ধওলছিনা: এক পার্বত্য রূপকথা : ডঃ গৌতম সরকার
 প্রকাশিত: 
 ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০২:৫৬
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ২০:৩৪
                                
বেড়াতে গিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার পথে আশপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে দেখতে যাওয়া ব্যাপারটা আমরা খুব উপভোগ করি। আর কুমায়ুন-গাড়োয়ালের ইতিহাস গুলে খাওয়া যোশীজি সঙ্গে থাকলে কোনো ভাবনা নেই। আপনি না চাইলেও উনি ইতিহাস সমৃদ্ধ জায়গাগুলোর কাহিনী শোনাতে শোনাতে দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাবেন ৷ এভাবেই পেরিয়ে গেলাম - রানিখেত গল্ফ কোর্স, কালিকা টেম্পল ( একটি সতী পীঠ, কিংবদন্তী এখান থেকে কালী মূর্তি নিয়ে গিয়ে কলকাতার কালীঘাটে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে), কাটারমল সূর্য মন্দির (ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সূর্যমন্দির), আর আলমোড়ার চিতাই গোলু দেবতা মন্দির। সবকিছু দেখতে দেখতে দুশো কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যখন ধওলছিনায় পৌঁছলাম তখন স্লেট রঙা আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ গাছগাছালি ভরা ধওলছিনার মাথার উপর উঁকি দিচ্ছে ৷
ধওলছিনা কুমায়ুন হিমালয়ের কোলে লুকিয়ে থাকা এক পার্বত্য হ্যামলেট ৷ কোথাও নাগরিক কোলাহল নেই, প্রকৃতির বারান্দায় বসে অলস সময় যাপনের এক আদর্শ ঠিকানা৷ পরদিন প্রভাতিক ভ্রমণে বেরিয়ে পাইন ঘেরা রাস্তা ধরে এগিয়ে এখানকার একমাত্র রাজকীয় কলেজের দেখা পেলাম ৷ পিচ রাস্তা ছেড়ে একটা ইঁট বসানো রাস্তা উৎরাইয়ে নেমে গেছে। কলেজে পৌঁছে আশপাশ দেখতে দেখতে একটা 'কিরকিরে' আওয়াজ কানে এল। প্রথমে ভাবলাম গাছের পাতা নড়ছে, ওপরে তাকিয়ে দেখতে চোখে কি যেন পড়ল, ভাবলাম বৃষ্টি হচ্ছে… তারপরই আমাকে চমকে দিয়ে সাবু দানার চেয়ে বড় আর নকুল দানার থেকে ছোট ছোট শিলা পড়তে লাগল। আমি তো অবাক ! এ যে না চাইতেই অকৃপণ প্রকৃতির অমূল্য উপহার। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশ সাদা গুঁড়ো শিলায় ভরে উঠলো। তবে কিছুক্ষণ পর শিলাবৃষ্টি থেমে গেল ৷ এরপর সারাটা দিন আকাশের মুখ ভার। স্থানীয় মানুষজন বলছে - বরফপাতের সমূহ সম্ভাবনা ৷
প্রাতঃরাশ সেরে বেরোলাম তিরিশ কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত তীর্থস্হান জাগেশ্বর দর্শনে ৷ এটি একটি মন্দিরের শহর। সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে কাত্যুরাই রাজবংশের রাজারা সমগ্র উত্তরাখণ্ডে প্রচুর মন্দির স্থাপন করেছিলেন, জাগেশ্বর শিবমন্দিরধাম তাদের মধ্যে অন্যতম। জাগেশ্বরধাম ভগবান সদাশিবের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একটি। কথিত আছে এই মন্দিরেই সর্বপ্রথম ভগবান শিবকে লিঙ্গরূপে পূজো করা শুরু হয়। এখানে একশো পঁচিশটি মন্দির আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- যজ্ঞেশ্বর, ভৈরব, চন্ডিকা, মৃত্যুঞ্জয়, নবদূর্গা, নবগ্রহ ইত্যাদি। মূল মন্দির প্রাঙ্গনে পৌঁছানোর আগে ডানদিকে পড়বে দণ্ডেশ্বর মন্দির আর কুবের মন্দির। মন্দিরগুলোর পাথরের কাজ সেই যুগের ভাস্কর্যের মুন্সিয়ানাকে তুলে ধরে। আরেকটি দ্রষ্টব্য হলো মিউজিয়াম। জাগেশ্বরধামের যে সমস্ত মুর্তিগুলোর কালের নিয়মে অঙ্গচ্ছেদ ঘটেছে সেগুলো বিসর্জন না দিয়ে ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করেছে।
ধওলছিনায় আমাদের হোটেল ছাড়িয়ে দেওদার আর পাইনে সাজানো মায়াবী এক মাটির রাস্তা হালকা চড়াইয়ে ওপরে উঠে গেছে। সেই রাস্তা ধরে দেড় কিলোমিটার এগোলে আনন্দময়ী আশ্রম, আরও দু কিলোমিটার দূরে শক্তিপীঠ ভগবতী দেবীর মন্দির। কোনোটাই এই বিকেলে যাওয়া সম্ভব নয় ৷ এখানে আরেকটি দ্রষ্টব্য হোটেল থেকে চারশো মিটার উপরে হিমালয়ান ভিউ পয়েন্ট। বিকেলটা নিচের বাজারে আশপাশ ঘুরে কফি খেয়ে কাটালাম।
পরেরদিন সকালে বেরিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে আনন্দময়ী আশ্রমে পৌঁছে গেলাম। রাস্তা আসান, হালকা চড়াই, দু কিলোমিটার দূরে সতীপীঠ ভগবতী মায়ের মন্দির ৷ মিনিট কুড়ি হাঁটার পর একটা গেট পড়লো, কিন্তু সমস্যা হল কোথাও মন্দিরের কোনও চিহ্ন নেই ৷ পাথরের ধাপে ধাপে সিঁড়ির প্রগতি ওপরদিকে উঠতে উঠতে ঘন জঙ্গল-পাহাড়ের ঊর্ধ্বসীমার বিভাজনে হারিয়ে গেছে। তবে চ্যালেঞ্জটা নিলাম, ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম- উঠছি তো উঠছি, যত ওপরের দিকে তাকাই ততই পেট গুড়গুড় করে। প্রায় একঘন্টা চড়াই ভাঙার পর পাহাড়ের মাথায় পৌঁছলাম। কিন্তু নিরাশ হলাম, মন্দিরের কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। উল্ট একটা সমতল রাস্তাঅন্য এক পাহাড়ে গিয়ে চড়াই চড়তে শুরু করেছে ৷ আশা ছেড়ে দিলাম, তখন আর চড়াই পেরোনোর দম বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই, চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম পেয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হল, হার না মেনে আবার শুরু হল পঙ্গুর গিরি লঙ্ঘন ৷ বহু কষ্ট শেষে দেবী ভগবতী মা সন্তান বাৎসল্যে কোলে টেনে নিলেন। মন্দির প্রাঙ্গনে পৌঁছে মনে হল এর ওপরে পার্থিব কিছু থাকতেই পারেনা।
এটা একটা সুন্দর সাজানো সচ্ছল সমৃদ্ধ এক মন্দির। যখন পৌঁছলাম তখন পূজো চলছে। উত্তর আকাশ জুড়ে শোভা পাচ্ছে তুষার শোভিত কিরীট চূড়া। কিছুক্ষন বিশ্রামের পর নামতে শুরু করলাম৷ উত্তরণের চেয়ে অধঃপতনে সবসময়ই কম সময় লাগে। আধঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেলাম ৷
ছবি: লেখক
গৌতম সরকার
অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা
বিষয়: গৌতম সরকার

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: