যেতে দাও।’এর মাধ্যমে আপনি জীবনের প্রশান্তি অনুভব করতে সক্ষম হবেন।
“(আল্লাহ) পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের প্রভু, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, সুতরাং তাঁকেই তোমার কর্ণধাররূপে গ্রহণ করো।” (সূরা মুজাম্মিল, আয়াত-৯)
২. অভিযোগ করা পরিহারঃ
জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অভিযোগ করা বন্ধ করুন। অভিযোগ করার মাধ্যমে আপনি সম্মান অর্জন করতে পারবেন না। এটি বরং আপনাকে বিষণ্ণই করবে। ইতিবাচক চিন্তা খুবই শক্তিশালী! ফুলের মধ্যে কাঁটার জন্য আপনি অভিযোগ করতে পারেন অথবা কাঁটার মধ্য দিয়েই আপনি ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। 
মুসলিম শরীফের হাদীস অনুসারে-
“তোমার চেয়ে নিচুঁ অবস্থানের লোকদের নিয়ে চিন্তা কর, তোমার চেয়ে উঁচু অবস্থানের ব্যক্তিদের দিকে খুব চিন্তা করোনা, যাতে করে আল্লাহ তোমাকে যে নেয়ামত দিয়েছেন, তা যেনো তোমার চোখে নগণ্য মনে না হয়।”
৩. নিজেকে সর্বদা সঠিক প্রমাণের প্রবণতা থেকে বিরত থাকুনঃ
আপনি কি তর্ক করে হলেও সবসময়ই নিজের কথাকে সঠিক প্রমাণ করতে চান? তাহলে এটি আপনার জন্য অশান্তির কারণ।
আবু দাউদে বর্ণনা করা হয়েছে-
“আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, যে তার কথা সঠিক হওয়া সত্ত্বেও তর্ক পরিহার করেছে।” 
৪. সমালোচনা বাদ দিনঃ
আপনার সমালোচনার কারণ কি? আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য নাকি আপনার নিজের ইমেজ বৃদ্ধির জন্য? সর্বদা অপরের সমালোচনায় মগ্ন হলে তা আপনার শান্তি নষ্টের পাশাপাশি আপনাকে অন্যদের অপচ্ছন্দনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করবে। বুখারীর বর্ণনা অনুসারে-
“লোকদের জন্য যাবতীয় বিষয়কে সহজ কর, কখনো্ই কঠিন করোনা; তাদের আনন্দিত কর, অসন্তুষ্ট করোনা। (যাতে তারা দ্বীন হতে পালিয়ে যায় এবং ভালোকে ঘৃণা করতে শুরু করে।)”
৫. নিজেকে বড় দেখানোর প্রবণতার পরিহারঃ
নিজেকে বড় করে দেখানোর প্রবণতা আপনার সাফল্যের পথে বাধাস্বরূপ। বরং বিশ্বাস ও উত্তম কাজই আপনাকে বড় করে তুলতে পারে। সুতরাং নিজের থেকে এই বিধ্বংসী প্রবণতা ঝেড়ে ফেলুন। আপনি নিশ্চিতভাবেই বড় হয়ে উঠবেন। কুরআনে বলা হয়েছে-
“পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করছে, তারাই সৃষ্টজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম।” (সুরা বাইয়েনা, আয়াত-৭)
৬. অপরকে দোষারোপের পরিহারঃ
‘তার দোষ, তার দোষ, আমার না’, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আপনি নিজের জন্য যা পছন্দ করেন না, তা অপর একজনের কাঁধে সবসময়ই চাপিয়ে দিচ্ছেন?
আপনার এই ধরনের মনোবৃত্তির পরিবর্তন আপনার জীবনকে সুখে ভরিয়ে তুলবে। কুরআন কারীমে বর্ণিত হয়েছে-
“যে কেউ সৎকর্ম করে থাকে, সেটি তো তার নিজের জন্যেই, আর যে কেউ মন্দকাজ করে সেটি তো তারই বিরুদ্ধে। আর তোমার প্রভু তার বান্দাদের প্রতি কখনোই অন্যায় করেন না।” (সুরা ফুসসিলাত, আয়াত-৪৬)
৭. নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা পরিহারঃ
কখনোই কাউকে অনুকরণ করতে যাবেন না। নিজের প্রতি অপরকে আকর্ষণের চেষ্টা আপনাকে সবসময় মানসিক চাপের মধ্যে রাখবে। অন্যদিকে, আল্লাহকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা আপনার সুখী জীবনযাপন এবং পরকালে নিরাপত্তার কারণ হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন-
“অন্য পন্ডিতদের সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য বা মূর্খলোকদের সাথে তর্ক করার জন্য অথবা অপরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যে জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” (তিরমিজি) 
৮. অধিক দুনিয়াবী মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসুনঃ
দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী জেনেও আমরা এর সাথে খুব বেশী সংশ্লিষ্ট হয়ে পরি। যার ফলে এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার কিছু হারিয়ে গেলে আমরা খুব ভেঙে পরি। সুখী জীবন যাপনের জন্য তাই এই প্রবণতা আমাদের পরিহার করা উচিত। রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালে হযরত আবু বকর (রা.) সাধারন মুসলমানদের সান্তনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন-
“হে মানুষ! শুনে রাখো যারা মুহাম্মদের ইবাদত করতে, মুহাম্মদ মরণশীল মানুষ, কিন্তু যারা আল্লাহর ইবাদত করতে, তারা জেনে রাখো আল্লাহ চিরঞ্জীব।” 
অর্থ্যাৎ, দুনিয়ার জীবনে যার সাথেই সম্পর্ক হবে, সেও একদিন ছেড়ে চলে যাবে। তার সাথে অধিক সংশ্লিষ্টতায় জড়িয়ে পরলে তার অনুপস্থিতিতে বরং অধিক দুঃখ পেতে হতে পারে। সুতরাং সর্বদাই আমাদের উচিত, দুনিয়ার যে কোনো বস্তুর সাথে অধিক সংশ্লিষ্টতা পরিহার করে চলা।
৯. অজুহাত পরিহারঃ
কোনো কাজেই সর্বদা অজুহাত দেওয়ার প্রবণতা পরিহার করুন। এটি আপনার সুখী জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে।
রাসূল (সা.) বলেছেন-
“মানুষকে ততক্ষণ পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হয়না, যতক্ষণ না তারা তাদের কর্মকান্ডের জন্য অজুহাত দেওয়া শুরু করে।” (মিশকাত)
১০. অতীতকে পরিহারঃ
সুখী হতে চাইলে নিজের অতীতের ভুলের জন্য পরিতাপ করা পরিহার করুন। বরং নিজেকে বর্তমানের জন্য প্রস্তুত করুন এবং বর্তমানকে উপভোগ করুন। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন-
“কোনো অনুতাপই অতীতকে পরিবর্তন করতে পারবেনা এবং কোনো আশংকাই ভবিষ্যতকে পরিবর্তন করে ফেলবেনা। আল্রাহর নির্ধারিত বিষয়সমূহকে মেনে নিয়েই সহজভাবে জীবনকে পরিচালনা কর।”
১১. ভয়কে পরিহারঃ
ভয় শুধুই এক প্রকার কল্পনা এবং এটি বরং মা্নসিক পীড়াই অধিক বৃদ্ধি করে। সকল প্রকার ভয়কে পরিহার করে শুধু আল্লাহকে ভয় করতে পারলে আপনার জীবন হতে পারে উদ্বেগমুক্ত সুখী জীবন। কুরআনে আল্লাহ বলেন-
“নিঃসন্দেহে তোমাদেরকে সেই শয়তানই ভয় দেখায় তার বন্ধুবান্ধবের, কিন্তু তোমরা তাদের ভয় করো না, বরং আমাকে ভয় করো, যদি তোমরা ঈমানদার হও।” (সুরা ইমরান, আয়াত- ১৭৫)
১২. অন্যের প্রত্যাশা অনুযায়ী জীবনযাপন পরিহারঃ
অপরের মন্তব্যের জন্য সতর্ক হয়ে জীবনযাপনের মধ্যে বরং আমাদের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দই নষ্ট হয়। মানুষকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা খুবই কঠিন। এরচেয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা অধিক সহজ এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়।
রাসূল (সা.) বলেছেন-
“কেউ যদি মানুষের অসন্তোষের বিনিময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করে, তবে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং লোকের হৃদয় তার দিকে ঘুরিয়ে দেন। আর কেউ যদি আল্লাহর অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও লোকের সন্তুষ্টি কামনা করে তবে আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন এবং লোকের অসন্তুষ্টিও তার প্রতি ঘুরিয়ে দেন।” (ইবনে হিব্বান)
মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক
বিষয়: মোঃ শামছুল আলম

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: