সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


তিস্তা নদীর পাড়ে : শায়লা সুলতানা 


প্রকাশিত:
২৮ নভেম্বর ২০২০ ২২:২৮

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৫৪

 

বিজুকে আজকাল প্রায়ই দেখা যাচ্ছে শাড়ি পড়ে বাইরে যেতে কখনো আবার খোঁপায় ফুল গুঁজে বাড়ি ফিরতে। তার ঠোঁটের হালকা রং যেন দিলারার মনেও একটু পুলক জাগায়। কৌতূহল হয়, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চায় না।

-দিলু ,মিটিং এর চিঠিগুলো খুব দ্রুত রেডি করতে হবে।
-হ্যাঁ, জামিল ভাই ,আমার কাজ প্রায় শেষ। কলেজ থেকে ফিরেই বাকিটা কমপ্লিট করে ফেলব।
-প্রথমবারের মত এত বড় প্রোগ্রাম। কী যে হবে !
-সবকিছু ঠিকঠাক মতোই হবে। তুমি একদম ভেবো না।
-হ্যাঁরে, তোরা ছিলি বলেই আমাদের সবকিছু শেষ পর্যন্ত সাফল্যের সাথে সমাপ্ত হয়রে।

আর মাত্র চারদিন পরেই নবীনসংঘের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রোগ্রাম। আগামি পরশু প্রস্তুতি পর্যালোচনার সর্বশেষ মিটিং । পলাশপুর গ্রামের সুশৃঙ্খল, সুনিয়ন্ত্রিত নবীনসংঘ ক্লাব কখনো আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। ১৯৫২ এর পর পরই তরুণদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল এ ক্লাবটি। ধারাবাহিকভাবে এ গ্রামেরই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে গঠিত পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বে গ্রামের সকল পর্যায়ের মানুষের সহযোগিতায় ক্লাবটি পরিচালিত হয়। বই পড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঞ্চ নাটক সবকিছুর সুষ্ঠু চর্চায় গ্রামটি একটি শুদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ।

জামিলের স্বাগত বক্তব্যে অডিয়েন্সে বিরাজ করে পিনপতন নীরবতা। উদাত্ত কণ্ঠে দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা, পাকিস্তানি শাসন-শোষন-নিপীড়নের চিত্র অত্যন্ত সাবলীল ও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে তার বক্তব্যে। মন্ত্রমুগ্ধের মত সবাই তা শোনে। প্রতিটি তরুন-তরুণীর শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত রক্তের ধারা ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে। প্রবীণ শ্রোতারাও হয়ে উঠেন উদ্দীপ্ত। সবার জোড়া চোখ কেমন চকচক করে উঠে। যেন প্রতিটি চোখের তারায় এক টুকরো স্বাধীন ভূখণ্ড উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জামিল যে'কদিন গ্রামে থাকে স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের সাথে চলে তার সার্বক্ষণিক গল্প-আড্ডা। গ্রামের ছেলে-বুড়ো সকলের প্রিয় জামিল। কী এক মোহনীয় ব্যাক্তিত্ব দিয়ে সবাইকে সে চুম্বকের মত আকৃষ্ট করে।
এবার প্রোগ্রামের কাজে দিলারা, রাজীব, সীমান্ত, জাভেদ, শফিক, মিলা, নিশু, পলাশ, মৌ ওরা সবাই আরো বেশি কাছে পেয়েছে জামিলকে। ঢাকায় যাবার সময় সবক'টা পিছু নিয়েছে জামিল ভাইকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে।

-কিরে তোরা সবাই এমন হাঁড়ি মুখ করে আছিস কেন?
-ভাইয়া, আর একদিন থেকে গেলে কী হত?
-আরে আমার যে ছুটি শেষ। আগমীকাল ক্লাশ আছে না? থাকতে পারলে কী আর আমি যাইরে তোদের ছেড়ে?-জাভেদের কথার জবাবে জামিল কথাটা বললেও তার দৃষ্টি ছিল দিলারার দিকে। দিলারা জামিল ভাইয়ের চোখের গভীর তরঙ্গে যেন টুপ করে ডুবে যায়। নিজেকে সে হারিয়ে ফেলে সমুদ্রের কোন্ অতলে।

-যাইরে---, সবাই ভালো থাকিস।

রোদ ঝকঝকে সকালে যেন আকস্মিক বজ্রপাতের শব্দে নিজেকে আবিষ্কার করে দিলারা। তাকিয়ে দেখে, ট্রেনের জানালা থেকে হাত নেড়ে জামিল বিদায় জানাচ্ছে তার খুঁদে ভক্তদের।

হ্যাঁরে মা, এবার পড়াশুনাটা শুরু কর।
-এইতো বাবা,আজ থেকেই শুরু হয়ে যাবে তুমুল পড়াশুনা।
কয়েকদিনের গ্যাপ পূরণ করে নিতে মেধাবী দিলারা পড়াশুনায় ভীষণ মনোযোগী হয়ে উঠে। রায়হান সাহেবেরও মেয়ের প্রতি এই বিশ্বাস আছে বলেই ওর কোনো কাজেই তিনি বাধা দেন না।

জানিস দিলু, গত বছর এই দিনে এই বটতলা থেকেই তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে আমরা যোগ দিয়েছিলাম গণ অভ্যুত্থানে। ২০শে জানুয়ারির মিছিলে গুলিবিদ্ধ হলো আসাদ,২৪ তারিখে মতিউর। জামিল আপন মনে বলে যাচ্ছে। দিলুর বুকটা গর্বে ফুলে উঠছে এমন দেশপ্রেমিক সংগ্রামী কারো পাশে সে হাঁটতে পারছে ভেবে। কথা শুনতে শুনতে কখন যে তারা হলের গেটে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি।

প্রতি বছর পলাশপুরের বেশ কয়েকজন করে ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও মেয়েদের মধ্যে দিলারাই প্রথম। কিন্তু যে উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে, পারবে কী সে পড়াশুনা শেষ করতে? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, পারবে তো জামিল ভাইরা দেশটাকে স্বাধীন করতে?

সিনিয়র রুমমেটদের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে দিলারা। জামিলের সূত্রেই তার এই রুমে সিট পাওয়া। শাহানা আপা,কাকলিদি,রেখা আপা সবাই ওকে এত আপন করে নিয়েছে যে ও বাড়ির জন্য মন খারাপ করবার অবকাশই পায়নি।

-দিলু তুই রুমে চলে যা ।এক্ষুনি কলাভবনের সামনে থেকে একটা মিছিল শুরু হবে। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
পা বাড়াতেই দিলারা সঙ্গ নেয় জামিলের ।
-তুই কোথায় যাচ্ছিস?
- তোমার সঙ্গে ।
- আমিতো মিছিলে যাচ্ছি।
- আমিও মিছিলে যাবো ।
- সে কি ,তুই কেন মিছিলে যাবি?
- কারণ আমিও একটি স্বাধীন দেশ চাই।
বাদানুবাদ করতে করতেই ওরা যুক্ত হয়ে যায় মিছিলের অগ্রভাগে।

-রেখা আপা, তুমিও কি বাড়ি চলে যাবে?
-দেশের অবস্থা খুব খারাপ রে দিলু। এ অবস্থায় হলে থাকাটা কোনোভাবেই নিরাপদ না। এরই মধ্যে অনেক মেয়েই হল ত্যাগ করেছে। দু'তিন দিনের মধ্যেই মনে হচ্ছে একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে।

দিলারার মনটা কিছুতেই বাড়ির দিকে টানছেনা। কিন্তু পরদিন সকালেই জামিল স্লিপ পাঠালো বাড়ি যাওয়ার জন্য একেবারে গুছিয়ে বের হতে। সে জানতে পেরেছে ১লা মার্চ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হবে ।

ঢাকায় ফেরার আগে তার এবং দিলারার বাবা-মাকে নিঃসংকোচে জানিয়ে এল দিলারাকে সে বিয়ে করতে চায় । এ প্রস্তাবে দিলারা ছাড়া আর কেউ তেমন বিস্মিত হয়না । এমন সময়ে এমন প্রস্তাব দিলারার কাছে বিস্ময়ের হলেও তাদের বাবা-মা কেউ তা প্রত্যাখ্যান না করে বরং সাদরে গ্রহণ করে।

২রা মার্চ কলাভবনে প্রথম পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানের সমাবেশে পরবর্তী কর্মসূচীর ঘোষণা, ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ কোনোটা থেকেই নিজেকে বাদ দেয়না জামিল । উত্তাল জনসমুদ্রের একজন ক্ষুদ্র সাক্ষী হিসেবে টগবগে রক্তের উচ্ছ্বাসকে কোনোভাবেই দাবিয়ে রাখতে পারেনা সে।

মধ্যরাতে আকস্মিক গুলির শব্দ। ঠিক কোনদিক থেকে আসছে প্রথমে বুঝতে না পারলেও এস.এম হলের ছাত্রদের কাছে কিছুক্ষণের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায়, ইকবাল হলেই এ আক্রমণ (বর্তমান জহুরুল হক)। এলোপাথারি গোলাগুলির শব্দ এত বিকটভাবে তাদের কানে আসছিল যেন তাদের কানের কাছ দিয়ে, মাথার উপর দিয়ে, বগলের ভেতর দিয়ে একটা একটা করে গুলি চলে যাচ্ছে। রুমের কোণায় শক্ত হয়ে বসে থাকা জামিলের চোখে ইকবাল হলের পরিচিত ও ঘনিষ্ঠদের মুখগুলো ভেসে উঠে। নিজে রেহাই পাবে কিনা জানেনা কিন্তু ওদের কাউকেই বোধহয় আর জীবিত পাওয়া যাবে না। ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে যখন শব্দবিহীন প্রচণ্ড চিৎকারে বুক ফেটে যায়, শ্বাস রুদ্ধ হতে হতে একসময় তবু ঘুম ভেঙে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যায়। কিন্তু এতো স্বপ্ন নয়। হয়তো ওই হলের মিশন শেষ হলে নরপশুরা এদিকেই চলে আসবে। দেশের জন্য জীবন দিতে জামিল কুণ্ঠিত নয় কিন্তু তার যে অনেক কাজ বাকি। অন্ধকার হালকা হতে শুরু করেছ, গুলির শব্দ একটু কমে এসেছে -বিচ্ছিন্ন চিন্তায় ছেদ পড়ে জামিলের।

জগন্নাথ হলে স্তূপীকৃত লাশ, রোকেয়া হলে আগুন, মেয়েদের সম্ভ্রমহানি ,শিক্ষকদের উপর নারকীয় তাণ্ডব, দেশের বিভিন্ন স্থানে পাশবিক অত্যাচারে থমকে গিয়েছে বাংলার আকাশ, ভারী হয়ে গিয়েছে রোদপোড়া চৈত্রের শুষ্ক বাতাস।

রক্তভেজা বাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাঙালির কাঙ্ক্ষিত বারতা- "আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন ।"

দিলুকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ জামিল ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে । দিলুও তার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে না।

জামিল আর দিলারা অনেক দিন একসাথে কাজ করেছে, কাছাকাছি বসেছে, পাশাপাশি হেঁটেছে,
কিন্তু কখনো তাদের মধ্যে হয়নি কোনো প্রেমালাপ।
গদগদ হয়ে জামিল কখনো বলেনি,"দিলু, তোকে ভালোবাসি। তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না।" কখনো ভালোবাসার উষ্ণ আবেগে দিলারার হাতটা চেপে ধরেনি অথবা তার খোঁপায় কখনো গুঁজে দেয়নি গাঁদা কিংবা গোলাপ । অথচ হৃদয়ে প্রোথিত পবিত্র ভালোবাসার প্রদীপ্ত আলো কোথা দিয়ে, কেমন করে নিজেদের অন্তর ছাড়িয়ে ব্যাপৃত হয়েছে তাদের চারপাশে, তারা তা বুঝতেই পারেনি।

২৫শে মার্চের বিভীষিকা থেকে কোন পূণ্যফলে বেঁচে যায় জামিল। জীবনটাকে হাতে নিয়ে তার একদিন পরেই সে চলে আসে গ্রামে। যুদ্ধের ডামাডোল তখনও শুরু হয়নি পলাশপুরে। গোল হয়ে বসে গ্রামের সবাই রেডিও বাজিয়ে যুদ্ধের খবর শুনে। এরই মধ্যে শুধু দু'জনের বাবা-মার উপস্থিতিতে দিলারাকে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে জামিল। বিয়েতে মজা করতে পারেনি বলে আফসোস নেই তাদের খুঁদে ভক্তদের। পরদিন সকালেই তারা নিজেদের বাগান থেকে তোলা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছে প্রিয় জামিল ভাই-দিলু আপাকে।

সপ্তাহ না যেতেই অস্থির জামিল ছটফট করতে থাকে। বাবা-মা আপত্তি করলেও দিলারা তাকে আটকানোর চেষ্টা করেনি। সবাইকে ছেড়ে যেতে তার বুকের তন্ত্রীগুলো ছিড়ে যাচ্ছে। তবু যুদ্ধে তাকে যেতেই হবে। যাবার বেলায় তার আবেগের প্রবল বর্ষণ হয়ে উঠে অবাধ্য।

২৩ ডিসেম্বর, ভোর ৫টা বেজে ১৫ মিনিট। ফজরের আজান ভেসে আসছে পাশের মসজিদ থেকে।
-কাঁথায় মোড়ানো ফুটফুটে শিশুটিকে দিলারার বুকে এনে দিতেই হু-হু করে আসা বানের পানির মত চোখ ঠেলে জলের ধারা নেমে আসে। সে ধারা কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসতে চায় না। এ কি মা হবার আনন্দ? নাকি কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনের আনন্দ? নাকি অস্তিত্বে মিশে যাওয়া ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা?

ছোট্ট একটি শিশুর মুখাবয়ব একজন বড় মানুষের এতটা অবিকল হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। যেন সে জামিলকেই দেখছে এমনভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নবজাতককে দুধ পান করানোর কথা প্রায়ই ভুলে যায়।

দিলু,
ভালোবাসা জেনো। তোমার চিঠি থেকে সব জানতে পারলাম । আমাদের ছেলে হলে নাম রেখো বিজয় আর মেয়ে হলে বিজয়া । বাবা-মাকে সালাম দিও।
ইতি তোমার জামিল ।

জামিলের সহযোদ্ধা পাশের গ্রামের কামাল ভাই সেদিন রক্তাক্ত ছোট্ট চিঠিটি দিলারার হাতে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল আর বলেছিল ,"পারলাম না দিলু ,জামিলকে বাঁচাতে পারলাম না।" এর চেয়ে বেশি সেদিন আর কিছু বলতে পারেনি সে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর একদিন এসে শুনিয়েছিল সেই নির্মম সত্য গল্প--

-শিলিগুঁড়ির পাশে বাগডোরার কাছে ডাঙ্গারহাটে আমরা আঠার দিন ট্রেনিং করি। পারদর্শিতা দেখে আমাদেরকে ইনটিলিজেন্স ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারপর আমাদের পাঠানো হয় হাতিমারা ক্যাম্পে। সবসময় আমরা একসাথেই ছিলাম। সব অপারেশনে আমাদের দু'জনকেই থাকতে হত
অগ্রভাগে। সেদিন তিস্তা নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় তিন মাইল এলাকা জুড়ে মাইন পুতে রেখে সেই পাড়েই আমরা পজিশন নিই। পূর্ব পাড়ে অবস্থানরত খানসেনাদের সাথে প্রায় তিন ঘন্টা সম্মুখ যুদ্ধ চলে। সত্তর জন খানসেনা মারা যায় সেই অপারেশনে। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা শাহেদের পায়ে গুলি লাগাতে সে বেঁচে যায় কিন্তু বক্ষভেদী গুলিতে জামিল শহীদ হয় সেই নদীর পাড়েই।
দিলু, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় । জামিলের লাশটাও তোমাদের কাছে পৌঁছাতে পারলামনা।
বলতে বলতে গলা ধরে আসে তার। দিলারার মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না। নিঃশব্দ চোখের পানিতে শুধু বুক ভিজতে থাকে।

জামিলের কথামত মেয়ের নাম রেখেছে বিজয়া বিনতে জামিল। আদর করে সবাই ডাকে বিজু বলে।

বিজুকে দাদা-দাদীর কাছে রেখে অনার্স -মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফেলে দিলারা। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ায় সে নিজের বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়ে যায়। যোগদানের সাথে সাথেই কোয়ার্টারও বরাদ্দ পায়। দেরি না করে দাদা -দাদী সহ বিজুকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ভর্তি করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের উদয়ন স্কুলটাতেই।

দেখতে দেখতে স্কুল কলেজ পেরিয়ে বিজু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী। চলন -বলন-ভাব-গাম্ভীর্য সবকিছুতেই বিজুর মধ্যে জামিলের প্রতিচ্ছবি। দিলারা সবসময় বিজুর কাছে জামিলকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে সে বাবার শারিরীক উপস্থিতি অনুভব না করলেও ঘরে , বাইরে ,দেশের প্রতিটি ধূলিকণায় বাবার পবিত্র স্পর্শ অনুভব করে সবসময়।

সহপাঠীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে নিয়ে তৈরি করছে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম। এজন্যই তার এত ব্যস্ততা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নিতে বন্ধুদের সাথে ঢাকার বাইরে যেতে হবে -মাকে তাও জানিয়ে রাখে।

এভাবে একসাথে কাজ করার স্মৃতিগুলো দিলারার মনকে এড়িয়ে যেতে পারেনা। সেই ভালো লাগার সোনালি মুহূর্তগুলোকে স্মরণ করে ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাসকে আড়াল করে বিজুকে বলে,
-বন্ধুদের সবাইকে একদিন বাসায় নিয়ে আয়।
-সত্যি বলছ মা?খুব ভালো হবে।
বিজু মাকে খুব সাহায্য করলো । দিলারার কোনো কষ্টই হলো না।
সবার মধ্যে জয়কে একটু আলাদা মনে হলো। ভালোও লাগলো ওকে। সবার সাথে জামিলকে স্টেশনে বিদায় দিতে গিয়ে ওর প্রতি তার সেই গভীর চাহনি, যে চাহনি সেদিন আঠার বছরের তরুণীকে সব বলে দিয়েছিল ,তেমনি জয়ের সাথে বিজুর দু'একটি দৃষ্টি বিনিময় লক্ষ করে তার কৌতূহলের নিবৃত্তি হয় । একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস তাকে অনেক হাল্কা করে দেয়।

কদিন পরেই বিজু বন্ধুবান্ধবের সাথে রাজশাহীতে যায় ফিল্মের কাজে। অনেকদিন পর মেয়েকে ছাড়া দিলারার খুব ফাঁকা লাগে। বিজু নিজে নিজে চলতে শেখার পরই শ্বশুর-শাশুড়িও ভিঁটের টানে চলে গিয়েছেন পলাশপুরে। দেখাশুনার জন্য ভাতিজা - ভাতিজা বউ আছে তাদের সাথে । বয়সের ভারে এখন আর তাঁরা আসতে পারেন না ঢাকায়। ছুটি পেলে বিজুকে নিয়ে নিজেই গিয়ে তাঁদের সাথে সময় কাটিয়ে আসে।

ফিরে এসে বিজু মাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যেন কতদিনের মাতৃস্নেহের তৃষ্ণায় তৃষিত সন্তান ফিরে এসেছে মায়ের কোলে। স্নেহ -ভালোবাসার জড়াজড়িতে কেটে যায় বেশ কিছু মুহূর্ত । মায়ের
হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে খুলে বসে দু'দিনে অর্জিত অভিজ্ঞতার ঝুলি। মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে শোনা তাদের বীরত্বগাঁথার বর্ণনায় তার চোখ মুখের অভিব্যক্তিতে দিলারাও যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় তিস্তা নদীর পশ্চিম পাড়ে ।

কলিং বেলের শব্দে ভেঙে যায় মা-মেয়ের গল্পগাঁথার আসর । দরজা খুলতেই দিলারার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত
-এতদিন পরে মনে পড়লো ?
- মনে পড়লেই কী উপায় ছিল দেখা করার? আসলে এতদিন ঢাকার বাইরে ছিলাম বলে ইচ্ছে থাকলেও হয়ে উঠেনি।

বিজু---দেখ কে এসেছে? শান্ত চাপা স্বভাবের
দিলারাকে বেশ উচ্ছ্বসিত মনে হয়।

-তোর কামাল কাকা।
বাবার পাশে যাঁর নামটি ছোটবেলা থেকে শ্রদ্ধার অক্ষরে তার মনে খোদাই করা সেই কামাল কাকা ।যাকে মনে মনে কত খুঁজেছে। এত সহজে তাঁর সাথে দেখা হবে ভাবেনি কখনো।
পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলে ওর হাত ধরে কাছে বসায়। মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলে
-একেবারে বাবার মত দেখতে হয়েছে।
-শুধু দেখতে না ,সবকিছুতে বাবার মত।
বিজুর চোখ ছলছল করে উঠে। চোখের জল সমলাতে চা বানানোর ওজুহাতে উঠে পড়ে।
-কাকা ,আপনারা কথা বলুন। আমি চা বানিয়ে আনছি।

চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে ঢুকতে জয়ের নামটা কানে যেতেই মনোযোগী হয়ে উঠে বিজু। জয়ের মুখে ওর মুক্তিযোদ্ধা বাবার গল্প শুনেছে অনেকদিন। সবাই মিলে সাক্ষাৎকার নিতে যাবে এমন প্ল্যানও করেছে কিন্তু তাঁর নামটাই কখনো শোনা হয়নি। কামাল কাকাই জয়ের বাবা একথা শুনে মা-মেয়ে দু'জনেই চমকিত হয় । বিনয়ী বিজুর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারায় লজ্জার আভা দেখতে পায় দিলারা । চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কামালের জানা হয়ে যায়, বিজু জয়েরই সহপাঠী।

দিলারার সরলরৈখিক জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়াগুলো কোনোরকম বিঘ্ন ছাড়া খুব সহজেই তার কাছে ধরা দিয়েছে। মেয়েকে মানুষ করতেও কোনো বাধা কখনো বাধ সাধেনি। জীবনসঙ্গী বাছাই এর ক্ষেত্রেও মেয়েটা ভুল করেনি। মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী দিলারা এরই মধ্যে জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে । বাকি পথটাও হাঁটবে সে গর্বিত পদভারে । কিন্তু তবুও সমস্ত জীবনটাই তার কাছে ফিঁকে, বিবর্ণ, শূন্যতার হাহাকারে পূর্ণ রুদ্র মরুভূমির একটি শুষ্ক প্রান্তর।

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অস্তরাগের টকটকে লালে রঞ্জিত পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে দিলারা দেখছে
-তিস্তা নদীর পশ্চিম পাড়ে কামাল ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে জামিল। তার গুলিবিদ্ধ বুক থেকে রক্তের নহর বেয়ে নদীর পানির সাথে মিশে বহমান নদীতে বইছে রক্তের স্রোত।
মাথাটা ঘুরে উঠে। ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। পেছন থেকে বিজু এসে কাঁধের ওপর হাত রাখতেই ওকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে দিলারা।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top