যে দেশে শিক্ষক আর ঝাড়ুদারের বেতন সমান : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
প্রকাশিত:
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:১৮
আপডেট:
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:১৯
ছেলেবেলায় গল্পে পড়েছিলাম, যে দেশে তেল আর ঘিয়ের দাম সমান সে দেশে বিচার নেই। কিন্তু যে দেশে ঘিয়ের চেয়ে তেলের দাম বেশি সে দেশ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।
ড্রাইভারের সমান বেতন স্কেল নিয়ে মানসিক কষ্টে ভুগছিলেন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকবৃন্দ। অবশেষে এই অসম্মান থেকে শিক্ষকদের মুক্তি দিতে ড্রাইভারদের বেতন বাড়িয়ে দেয়া হলো। এখন শিক্ষকদের চেয়ে উন্নত স্কেলে ড্রাইভারদের বেতন।
শিক্ষকদের উদ্দ্যেশে জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেছিলেন, ড্রাইভারের সমতূল্য স্কেলে বেতন পান বলে নিজেদের ছোট করবেন না।
তাই তো, কেন ছোট মনে করবেন নিজেদের? সম্মানের স্যুপ খাবেন, ভাজি খাবেন, চর্চরী খাবেন।
এতো এতো সম্মান যদি এই স্বল্প বেতনের শিক্ষকতা পেশায় তাহলে এই পেশায় সবাই কেন চলে আসে না?
চাণক্য শ্লোকে আছে-- "এক অক্ষরদাতা গুরুকেও গুরু বলিয়া মান্য করিবে। যে এক অক্ষরদাতা গুরুকে গুরু বলিয়া মান্য করে না সে কুকুর যোনীতে জন্মগ্রহণ করিয়া চন্ডালত্ব লাভ করিবে।"
সব সম্পর্কই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মা- বাবার সমকক্ষ নয়। সব পেশাই সম্মানিত কিন্তু শিক্ষকের সমতূল্য নয়।
আর্থিক মূল্যে সব কিছু মাপা যায় না।
একজন শিক্ষকের সম্মান মর্যাদা যে সমাজে আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করা হয় সে সমাজ কতোটা দেউলিয়া তা সহজেই অনুমান করা যায়।
শিক্ষক শব্দই এ জাতি বুঝতে অপারগ। এই শব্দ ধারণের ক্ষমতা শিক্ষকদের নিজেদেরও মনে হয় নাই।
নয়তো যে পেশাটি হওয়া উচিৎ সবচেয়ে মর্যাদা আর সম্মানের সে পেশাটা হলো অবহেলা আর অবজ্ঞার।
আমাদের প্রাপ্তি অনেক। তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে এখন আমরা মধ্যম আয়ের দেশ। আমদানি বাদ দিয়ে এখন আমরা রপ্তানি করি।
উন্নয়নের ছোঁয়া জীবনের সর্বক্ষেত্রে। আমাদের জীবন যাত্রার মান বেড়েছে। বেড়েছে আয়। অথচ শিক্ষকের জীবনমানের কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং শিক্ষক শব্দটি হারিয়েছে তার নৈতিকতা এবং উপযোগিতা।
নীতি বোধের বাণী শ্রবণে জীবন চলে না। একটি উন্নত জীবনমান ব্যতীত কেন এই পেশায় আসবে মেধাবী আর সৃজনশীলরা? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এখন এসেছে।
একটু একটু করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি অনেকটা পথ। পরিবর্তন এসেছে অনেকের পেশায়, জীবনে। যেমনঃ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব-- ছিল ১৪ তম গ্রেড।বর্তমানে ১০ম গ্রেড।
কৃষি উপ -পরিদর্শক এস এস সি শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ডিপ্লোমা করে ১০ তম গ্রেড।
ভূমি অফিসের তহশিলদার ১৭ তম গ্রেড থেকে বর্তমানে ১০ তম গ্রেডে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ১৬ তম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেডে।
নার্সেরা ডিপ্লোমা করে এখন ১০ তম গ্রেডে।
যে শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রাথমিকের শিক্ষকের বেতন ১৩ তম গ্রেডে তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্য পেশাজীবিদের বেতন ১০ তম গ্রেডে।
"২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।" (ভিশন ২০২১' ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা- ২০০৯, পৃষ্ঠাঃ ৫১)
কথা রাখেনি তারা। সবার ভাগ্যের পরিবর্তন দেখেছে শিক্ষক সমাজ। শুধু নিজেদের বঞ্চনায় নীরব থেকেছে এতোকাল।
মা বাবার অধিকারের জন্য চিৎকার আর পাড়া প্রতিবেশীদের অধিকারের জন্য চিৎকার এক নয়।
শিক্ষক তার বঞ্চনা আর দারিদ্রতাকে মেনে নিয়ে এতোকাল দয়া করেছে এ অকৃতজ্ঞ জাতিকে।
ইতিহাস বলে, অনেক অত্যাচারি শাসকও অবনত শিরে শ্রদ্ধায় দাঁড়িয়েছে শিক্ষা গুরুর সম্মূখে। কিন্তু নিজেদের যখন সভ্য বলে, শিক্ষিত বলে দাবি করছি তখন অসম্মানের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পাচ্ছে কিছু অসৎ, দাম্ভিকের আচরণে।
অনেকদিন তো হলো।অসৎ লোকের সততার বাণী শ্রবণে, নীতিবাক্য ধারণ করে কেটে গেছে সময়। পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে।
শিক্ষকের শিক্ষার্থীরা মন্ত্রী হয, সচিব হয়। ভাগ্য পাল্টায় না শিক্ষকদের। যে প্রয়োজনটা উচ্চ পর্যায়ে থাকা শিষ্যদের অনুধাবন করা উচিৎ ছিল, সে প্রয়োজনটা নিয়ে আজ শিক্ষকবৃন্দ যখন কথা বলছেন তখন গোটা জাতির লজ্জিত হওয়া উচিৎ।
পঞ্চাশ বছরেও কেন শিক্ষকের জীবনমানে পরিবর্তন এলো না? কেন অন্যরা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হলো অথচ শিক্ষক রয়ে গেল তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী? কেন মেধাবীরা এই পেশায় আসে না? কেন মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানো শিক্ষককে রাষ্ট্র ভয় পায়? কেন প্রকৃত শিক্ষক তৈরিতে রাষ্ট্র কখনোই আগ্রহী হয় না?এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
প্রাথমিক স্তর শিক্ষার ভিত। এই স্তর নড়বড়ে হলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়বে।
বিদেশ থেকে আমদানি করা শিক্ষাদান পদ্ধতির সাথে সাথে অন্যান্য দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ভাতা এবং জীবনমানের দিকেও লক্ষ রেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
পাশের দেশ ভারতের সঙ্গেই আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্য আকাশ পাতাল।
যে দেশ নিজ অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি করতে পারে, সে দেশ তার দেশের শিক্ষা গুরুকে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী করে রাখতে পারে না।
১০ম গ্রেডে বেতন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের অধিকার। এই সত্যটা বুঝবার জন্য শিক্ষক শব্দটা বুঝতে হবে। শিক্ষক শব্দের সম্মান এবং মর্যাদা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।
গুরুর অসম্মান পরোক্ষ ভাবে জাতির অসম্মান।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট
বিষয়: শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: