রংমেলান্তির বাজেট : গৌতম সরকার
প্রকাশিত:
২৫ আগস্ট ২০২৪ ১৫:৫১
আপডেট:
২৫ আগস্ট ২০২৪ ১৯:০৯
চলুন একটা হিসেব বুঝে নেওয়া যাক, গত দুই আর্থিক বছরে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির ছিল সাত শতাংশেরও বেশি, প্রায় আট শতাংশের কাছাকাছি; নীতিআয়োগের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা কমে পাঁচ শতাংশ হয়েছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে দেশে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ঘটেছে। গত কয়েক দশক ধরে জনবৃদ্ধিজনিত সুবিধা, রাজনৈতিক স্থিরতা এবং অনুকূল ভূ-রাজনৈতিক আবহ ভারতের প্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে এবং গোটা বিশ্বে অন্যতম দ্রুত-উন্নয়নের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কোভিড পরবর্তী অসুস্থ অর্থনীতিকে দ্রুত সামাল দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে প্রচুর হাততালি পেয়েছে। সবচেয়ে উল্লেযোগ্য, ভারতের ক্রমাগত কমতে থাকা রাজস্ব ঘাটতি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির হিংসের কারণ হয়ে উঠেছে। এইসব তথ্যকে সামনে রেখে দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি স্বাধীনতার শতবর্ষে দেশবাসীকে ‘বিকশিত ভারত’-এর স্বপ্ন দেখান, উন্নয়নশীলের খোলস ছেড়ে উন্নত দেশের তকমা জুটিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে বিশেষ দোষ দেওয়া যায়না। এরপর চলুন মুদ্রার অন্য পিঠটা দেখে নিই।
এখানে জিডিপির যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব ঢুকে আছে। এছাড়া ওই বৃদ্ধি উপরের সারির মানুষদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। উচ্চআয়ের মানুষ আর কর্পোরেটগুলোর আয় বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে গরীব, মধ্যবিত্তদের দিন গুজরান কঠিন হয়ে পড়ছে। ভারতের যে প্রবৃদ্ধির ফলাও করে বলা হচ্ছে অর্থনীতিদের মতে সেই বৃদ্ধিকে বলা হয় ‘K-টাই ‘ প্রবৃদ্ধি, যেটি একদিকে একটা শ্রেণীকে ক্রমাগতভাবে উপরের দিকে ঠেলে তুলছে আর আরেক দিকে অন্য শ্রেণীকে নিচের দিকে নামাচ্ছে। এই চরম অর্থনৈতিক অসাম্যের কথা বিজেপি নেতৃত্ব স্বীকার করেননা। একটা কথা মনে রাখতে হবে জিডিপি একটা সামগ্রিক হিসেব, তাই শুধু এর দিকে তাকিয়ে থাকল মনে হবে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, কিন্তু বাস্তব হল এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে ভারতের তরুণদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেবে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে ‘কর্মসংস্থান’ শব্দবন্ধটির মধ্যে মহা ফাঁকি লুকিয়ে আছে। কিছু মানুষ চাকরি পেয়ে মাসে মাসে বেতন পাচ্ছে -এটা একধরনের কর্মসংস্থান; আবার যারা ব্যবসা করছে তাদেরও অন্যভাবে কর্মসংস্থান হচ্ছে। সর্বোপরি, এই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অংকে তাদেরও ঢোকানো আছে যারা কিছু না পেয়ে রাস্তায় ঝুড়ি নিয়ে বসে সব্জি বেচছে বা তেলেভাজার দোকান দিয়েছে।
এমত পরিপ্রেক্ষিতে এনডিএ জোট সরকারের ২০২৪-২৫-এর পূর্ণ বাজেট পেশ হল। এখানেও সবাইকে আরেকদফা হতাশ হতে হল। যেখানে দেশের মূল তিনটি সমস্যা হল- তীব্র বেকারত্ব, খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মুদ্রাবৃদ্ধি এবং বিপুল অর্থনৈতিক অসাম্য; সেখানে বাজেটের তিন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হল, তরুণ প্রজন্মকে ভিত্তিহীন আশ্বাস, কৃষক ও মধ্যবিত্তের ভোট ফিরে পাওয়ার প্রকল্প এবং দেশের বেকারত্বের সমস্যা মেনে নেওয়া। গত লোকসভা ভোটে মোদী সরকারে ‘ইস বার চারশো পার’ স্লোগান রীতিমত ডিগবাজি খেয়ে ২৪০-এ নেমে এসেছে। তরুণ প্রজন্ম, মধ্যবিত্ত, কৃষক এবং ছোট মাঝারি শিল্পমালিকরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় বিজেপির এই হাল। তাই খেসারত দিতে ফেব্রুয়ারির অন্তর্বর্তী বাজেট থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে এই বাজেটে যেমন বেকারদের কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিতে হয়েছে, তেমনি মধ্যবিত্তকে খুশি করতে আয়করে কিছুটা ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। গ্রামের ভোট ফিরে পেতে কৃষিক্ষেত্রে ১.৫২ লক্ষ কোটি টাকা এবং গ্রামোন্নয়ন খাতে ২.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। নোট বাতিল, জিএসটি এবং কোভিড এই তিন ফলায় আটকে প্রায় দমবন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্যও আর্থিক সুরাহার ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
এই প্রথমবার বেকারত্বের সমস্যা স্বীকার করে নেওয়া হলেও তার সমাধানের জন্য কোনও সরকারি প্রকল্প নয়, বরঞ্চ শিল্পমহলের আনুগত্যের উপর নির্ভর করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ২ লক্ষ কোটি টাকার ‘প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে, বাকি সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কর্পোরেট সেক্টরের উপর। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় এক কোটি ছেলেমেয়ের একবছরের ইন্টার্নশিপের কথা ঘোষণা করেছেন। রীতিমতো চমক লাগানো প্রস্তাব। দেশের মোট পাঁচশোটি শীর্ষসংস্থা এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। হিসেব বলছে সেক্ষেত্রে প্রতিটি সংস্থাকে ২০ হাজার ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এখন কথা হল, এই পাঁচশো সংস্থার মধ্যে সিংহভাগেরই নিজস্ব কর্মীই রয়েছে দশ হাজারের কম! সেই সব সংস্থার বছরে কুড়িহাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মত সঙ্গতি বা পরিকাঠামো আছে তো? সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি ট্রেনিকে এককালীন ছয়হাজার এবং মাসিক পাঁচহাজার টাকা করে দেওয়া হবে আর বাদবাকি খরচের দায়িত্ব কর্পোরেটগুলোর সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বুঝুন কাণ্ড !
ভারতবর্ষকে এখন ’তথ্যচালিত অর্থনীত‘ বা ‘ডেটা ড্রিভেন ইকোনমি’ বলা যায়। সরকারি রিপোর্টে আশাব্যঞ্জক সব তথ্য উঠে এলেও তাঁর বস্তুগত উপস্থিতি খুঁজতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের খোঁজ পড়ছে। দুর্জনে বলে বেড়াচ্ছে এবারের বাজেট নাকি ‘কুর্সি বাঁচানোর বাজেট’ কেউ কেউ আবার বলছে ’তোফার বাজেট’ দুর্জনে তো কত কথাই বলে! সবকথা কানে নিলে সরকার চলেনা। সেই ২০১৯-এর অন্তর্বর্তী বাজেটের পর মায়াবতীজীও কটাক্ষ করে বলেছিলেন 'জুমলেবাজি’ বাজেট, আর বামেরা নাম দিয়েছিল 'বাগাড়ম্বর' বাজেট। এখন কথা হচ্ছে, বিরোধীরা শুধু বিহার আর অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য ৭৪ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দটাই দেখছে, অন্যদিকে আসন্ন ভোটমুখী মহারাষ্ট্র, বিহার আর ঝাড়খণ্ডের জন্য যে ঝুলিতে কিছুই বাঁচাতে পারলো না সেব্যাপারে তো কোনও সহানুভূতি দেখালো না!
যুগ যুগ ধরে শাসক তার সিংহাসন ধরে রাখতে জনগণকে সত্যি মিথ্যের ভুলভুলাইয়াতে ঘুরিয়ে মেরেছে। তবে বর্তমান দিন হল তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। সরকারি তথ্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আরও দশটি বেসরকারি সংস্থা তথ্যের চালাকিকে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরে। ভারতে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। ২০১২ সালের ভোগ-ব্যয় সার্ভে থেকে জানা যায় দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ২২ শতাংশের বেশি। বিশ্বক্ষুধা সূচকে ভারত ক্রমশ পিছোচ্ছে, পড়শি দেশগুলোও ভারতকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এরপরও নীতি আয়োগ কোন জাদুমন্ত্রে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা পাঁচ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনে সেটাই আশ্চর্যের!
মজার বিষয় হল, ভারতে পরিবারভিত্তিক আয়ের বিপরীতে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়না। আর এখানেই আসল কারচুপি ঘাপটি মেরে থাকে। একটা অংকের কারচুপি দেখে নেওয়া যাক, ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্যের সীমারেখা নির্ধারণ করেছিল দৈনিক মাথাপিছু এক ডলার। মূল্যস্ফীতির কারণে ২০১১ সালে সেই হিসেব বেড়ে হয় ১.৯০ ডলার। দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞ এস সুব্রহ্মনিয়ানের মতে, ভারতে দিনপ্রতি ১.৯০ ডলার খরচ করতে না পারা লোকের সংখ্যা সরকার স্বীকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি ছিল, কারণ সেই হিসেবটা করা হয়েছিল এক ডলারের পরিপ্রেক্ষিতে, ১.৯০ ডলারের নিরিখে নয়। সাধারণ মানুষের স্মৃতিস্বল্পতার কথা স্বীকার করে নিয়েও বলা যায়, ‘সাধু সাবধান! জনগণ কিন্তু সব বুঝতে শিখেছে।’
গৌতম সরকার
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা
বিষয়: গৌতম সরকার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: