মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকার ও ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ের স্বীকৃতি : মু: মাহবুবুর রহমান
প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২১ ২১:০৪
আপডেট:
১৭ জুন ২০২১ ২১:০৪
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির এনএলডি (ন্যাশনাল লি ফর ডেমোক্র্যাসি) সরকারকে হটিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সে দেশের সামরিক বাহিনী। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে মিয়ানমার। তবে বিক্ষোভ দমনে সহিংস পন্থা নিয়েছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। দেশটির বিক্ষোভ দমনে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন আট শতাধিক মানুষ এবং বন্দি করা হয়েছে কয়েক হাজার।
এমন অবস্থায় গত ১৬ এপ্রিল ২০২১ তারিখে সামরিক জান্তাকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে একটি ছায়া সরকার গড়ে তোলেন মিয়ানমারের বিরোধী রাজনীতিবিদরা, যার বেশিরভাগ সদস্যই সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)’র। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সমান্তরাল এ সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) নামে পরিচিত। সরকার গঠনের পর থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের জন্য এনইউজি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এনইউজি নিজেদেরকে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে দাবি করছে। তবে মিয়ানমার জান্তা এনইউজি’কে ‘সন্ত্রাসী’ বলে ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি এনইউজি'র সঙ্গে কেউ প্রকাশ্যে অথবা গোপনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে সামরিক জান্তা। যদিও সামরিক সরকারের হুমকি উপেক্ষা করেই নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এনইউজি।
গত ৩ জুন রাতে জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) ‘পলিসি পজিশন অন দ্য রোহিঙ্গা ইন রাখাইন স্টেট’ বিবৃতিতে তাদের সংখ্যালঘু নীতি প্রকাশ করে। ৩ পৃষ্ঠার সেই বিবৃতিতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সসম্মানে দেশের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তিন পৃষ্ঠার ওই বিবৃতিতে এনইউজি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু নীতি-কৌশল প্রকাশ করে। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. ক্ষমতায় গেলে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হবে
২. রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নিপীড়নের বিচার করা হবে
৩. ১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন বদলানো হবে এবং ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড বা এনভিসি পদ্ধতি বাতিল করা হবে
৪. নতুন নাগরিকত্ব আইনে সব রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দেয়া হবে
৫. নতুন সংবিধান তৈরিতে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে
২০১৭ সালে সর্বশেষ রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর মিয়ানমারের রাজনীতিকদের এভাবে রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে আর দেখা যায়নি। বিবৃতিতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখা জান্তা সরকারকে উৎখাত করতে রোহিঙ্গাদের সাহায্যও প্রার্থনা করেছে এনইউজি। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘আমরা সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ‘স্প্রিং রেভ্যুলিউশন’ বা বসন্ত বিপ্লবে অংশ নিতে আমাদের ও অন্যদের সঙ্গে হাত মেলাতে রোহিঙ্গাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’’
এনইউজি’র ঘোষণায় রোহিঙ্গা পরিচয়ের স্বীকৃতি
বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি)’র ঘোষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ তথা ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ের স্বীকৃতি। মিয়ানমার সরকার ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ দেশটিতে রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০১০ সালে সু চি বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে ২০১৫ সালে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসলেও তাঁর দল এনএলডি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উল্লেখ পর্যন্ত এড়িয়ে গেছে, তারা রোহিঙ্গাদেরকে ‘আরাকানি মুসলিম’ বা ‘বাঙালি’ বলে বর্ণনা করতো।
অন্যদিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত বলে যাচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ বলে কিছু নেই। যার শুরু সেই ১৯৬২ সাল থেকে যখন মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করেছিল সেসময়ের সেনাবাহিনী। ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার রোহিঙ্গাদের বলা হতো বাঙালি ‘কালা'৷ ২০১২ সাল থেকে বলা হতো ‘কালা সন্ত্রাসী'৷ অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের বহিরাগত বলে বর্ণনা করতো ১৯৬২ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা সামরিক সরকারগুলো।
রোহিঙ্গা জাতিসত্ত্বা প্রশ্নে বর্তমান সামরিক সরকারের অবস্থানও আগের জান্তা সরকারগুলোর মতোই। ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর গত ২০ মে হংকংভিত্তিক চীনা ভাষার সম্প্রচারমাধ্যম ফিনিক্স টেলিভিশন ফিনিক্সকে দেয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে দেশটির জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং বলেছেন, ‘‘মিয়ানমারে তারা (রোহিঙ্গারা) বাংলাদেশ থেকে আসা বহিরাগত।’’
সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারের জান্তা প্রধান দাবি করেন, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা কোনও জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নয়—এমন ইঙ্গিত করে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বলেন, ‘‘আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পর আদমশুমারিতে বাঙালি, পাকিস্তানি, চিট্টাগং শব্দ নিবন্ধন করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা বলতে কোনো শব্দ ছিল না। তাই আমরা এটি কখনও গ্রহণ করিনি।’’
২০১৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন মিয়ানমার সফর করেন তখন তিনি যেন রোহিঙ্গা শব্দটি তাঁর বক্তব্যে ব্যবহার করেন সেজন্য আন্দোলন হয়েছিলো। সেসময় টুইটারে ইংরেজিতে #রোহিঙ্গা এবং #জাস্টসেদেয়ারনেম হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী ব্যতিক্রমী প্রচারণা চালানো হয়েছিলো ৷ শেষ পর্যন্ত বারাক ওবামা তাঁর বক্তব্যে রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নতুন করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। সেবছর নভেম্বরে খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সফর করলেও তিনি মিয়ানমার অবস্থানকালীন সময়ে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। পরে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ সফরে এসে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি মুখে নেন পোপ ফ্রান্সিস৷
কাজেই বলা যায় ১৯৬২ সালের পর থেকে মিয়ানমার রোহিঙ্গা নামক শব্দ কিংবা রোহিঙ্গা জাতিসত্ত্বাকেই অস্বীকার করে আসছে। সেখানে এনইউজি’র রোহিঙ্গা জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি এ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক। বিশ্লেষকদের মতে এনইউজি স্পষ্টতই মিয়ানমারের সামরিক সরকারের চাইতে একটা পরিষ্কার ভিন্ন অবস্থান নিতে চাইছে।
মিয়ানমার বিষয়ক বিশ্লেষক ল্যারি জ্যাগাবান বিবিসিকে বলেন, ‘‘এটি আসলে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের তরফ হতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। আর এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ের স্বীকৃতি।’’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এর প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “সমগ্র মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি বিরাট মুহূর্ত। এনইউজি’র নতুন নীতি ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে এবং এর ফলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার পথ সুগম হবে।”
এনইউজি’র বিবৃতিতে ১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন বদলানোর ঘোষণা
সাধারণভাবে এটা বলা হয় যে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে নাগরিকত্বহীন হয়ে পড়ে। এ আইনে মিয়ানমারে বসবাসকারীদের সিটিজেন (Citizen), এসোসিয়েট (Associate) এবং ন্যাচারালাইজড (Naturalized) পর্যায়ে ভাগ করা হয়।
১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে, ১৮২৩ সালের পরে আগতদের এসোসিয়েট (Associate) আর ১৯৮২ সালে নতুনভাবে দরখাস্তকারীদের ন্যাচারালাইজড (Naturalized) বলে আখ্যা দেয়া হয়। ওই আইনের ৪ নম্বর ধারায় আরও শর্ত দেয়া হয়, কোনো জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রের নাগরিক কি না, তা আইন-আদালত নয়; নির্ধারণ করবে সরকারের নীতি-নির্ধারণী সংস্থা ‘কাউন্সিল অব স্টেট’। আর বিতর্কিত এ আইনের কারণে রোহিঙ্গারা নাগিরকত্বহীন ভাসমান জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হয়।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতের পথে ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনকে বাধা হিসেবে শনাক্ত করেছিল কফি আনান কমিশন। রাখাইন সংকট অনুসন্ধানে মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি’র উদ্যোগে গঠিত সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিশন ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা প্রদান করে সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করাকেই রাখাইন সংকট সমাধানের পথ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। কফি আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশের মধ্যে একটি ছিলো ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমে ফেরাতে যতদিন পর্যন্ত মিয়ানমার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বদল না করছে ততদিন পর্যন্ত তাদের ফেরা কষ্টকর। আর ফিরলেও আগের মতো রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত হতে হবে। তাই ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বদলানো খুবই জরুরি আর সে ঘোষণা দিয়েছে এনইউজি ।
এনইউজি’র ঘোষণায় ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড বা এনভিসি বাতিলের প্রতিশ্রুতি
১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে পরিচয়হীনতার পর্ব শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও কোনো নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রসিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, আবার কখনও ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ বা এনভিসি নামের রংবেরঙের পরিচয়পত্রে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলার উদ্যোগ নেয় মিয়ানমার।
২০১২ সালে রোহিঙ্গাদের দেয়া হয় হোয়াইট কার্ড (ভোটাধিকার প্রয়োগের লক্ষে), যা ২০১৫ সালে বাতিল করে সে বছর থেকে দেয়া হয় ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ বা এনভিসি। কাজেই মিয়ানমার প্রদত্ত রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ প্রাপ্ত কার্ড হলো ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ বা এনভিসি।
এমনকি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষে যে চুক্তি সাক্ষর করেছে সেখানেও ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ প্রদানের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এনভিসি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। কারণ এই এনভিসি দেয়ার মাধ্যমেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিদেশী বলে আখ্যা দিয়ে থাকে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এনভিসিকে সবচেয়ে বড় বাঁধা বলে অভিহিত করেছে। ২০১৯ সালে এনভিসি: অ্যা ব্যারিয়ার টু রোহিঙ্গা রিপ্যাট্রিয়েশন শীর্ষ ওই প্রতিবেদনে ঐ কার্ডের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে বিদেশিদের মতো করে রাখা হয় বলে উল্লেখ করা হয়। মানবাধিকার সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক কিয়াও উইন বলেন, ‘‘মিয়ানমার সরকার এনভিসিকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রথম ধাপ দাবি করলেও তা বিতর্কিত। এই কার্ড দিয়ে বছরের পর বছর রোহিঙ্গাদের আলাদা চিহ্নিত করে বিদেশিদের মতো করে রাখা হয়েছে।’’
এনইউজে তাদের বিবৃতিতে রোহিঙ্গা এবং অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সেনাবাহিনী যে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড বা এনভিসি পদ্ধতি চালু করেছিল সেটা বাদ দেয়া হবে বলে জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে হঠাৎ কেন এই পরিবর্তন?
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরোধিতাকারী ‘দ্য ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট অব দ্য রিপাবলিক অব দ্য ইউয়িন অব মিয়ানমার’ বা ‘এনইউজি’ বা ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ বা ‘ছায়া সরকার’ গঠিত হয় ২০২০ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতাচ্যুত এমপিদের সমন্বয়ে। এ ছায়া সরকার এখন যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও স্বীকৃতি লাভের জন্য। অনেক বিশ্লেষকের তাই অভিমত, ছায়া সরকার এর প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়কে সহজতর করে তোলার কৌশল হিসেবে তাঁরা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণাটি দিয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘এনইউজে’র এই পরিবর্তনকে অনেকে আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপকে বড় ভূমিকা হিসেবে বর্ণনা করছেন। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির এক শুনানিতে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই শুনানিতে এনইউজির এক দূতকে মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্রাড শেরম্যান প্রশ্ন করেছিলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তাদের অবস্থান কী? সেসময় এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ওই দূত। এরপরই এনইউজি রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের অবস্থান বদলেছে বলে ধারণা অনেকের।
মিয়ানমারে বৈধ সরকার হিসাবে এনইউজিকে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে এর সদস্যরা। কিন্তু সুচির অতীত নেতৃত্বের নোংরা রাজনীতির কারণে এনইউজি এখন পর্যন্ত কারো স্বীকৃতি পায়নি বলে ধারণা অনেক বিশেষজ্ঞর। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির শুনানির সময় ইউএস কংগ্রেসম্যান টেড লিউ বলেন, ‘তিনি এনইউজি সরকারের যেকোনো স্বীকৃতি বন্ধ করে দেবেন, যদি না এনইউজি’র শ্যাডো ক্যাবিনেটে কোনো রোহিঙ্গা প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’ এই শুনানির পর তিনি এক টুইট বার্তায় লিখেন : ‘ন্যাশনাল ইউনিটি সরকারে কোনো রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এতে পরিবর্তন আনা না হলে আমরা এই শ্যাডো সরকারকে সহায়তা করতে পারব না।’ এই আলোকে দেখলে, এনইউজির রোহিঙ্গা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা এ সরকারের সঠিক বিবৃতি কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলাই যায়।
মিয়ানমার বিষয়ক বিশ্লেষক ল্যারি জ্যাগান বিবিসি বাংলাকে বলেন, এনইউজি যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পেতে চায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে চাইলে তাদের অবশ্যই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অবস্থান বদলাতে হবে।
তবে ল্যারি জ্যাগান আরো বলেন, শুধু আন্তর্জাতিক চাপেই নয়, সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের রাজনীতিবিদদের চিন্তা-ভাবনাতেও নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, সামরিক অভ্যুত্থান মিয়ানমারের জনগণকে এটি উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে যে, রাখাইনে সামরিক বাহিনী যে নিপীড়ন চালিয়েছিল, সেটিই এখন অন্য জায়গায় ঘটছে। কাজেই দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
মিয়ানমারের ছায়া সরকারকে অনেকে আবার 'প্রবাসী সরকার' বলেও অভিহিত করে থাকেন। এ সরকারে সু চির দল এনএলডি'র বাইরেও আছে সংখ্যালঘু বিদ্রোহী বিভিন্ন গোষ্ঠী বিশেষ করে আরাকান আর্মি, কাচিন, শান, কারেন, সান্নি, থায়াং, জুমি প্রভৃতি এবং বিভিন্ন রাজ্যে সক্রিয় বিভিন্ন আঞ্চলিক দলও এখানে যোগ দেয়। ফলে, এ ছায়া সরকার গোটা মিয়ানমারে একটা গণভিত্তি পেতে শুরু করেছে এবং তাদের ঘোষণা নিশ্চিতভাবেই রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
এনইউজি’র ঘোষণা ও বাংলাদেশের অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা রোহিঙ্গা সংক্রান্ত এনইউজি’র ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও বাংলাদেশ এখনো এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কারণ সম্ভবত, মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের সঙ্গে আলোচনার দরজা বন্ধ করতে চায় না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। এ বিষয়ে বর্তমান জান্তা সরকারের সঙ্গেও আলোচনায় আগ্রহী বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে সম্প্রতি ওয়াশিংটনের নিউলাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির পরিচালক এবং স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউট ইউএস আর্মি ওয়ার কলেজের গবেষণা অধ্যাপক ড. আজীম ইব্রাহিম সৌদি সংবাদমাধ্যম আরব নিউজে লেখেন, ঢাকা আপাতত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে প্রকাশ্যে একধরনের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে বাংলাদেশকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এই প্রচেষ্টার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
কারণ হিসেবে বলা যায়, সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েক দিন পরেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী প্রধান মিন অং হ্লাইং দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। কিন্তু মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ ব্যস্ত থাকা জান্তা সরকারের আমলে এই প্রক্রিয়ায় কোনও অগ্রগতি হয়নি। বরং মিন অং হ্লাইংয়ের সর্বশেষ বক্তব্যে এটি নিশ্চিত যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আগ্রহী নয়।
আর তাই, ড. আজীম ইব্রাহিমের মতে, পর্দার আড়ালে বাংলাদেশকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারের বিনিময়ে স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে এনইউজির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে, মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের সঙ্গে এমন চুক্তি না হওয়ার চেয়ে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনইউজির ঘোষণা বা অঙ্গীকারের ফলে যে রোহিঙ্গা সমস্যার নাটকীয় সমাধান হবে তা হয়তো আশা করাও ঠিক হবে না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর মায়ানমারের তরফ থেকে এটাই এখন সবচেয়ে বড় অগ্রগতি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথে যে কোন অগ্রগতিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক মুন্সিয়ানা দেখাতে হবে। মায়নামারের ভেতরের একটি অংশ যে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত আছে সেটাকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এতে দেশটিতে রোহিঙ্গাবিরোধী গোষ্ঠী ও তাদের আন্তর্জাতিক মিত্রদের ওপর চাপ বাড়বে এবং রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমে প্রত্যাবাসনের পথও সুগম বলে বলেই বিশ্বাস সংশ্লিষ্টদের।
মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক
বিষয়: মু: মাহবুবুর রহমান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: