কুরবানীর শিক্ষা, গুরুত্ব ও ফজিলত : মো: শামছুল আলম
 প্রকাশিত: 
 ২৭ জুন ২০২৩ ২২:৫৩
 আপডেট:
 ২৭ জুন ২০২৩ ২২:৫৬
                                
আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা ঊর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে উৎপন্ন। আরবী ‘কুরবাতুন’ এবং ‘কুরবান’ উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা প্রভৃতি। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে ১০ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গৃহপালিত হালাল পশু আল্লাহর নামে উত্সর্গ করাকে কুরবানি বলে।
জাকাত ও কুরবানির নেসাবের সময়সীমা নিয়ে পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো-জাকাতের নেসাব পূর্ণ এক বছর ঘুরে আসা শর্ত; কিন্তু কুরবানির নেসাব পূর্ণ এক বছর ঘুরে আসা শর্ত নয়। কেবল জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ এই তিন দিনের যে কোনো একদিন নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই কুরবানি ওয়াজিব হবে। (ফতোয়ায়ে শামি)।
কুরবানির ইতিহাস:
মানব ইতিহাসের প্রথম কুরবানিদাতা হলেন আদি পিতা হজরত আদম (আ.)- এর পুত্র হাবিল ও কাবিল। দুনিয়ার প্রাথমিক অবস্থায় আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর একটি ছেলে ও একটি মেয়ে একসাথে জন্মগ্রহণ করতো। পরবর্তী গর্ভে অনুরূপ একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করতো। তখন পূর্ব গর্ভের ছেলে মেয়ের সাথে পরবর্তী গর্ভের ছেলে-মেয়ের বিবাহ দেয়া হতো। হাবীলের যমজ বোন সুন্দরী ছিল না। কিন্তু কাবীলের যমজ বোন সুন্দরী ছিল। তৎকালীন শরীয়ত অনুপাতে হাবীলের বিবাহ কাবীলের যমজ বোনের সাথে আর কাবীলের বিবাহ হাবীলের যমজ বোনের সাথে হবার কথা। কিন্তু কাবীল তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
আদম (আঃ) কাবীলকে অনেক বুঝালেন। কিন্তু সে বুঝতে চেষ্টা করল না। অবশেষে আদম (আঃ) উভয়কে আল্লাহ তা‘আলার নামে কুরবানী পেশ করার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন: যার কুরবানী কবূল হবে কাবীলের যমজ বোন তার সাথে বিবাহ দেয়া হবে।
হাবীল ছিল মেষওয়ালা, ফলে হাবীল একটি মোটা তাজা মেষ কুরবানীর জন্য পেশ করল। আর কাবীল ছিল কৃষক, সে কিছু গমের শীষ কুরবানীর জন্য পেশ করল।
আসমান থেকে আগুন এসে হাবীলের কুরবানী জ্বালিয়ে দিল, যা কবূল হবার নিদর্শন। কাবীলের কুরবানী গ্রহণ করা হল না। ফলে হিংসায় সে হাবীলকে হত্যা করার মনস্থ করল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন- আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান। যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না।…অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কুরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ২৭)।
এতে প্রতীয়মান হয়, কুরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া, অর্থাৎ খোদাভীতির প্রয়োজন। লোক দেখানো কোনো ইবাদত আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না।
তারপর থেকে প্রত্যেক যুগেই ধারাবাহিকভাবে কুরবানির এ বিধান সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে যুগে যুগে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রিয়বস্তু উৎসর্গই আজকের কুরবানি। এ কথার প্রমাণে মহান আল্লাহ বলেন-
‘আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য (কুরবানির) নিয়ম করে দিয়েছি। তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিজিক দেওয়া হয়েছে সেগুলোর উপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (এই বিভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতির মূল লক্ষ্য কিন্তু এক- আল্লাহর নির্দেশ পালন)। কারণ তোমাদের মাবুদই একমাত্র উপাস্য। কাজেই তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ কর আর সুসংবাদ দাও সেই বিনীতদেরকে।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)
অবশেষে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.) ঐতিহাসিক ঘটনার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে কুরবানীর দাওয়াত পৌঁছে দিলেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানীর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
অতঃপর সে পুত্র (ইসমাইল আলাইহিস সালাম) যখন পিতা ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন সে বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করেছি। এবার চিন্তা করে বল, তোমার অভিমত কী ? পুত্র বলল আব্বাজী! আপনাকে যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ্, আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন। সুতরাং (তা ছিল এক বিষ্ময়কর দৃশ্য) যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে (জবেহ করার উদ্দেশ্যে) শুইয়ে দিলেন, আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম; হে ইব্রাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমি সৎকর্মশীলদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিলো এক স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে সে শিশুকে মুক্ত করলাম। (সূরা আস-সাফফাত আয়াত নং ১০২-১০৭)
কুরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত:
কুরবানি হলো ইসলামের একটি মহান নিদর্শন। কুরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন-‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানি কর।’ (সূরা কাউসার, আয়াত-২)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে’। (ইবনে মাজাহ-৩১২৩)। যারা কুরবানি পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্কবাণী।
কুরবানির রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জিত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না উহার (জন্তুর) গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। (সূরা হাজ্জ, আয়াত-৩৭)।
কুরবানিতে গরিব মানুষের অনেক উপকার হয়। যারা বছরে একবারও গোশত খেতে পারে না, তারাও গোশত খাবার সুযোগ পায়। কুরবানির চামড়ার টাকা গরিবের মাঝে বণ্টন করার মাধ্যমে তাদের অভাব ও দুঃখ মোচন হয়। অপরদিকে কুরবানির চামড়া অর্থনীতিতে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে।
কোরবানির ঈদ-পালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কোরবানি করে থাকে।
পশু কোরবানি একটি প্রতীকি ব্যাপার। এখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল থেকে শুরু করে সবকিছুই কোরবানি করতে প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয় তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের ভুলে ভরা এবাদত-বন্দেগী ও কুরবানিগুলোকে কবুল করে দুনিয়া ও আখিরাতের অশেষ জাযাক দান করুন। আমিন।
মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক
বিষয়: মোঃ শামছুল আলম

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: