যে গাছ দেখে আমরা থমকে দাঁড়াই! : সালেক খোকন
 প্রকাশিত: 
 ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:২৪
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ১০:২৫
বসন্তে পাতা ঝরে। কোকিল ডাকে। আমের মুকুলের গন্ধে মন মাতে। চোখ রাঙে শিমুলের লাল ফুলে। মন হারিয়ে যায় অন্য কোনোখানে। হারিয়ে যাওয়ার আকুতি যখন আকাশছোঁয়া তখনই আমন্ত্রণ পাই দিনাজপুর যাওয়ার। ঐতিহাসিক স্থান তো আছেই, শালবন আছে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার জন্য। পাতা ঝরার এই সময়ে শালবন নাকি অন্যরকম।
বিরলের প্রাকৃতিক শালবনটি উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বন্ধুবর বাবুর বাড়ি বিরলে। মুঠোফোনে তার শালবনের বর্ণনায় মজে যাই আমরা। আরেক বন্ধু মুন্নাও আগ্রহ দেখায়। তাই শহরের কোলাহলকে বিদায় জানিয়ে দুই বন্ধু রওনা হই দিনাজপুরের উদ্দেশে। দিনাজপুর শহরটি বেশ পরিপাটি। বন্ধুপত্মীর জন্য মিষ্টি কিনতে গিয়ে খানিকটা ঘুরে দেখি।
শহর থেকে বিরল সদরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। অচেনা জায়গায় রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর আনন্দই আলাদা। আমরা একটি রিকশায় চেপে বসি। ভাড়া মাত্র ৭০ টাকা। দিনাজপুর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুনর্ভবা নদী। ব্রিজ দিয়ে পুনর্ভবা পেরিয়ে চলতে থাকি দক্ষিণমুখে, বিরলের রাস্তায়। দুই পাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফসলের মাঠ। ধান লাগাতে ব্যস্ত সবাই। এক কৃষক ক্লান্তি কাটাতে আঞ্চলিক ভাষায় গাইছিল ‘তুই যদি মোর হলু হয় বন্ধু, মুই হনু হয় তোর।’ রাস্তার লাগোয়া আমগাছগুলোতে জেঁকে ধরেছে মুকুল। তা থেকে মনের আনন্দে মধু নিচ্ছে মৌমাছিরা। দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক। মন কেমন করে ওঠে। গান ধরে মুন্না ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ।’
চারপাশের দৃশ্যতে মন রাঙিয়ে একসময় পৌঁছে যাই বিরলে। বন্ধু পরিবারের আতিথেয়তায় ক্লান্তি দূর হয়। দুপুরে খাওয়ার পর গরুর খাঁটি দুধের এক কাপ চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠি। উপজেলা সদর থেকে শালবন মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। বাবুর জিপে চড়ে বেরিয়ে পড়ি। খানিক সামনে যেতেই গাড়ির গতি কমে। তাকিয়ে দেখি, রাস্তার পাশে দুটি পাকা কবর। শহরমুখী বাসগুলো কবরের সামনে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। যাত্রীরা কবরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে পয়সা। ড্রাইভার জানালেন, এটি মুল্লুক দেওয়ানের মাজার। এখানকার সবাই তাকে সত্যপীর বলেন। মাজার পেরিয়ে ছুটে চলি সীমান্তমুখী রাস্তা ধরে। পৌঁছে যাই কালিয়াগঞ্জ বাজারে। দেখে মনে হলো, হাট বসেছে। নানা জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে আদিবাসীরা। নিজেদের ভাষায় কথা বলছে তারা।
বাজার পেরিয়ে বাঁয়ের রাস্তা ধরে আমরা এগোই। কিছুটা গিয়েই দূরে শালবন দেখতে পাই। জলরঙে আঁকা কোনো ক্যানভাস যেন। রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে আমরা ঢুকে পড়ি বনের ভেতর। শুকনো পাতায় পা রাখতেই মড়মড় শব্দে শালবনের নীরবতা ভাঙে। গাছগুলোতে অনেক পাখির কলকাকলি। কোকিল, টিয়া, ঘুঘু, ময়না আরও কত কি! তাদের আনন্দ-আড্ডায় মুখরিত চারপাশ। বনের মধ্যে একটি গাছ দেখে আমরা থমকে দাঁড়াই। অজগর সাপ আকৃতির একটি গাছ জড়িয়ে রেখেছে বেশ কিছু শালগাছকে। স্থানীয়রা গাছটিকে বলে ‘বাদেনা’।
হঠাৎ চারপাশ থেকে অদ্ভুত ধরনের শব্দ পাই। মনে হচ্ছিল কিছু একটা ধেয়ে আসছে। আমরা ভড়কে যাই। এটি আসলে বাতাসে শালপাতা নড়ার শব্দ। মুনড়বার ভাষায় পাতার মিছিল। প্রাকৃতিক নিয়মে শালবীজ পড়ে বন তৈরি হওয়ার কারণেই নাকি বনটিকে প্রাকৃতিক শালবন বলা হয়। বিট অফিসার শরিফুল তেমনটিই জানান। শালবনটি প্রায় ২৮৬৭ একর এলাকাজুড়ে। বনের মধ্যে শালগাছ ছাড়াও রয়েছে আমলকী, সর্পগন্ধা, বহেড়া, হরীতকী, চিরতাসহ নানা ধরনের ঔষধি গাছ। একটি ছোট্ট রেস্ট হাউসও রয়েছে এখানে। রেস্ট হাউস ছাড়িয়ে আমরা প্রবেশ করি পাশের শালবনে। এর নাম মিরা বন। বনের মধ্য দিয়ে খাল আকৃতির নদী চলে গেছে ভারতে। বনটিতে একসময় দেখা মিলত বাঘসহ হিংস্র সব জানোয়ারের। এখন মেলে শেয়াল, খরগোশ, বন মোরগ ইত্যাদির।
মিরাবনে ঢুকেই হারিয়ে যাই অন্যরকম দৃশ্যের মধ্যে। কোনো গাছেই যে পাতা নেই! জমিনে বিছিয়ে থাকা শালপাতা কুড়াচ্ছিল আদিবাসী নারীরা। ওঁরাও সম্প্রদায়ের মলানী টিগ্গার কাছে শুনতে পাই শালপাতার কথা। আদিবাসীরা এই পাতা দিয়ে তৈরি করে হাড়িয়া খাওয়ার চোঙ আর অতিপ্রিয় পাতার বিড়ি। মিরা বন থেকে আমরা চলে আসি ভটিয়া বনে। এই বনের একটি গাছকে পূজা করে আদিবাসীরা। গাছটির নাম খিল কদম। আমরা মনোযোগ দিয়ে গাছটি দেখতে থাকি। খানিক এগিয়ে কয়েকজন আদিবাসী শিকারির দেখা পাই। তাদের হাতে কয়েকটি মৃত খরগোশ ও ঘুঘু। তাদের পেছন পেছন আমরাও পা বাড়াই। ততক্ষণে সূর্য ঘরে ফেরার আয়োজন করছে। আমরা আর বনে থাকি কেন? তবে শুনেছি রাতের বনও ভারি সুন্দর। অন্যবারের জন্য তা তোলা রইল।
ছবি স্বত্ত্ব: সালেক খোকন
সালেক খোকন
লেখক ও গবেষক
বিষয়: সালেক খোকন

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: