সেই সময়ের পর : নুজহাত ইসলাম নৌশিন
প্রকাশিত:
৩০ মার্চ ২০২১ ১৯:২২
আপডেট:
১৩ জানুয়ারী ২০২৫ ২০:৪২
উফফ! এই মহিলা এত ঘ্যান ঘ্যান করতে পারে – আমি ঘাড় গুঁজ করে আবার ফোনে ডুব দিলাম। ফোনে তেমন কিছুই নেই তারপর ও ডুবে থাকি, অন্তত বুড়ো নানির ঘ্যানর ঘ্যানর থেকে এখানে শান্তি।
শান্তি জিনিসটা বেশিক্ষণ আমার সহ্য হয় না। একেবারেই না, নয়তো পিছনে ফিরে এই দৃশ্য কেন দেখা লাগবে! আমার কাছে পাত্তা না পেয়ে নানি কাঠের আয়নার ঠিক ডান পাশে দেয়ালে ঝুলানো মলিন ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। দুঃখিত, তাকিয়ে নেই – বরং বলা ভালো তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, ঠোঁট অস্পষ্ট বিড়বিড় করছে। আমার বুকে ধ্বক করে উঠলো, কি বলতে চেয়েছিল আমায় – আর আমি, ‘ ওফ্ফ, যাও তো, পরে শুনবো বলে’ বলে যান্ত্রিক এক ফোনে ডুব দিলাম! ছিহ।
‘এই যে, এই মহিলা’, আমি আলতো করে নানির কাঁধে চাপ দিলাম। উনি মোটাসোটা হাত ঝাপটার মতো সরিয়ে বলল, ‘ঢং করিস না মেয়ে, যা যা তোর কাজ কর। ‘
বুঝলাম অভিমান হয়েছে। আসলে নানির প্রতিটা গল্প এত এত বার শোনা হয়েছে যে এখন আমিই উনার চেয়ে কাহিনি ভালো না বরং বলা যায় বেশ ভালো বলতে পারব। কারণ নানি এখন কাহিনি বলতে গেলে হয় কিছু জায়গা বাদ দিয়ে ফেলেন নয় কিছু জায়গা বেশি বলে ফেলেন। এইতো সেদিন জরিনাকে কলিমের বউ বানিয়ে দিয়েছেন, অথচ কলিমের বউ দুই বছর আগে মারা গেছে এবং তার বউয়ের নাম মোটেও ‘জ ‘ দিয়ে না। অন্য কিছু হবে, কিন্তু কি তা এখন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
‘আহহা, আমার কোন কাজ নেই তো। তোমার এই বুড়া বয়সে কি হল? এত আবেগ কেন! পুরাতন প্রেম মনে পড়ছে বুঝি? ‘দ্বিতীয় বার মোটাসোটা হাতের ধাক্কা খাওয়ার আগেই সরে আসলাম। নানি বুড়া শব্দটা মোটেও সহ্য করতে পারেন না, আর এই শব্দটা প্রয়োগ করে আমি সবচে বেশি মজা পাই।
বুঝলাম ডোজ কাজ করেছে । পুরাতন প্রেম শব্দটা বলার সাথে সাথে মেঘ কেটে গেছে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম হায়রে আবার বোধহয় সেই শোনা গল্প শুনতে হবে। আর নানির গল্পের বেশির ভাগটা জুড়ে নানা আর নানা। ‘নানা-ময়’ জীবন তার। আবার শেয়াল পণ্ডিতের কুমিরের এক বাচ্চা বার বার দেখানোর মতো- নানি তার গল্পের থলি থেকে নানার একই গল্প একটু হের -ফের করে বলার মতলব করছেন। আর আমিও তখন ধমক দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে নানাময় গল্প শোনার প্রস্তুতি নিলাম ।
নানির গল্প বলা মানে আয়োজনের ব্যাপার – স্যাপার। অবশ্য যাবতীয় কাজই উনাকে আয়োজন করে করতে হয় – মোটা মানুষের সব কিছুতে আয়োজন একটু বেশিই লাগে বোধহয়।
বিছানায় পিঠের পিছনে বালিশটা নিয়ে, পানের ভেতর একটু চুন আর কয়েক টুকরা সুপারি ভরে এটাকে আবার তিনকোনা করে সেই একটা ভাব নিয়ে মুখে দিলেন। আর কিছুক্ষণ পর নানির ভাঁজ করা থুতনিতে পানের রস গড়িয়ে পড়তে লাগল। দৃশ্যটায় একটা বাচ্চামি আছে, একটা বয়সে মানুষ বুড়ো হয়ে আবার বাচ্চা টাইপ হয়ে যায়। নানির এখন এই স্টেজ চলছে। আপন মনে পান খেয়ে তার পিক দিয়ে সাদা দেয়াল জুড়ে হাজার রকমের চিত্রকর্মে তার ঘর ভরা। মাঝে মাঝে নিজের পিকের চিত্রকর্ম নিজেই মুগ্ধ হয়ে দেখেন। একে বাচ্চা ছাড়া আর কি বলা যায় !
‘শোন, তোর নানা – ‘
এতটুকু শুনেই আমি ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত বোধ করতে লাগলাম। আর কি বলবে? ওই বাজার থেকে আসছিলো তারপর গাছের আড়ালে কে জানি লুকিয়ে ছিল – তারপর গভীর রাত। উনি সাহসিকতার সাথে ভূত টাইপের মানুষকে জব্দ করলেন! এইরকম একই ধরনের গল্প একটু রং – চং লাগিয়ে বলে কমপক্ষে হাজার বার বলে ফেলেছেন। নানি হয়তো ভুলে যান আমার বয়স বাইশ শেষ হয়ে তেইশে পড়ছে এবং আমার একবার প্রেম বিচ্ছেদ হয়ে নতুন প্রেম চলছে। আমার ভূত – প্রেতের গল্প শুনতে ভালো লাগে না এবং সেই ইচ্ছে, বয়স কোনটাই নাই। আমি বড় মাপের একটা দীর্ঘশ্বাস ছোট করে ছাড়লাম । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হিসাব করলাম কতক্ষণে এই ভূতের কেচ্ছা শেষ হবে, কারণ আজ ফাহাদের সাথে দেখা করতে হবে। প্রতি বুধবার বিকেল চারটায় দেখা না হলে বেচারার সারা সপ্তাহ মাটি হয়ে যায়। এখন বাজে তিনটা এক, আমি একই সাথে হতাশ এবং বিরক্তি বোধ করলাম।
‘শোন, তোর নানা – ‘
এদেখি মহা মুসিবতে পড়া গেল। আজ এই এক বাক্যেই পড়ে থাকবেন নাকি! আমি অস্থির হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম – তিনটা পাঁচ।
‘কি- আমার নানা! লাইনটা শেষ করবে তো। ‘ আমার গলার বিরক্তি মনে হয় ফুটে উঠল। আমার চেহারার রাগ, বিরক্তি, অভিমান এগুলো বেশি রকম ফুটে উঠে। নানি চুপ করে গেলেন।
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। হায়রে, মাথাটা কেন যে এতে গরম হয় ফোনের ব্যাটারির মতো। টুং একটা শব্দ – ম্যাসেঞ্জার খুলে দেখি, ‘ আজ আকাশি শাড়ি ‘এতটুকুই। যদিও দ্বিতীয় প্রেম তবুও এই ছোট বার্তাটা পেয়েই আমার শ্যামলা মুখ লালচে হয়ে গেল। ইশ্, এমন কেন যে হয়।
নানির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাব তখন দেখি নানি আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিটি হাসছে।
‘এ মহিলা, কি সমস্যা ! হাসি যে খুব? হুঁ- ‘
আমায় অবাক করে দিয়ে বলল, ‘ তুই পোলাটার প্রেমে পড়ছিস? না পোলাটা তোর প্রেমে পড়ছে- কোনটা? থতমত ভাব সামলে বললাম, ‘ কি আজব! তোমার কি না কি কেচ্ছা – কাহিনি শুনাবে তার সাথে আমার সম্পর্ক কি! আর আমার কোনো প্রেম – টেম নাই। কি যে বল না বল, তার নাই ঠিক।
মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রেমের কথা স্বীকার করি আর উনি এটা আমার বাপ – মায়ের কাছে রাষ্ট্র করুক – শখ কত। আসলে আমি নিজেই এখনো নিশ্চিত না একে সারা জীবনের জন্য চাই কি না। মাত্র কয়েক মাস হল পরিচয়। বাবা – মায়ের এক কথা বিয়ে কর, বিয়ে কর। এখন প্রেম জানলে, একে দেখতে চাইবে – হাজারটা হাঙ্গামা। যেখানে আমিই নিশ্চিত না সেখানে মানে হয় না এসবের।
‘আমি কিন্তু তোর নানার প্রেমে পড়ছিলাম। ‘
আবারো দ্বিতীয় দফা অবাক হলাম। এ মহিলা বলে কি! আজ একেবারে নতুন – আনকোরা কথা শুনছি। আমি নড়েচড়ে বসলাম। নানির দিকে মনযোগ দিয়ে দেখলাম। এখনো রূপের ছটক আছে। মাথা ভর্তি না হলেও বেশ চুল আছে। ফর্সা মুখ অবশ্য সংসারী ঝামেলায় তামাটে হয়ে গেছে। আমি তার ষোল বছরের একটা ছবি দেখেছিলাম এ্যালবামে। মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো রূপবতী। সেই মেয়ে কিনা আমার নানার প্রেমে পড়েছে! আমার নানা পড়েনি নানির প্রেমে! এরচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা আরকি থাকতে পারে!
আমি এবার দেয়ালে ঝুলানো নানার ছবিটার দিকে তাকালাম। নানাকে আমি খুব অল্প বয়সে হারিয়েছি। যখন মৃত্যু কি আমি বুঝতাম না তখনই মৃত্যু আমার নানাকে নিয়ে চিনিয়ে দিল মৃত্যুর অস্তিত্ব। নানার সাথে আমার একটা স্মৃতি কেবল মনে পড়ে, ‘ দিলাম তোর নানিকে গুলি করে, দিলাম। ‘ আমি হাসতে হাসতে বলতাম , ‘ একদম গুলি করে দাও। ‘আর নানির কি অভিমান !
দেয়ালে ঝুলানো মলিন সুপুরুষের ছবি। চোখগুলো বুদ্ধিতে ঝকঝকে। আবার নতুন করে নানাকে দেখলাম। যে লোকটার প্রেমে আমার নানি পড়েছিল।
‘নানা তোমার প্রেমে পড়েনি? ‘ফট করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
নানি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। জানালার পাশ ঘেঁষে নানার লাগানো আম গাছ। গাছে কাকের বাসা। এই কাকটাও নানির খুব প্রিয় – নানার লাগানো গাছে বাসা বেঁধেছে বলে। আমি অবাক হয়ে এই মহিলাকে দেখি, ভালোবাসা কিংবা প্রেম এই শব্দ গুলো ব্যবহার না করেও কত সহজ সম্পর্ক যাপন করে গেছেন।
‘তোর নানা প্রেম কি বুঝেই না। মেয়েদের দিকে চোখ তুলে কখনো তাকায় নি, আর তখনকার সে সময়টা তো এমন ছিল না। ‘এতটুকু বলেই যেন আজ ক্লান্ত হয়ে গেলেন নানি। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ আনকোরা গল্পের ঘ্রাণ পেয়েছি। বাকিটা জানতেই হবে।
নানা লোকটা মোটামুটি কিংবদন্তির মতো। তার নামটা ম্যাজিকের মতো ,যেই শুনে সেই বলে তুমি তার নাতনি! আমি অবাক হই, কিন্তু এর পেছনের কারণটা জানি না। কি এমন বিশেষ গুণ ছিলো লোকটার – যার জন্য এখনো তার মৃত্যুর দশ বছর পর ও তার নাম শুনলে লোকে আমায় খাতিরটা একটু বেশিই করে।
‘তারপর, তারপর – ‘
নানির স্বভাব চঞ্চলতা আজ যেন কোথায় গেল। গল্পটা আর কখনো বলেননি বলে হয়তো। দ্বিধা কাজ করছে। ইতস্তত ভাব কাটিয়ে বললেন, ‘ সময়টা উল্টা – পাল্টা ছিল। যা হবার কথা তা হয়নি, আর – ‘
আমার ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। কি এমন কাহিনি, কোন সময়, এত সময় লাগিয়ে কেন বলছে – উফফ।
‘তখন থেকে বলছ যে – সময়টা, সময়টা! কোন সময় নানি? এত রহস্য করছ কেনো? ‘
কেমন একটা নিরুদ্বেগ মুখ। এরকম চেহারা কখনো আগে দেখিনি। সব সময় অস্থির, ছটফটে এক নানিকে দেখেছি। যে পান থেকে চুন খসলেই হার্ট অ্যাটাক করে ফেলে, সে আজ এত নির্বিকার ভঙ্গিতে কি গল্প বলতে চাচ্ছে – অবাক লাগছে।
পানের পিকটা ঢোক গিলে, চশমাটা খুলে আবার আম গাছের দিকে তাকালেন। স্মৃতিতে ডুব দিল নাকি মহিলা? ওদিকে চারটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই । আর এদিকে আনকোরা গল্পের লোভ সামলাতে পারছি না।
‘আহহা, বল না কি কাহিনি – ‘
‘সময়টা অক্টোবরের শেষাশেষি। সংগ্রামের সময়’-
আমি হেয়ার ক্লিপটা জানালার গ্রিলে বাজিয়ে বললাম, ‘ মানে আমাদের একাত্তরের যুদ্ধের কথা বলছিলে? সেই সময়ের কথা? ওই সময় নানার সাথে তোমার পরিচয় ? আগে তো কখনো বলো নাই । ‘
আসলে মুক্তিযুদ্ধের সবটা কেমন অবাস্তব লাগে। অবাক লাগে , বাস্তবতা যে রূপকথার চেয়েও শ্বাসরুদ্ধকর ছিল সেটা আমাদের জেনারেশন এর মাথায় ঢুকে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু সমাজ বইয়ের পাতায় আর গুটিকয়েক সিনেমায়। তাই যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা কেউ বললে বিশ্বাস হয় না। যে কাহিনি পরীক্ষায় মার্কস পাওয়ার জন্য গৎবাঁধা পড়ে গেছি তার বাস্তবতা কেমন ছিল সেটা ভাবনাতেও আসে না।
‘কি হয়েছিল সংগ্রামের সময়? ‘
‘আমার বয়স তখন পনের। যুদ্ধে যখন সব জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তখন আমার বাপ সোমত্ত মেয়ে নিয়ে জ্বলে পুড়ে মরছে। সমানে সব বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে রিফুজি ক্যাম্পে। আমার শিক্ষক বাপ পড়ল দোটানায়। মেয়ের বয়স পনের, দেখতে লাগে সতের – আঠারো। একে বিয়ে দিতে না পারলে হয়তো পাক আর্মি ই নিয়ে যাবে, আর যদি ও বা লুকিয়ে রাখেন – শান্তি বাহিনীর চর ঘুরাঘুরি করছে। রূপবতী, বাড়ন্ত মেয়ে আগুনের সমান। এই আগুন কিভাবে সামাল দিবেন সেই চিন্তার তার ঘুম হারাম। আর হুট করে কার কাছেই বা মেয়ে তুলে দিবেন, সংকটে মহাসংকট’
শ্বাসরোধ হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম আমি । কি বলছে এসব! এরকম তো মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় দেখি। বাস্তবে এমন হয়েছিল ! ‘তারপর নানি’-
‘তোর বড় বাবা মানে আমার বাপ – সিদ্ধান্ত নিল কয়েকদিন এর মধ্যে গ্রাম ছাড়বে, তারপর বর্ডার পার হতে পারলেই নাকি বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু – ‘
‘কি কিন্তু? ‘
‘আমার শিক্ষক বাপের অনেক ছাত্র যে শান্তি বাহিনীতে চলে গিয়েছিল সেটা আমার বাপের মাথায় ঢুকেনি তেমন। তার ধারণা সে তার ছাত্রদের বিরাট আদর্শবান হিসেবে গড়েছে। আসলে ভুল।
তার খুব কাছের একজন ছাত্র যে সদ্য শান্তি বাহিনীতে যোগ দিয়ে অশান্তি করে বেড়াচ্ছে , সেই খবর দিল মিলিটারি ক্যাম্পে – তার শিক্ষকের যৌবনবতী কন্যা আছে। যেদিন আমাদের গ্রাম ছাড়ার কথা ছিল তার আগের দিন সন্ধ্যায় কাঠের দরজায় ঠক ঠক ঠক। শব্দটা দরজায় না হয়ে বোধহয় ঘরে থাকা তিনটা মানুষের বুকে হচ্ছিল। আমি তোর বড় মাকে শক্ত করে ধরে বসে ছিলাম। বাপ বার বার বলছিল, ‘ ভয় পাস না, ভয় পাস না। ‘
চারটা ত্রিশ বেজে গেছে। সময়কে পাত্তা না দিয়ে বললাম , ‘ তারপর ? ‘
‘বাপের অনেক সাহস ছিল। দরজা খুলল। তার কাছের ছাত্র তখন যমদূতের চেয়ে ভয়াবহ রূপে এসেছিল।
‘রহিম, তুমি এই সন্ধ্যায়? ‘
‘জ্বি, স্যার। কাল আপনারা চলে যাবেন। সাক্ষাৎ করতে আসলাম। ছোটবেলা আপনার কাছ থেকে পড়া শিখে বড় হইছি, আর এই দুর্দিনে আপনারে বাঁচানো তো কর্তব্য। ‘
‘আমরা কাল চলে যাচ্ছি। ‘
পান খাওয়া দাঁত বের করে বীভৎস একটা হাসি দিল। ‘ যাবেনই তো, পোড়া দেশে আর থেকে কি হবে, কিন্তু দেশের জন্য কিছু একটা দিয়ে যে যেতে হবে যে – আহা পাকিস্তানের জন্য কিছু করতে পারাও সওয়াবের কাজ’।
‘আমার বাপের এই সওয়াবের কাজ করার জন্য মোটেই উৎসাহী না । বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘টাকা পয়সা বিশেষ কিছু নেই, আর যা আছে’-
‘ছিঃ, স্যার। আপনার সাথে কি আমার টাকা পয়সার সম্পর্ক? আপনার মান – সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। দরজার কাছে অবহেলা ভরে পানের পিক ফেলে বলল, ‘ আপনার মেয়েটাকে কয়েকদিন এর জন্য দেন – ইস্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প হইছে তাদের সেবা যত্নের একটা ব্যাপার আছে। ‘
আমার সাহসী বাবা জানতেন না দরজার বাইরে আরো শান্তি বাহিনীর অশান্তি সৃষ্টিকারী সদস্য আছে। তাই রাগে গলা উঁচু করে বলতে লাগলেন , ‘ এই তোকে শিক্ষা দিয়েছি? বের হ এখুনি - ‘
‘আহহা, বের তো হমুই স্যার। এই তোরা বাইরে কি করস? গোলমাল আর ভালো লাগে না। সওয়াবের কাজে বাধা। স্যারের মাইয়ারে আদর – যত্ন করে নিয়ে যা।
আর স্যার আপনি চিন্তা কইরেন না। নিশ্চিন্তে যান। কয়েকদিন ব্যাপারই তো। ‘
দম আটকে কোনমতে বললাম, ‘ তারপর? ‘
‘আমায় টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একটা শব্দই কানে আসছে – আমার আম্মা কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘মাস্টার, আমার মাইয়ারে আইনা দাও। ‘
তিনদিন তিন রাত । তারপর দিনের হিসাব ভুলে গেছি। একটা বদ্ধ রুমে ত্রিশ জনের মতো আমার বয়সের কাছাকাছি। কেউ কাউরে চিনি না, অথচ আমাদের কষ্ট, অনুভূতি সব এক। আমরা কেউ জানি না, আমাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করছে কি না। কেউ মুক্ত করতে আসবে কি না। না – এই নরকেই বিবস্ত্র অবস্থায় দিন, মাস, বছর পার হবে। কিছুই জানি না। বদ্ধ রুমে ভেন্টিলেটর দিয়ে সূর্যের আলো আসত। আপন বলতে এই আলো টুক ছিল। ‘
আমি নানির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অসমাপ্ত গল্পের আশায়। মুখ দিয়ে আর তারপর বের হল না।
‘আর সন্ধ্যার পর একেক দিন একেক জনের পালা। মনে হতো অনন্ত কাল ধরে এখানে বন্দী। আর ছাড়া পেলেই কি সমাজ নেবে – যা শেষ হওয়ার তা তো গেছে।
এরপর একদিন মনে হল গোলাগুলির শব্দ টা অনেক কাছে। মনে মনে আশা হচ্ছিল এরাই হয়তো মুক্তিবাহিনী । রাত – বিরাতে গোলাগুলি মুক্তি বাহিনী এলেই হতো ।
গভীর রাতে দরজা ভেঙে হুড়মুড়িয়ে একদল লোক রাইফেল কাঁধে ঢুকলো বদ্ধ রুমে। বুঝলাম এখানে পাক বাহিনীর খেল খতম।
ত্রিশজনে পূর্ণ রুম এক ঝটকায় খালি হয়ে গেল। বাকি রইলাম আমি, এক কোণে বসে ছিলাম। কার কাছে যাবো? সবাই তো চলে গেলো । আমার বাপ – মা সেখানে থাকবে এটা অনিশ্চিত।
‘এই যে, উঠেন –
আমি তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম।
‘আপনি যাবেন না? সবাই তো ছাড়া পেয়ে চলে গেছে। সময় নষ্ট করতেছেন ক্যান। ‘
‘আমার যাওয়ার যায়গা নেই। কই যাবো?’ তখন আর কান্নাও আসে না।
আমার ভেতরে কেমন অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে। ঢোক গিলে বললাম, ‘ এরপর? ‘
নানি মৃদু হাসল। অনেকটা কান্নার মতো হাসি। বলল, ‘ সেই লোকটা বলল, ‘চলেন আমার সাথে । দেখি কি হয়।
তারপর সেই যে লোকটার সাথে আসলাম আর গেলাম না। আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছাও হয় নাই । ‘
এরকম সময় মেজো মামা গজগজ করতে করতে কোথা থেকে আসল, ‘আব্বা এইটা কোন কাজ করল! মানুষের মুক্তি যুদ্ধের ভুয়া সার্টিফিকেট আছে। আর উনি এসবের ধার ধারলেন না। যুদ্ধ করছেন আর একটা সার্টিফিকেট নিলে কি এমন দোষ হতো? ‘বলে গজগজ করতে করতে আবার চলে গেলেন। কোন চাকরির ইন্টারভিউে বাদ পড়ার পর পরই এসব কথা মেজো মামা বলেন।
নানি জানালার বাইরে অপলক তাকিয়ে আছেন। তার গাল বেয়ে মুক্তোদানা গড়িয়ে পড়ছে। কোন ইতিহাস বইয়ে লেখা নেই এই কাহিনি- একটা অসহায় ষোল বছরের বালিকা’কে মিলিটারি ক্যাম্প থেকে তুলে এনে আশ্রয় দেয়ার সত্যিকার গল্প। একজন সার্টিফিকেট বিহীন, খেতাব বিহীন মুক্তিযোদ্ধা আড়ালেই রয়ে গেলেন। সমাজ বইয়ে কোথাও তার নাম নেই ।
বিষয়: নুজহাত ইসলাম নৌশিন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: