মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে শিক্ষক দিবসে খোলা চিঠি : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
প্রকাশিত:
৬ অক্টোবর ২০২৪ ২২:৩৭
আপডেট:
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:২২
সম্মানিত প্রধান উপদেষ্টা,
সালাম নিবেন।
আপনি মাসে একটা চিঠি লিখতে বলেছেন সাধারণ মানুষকে। জানিনা এ চিঠি আপনার দৃষ্টি গোচর হবে কি না। তবুও কেউ একজন এই প্রথম ক্ষমতার শীর্ষে বসেও আমাদের মতো সাধারণের কথা শুনতে চেয়েছেন। তার চেয়েও বড় কথা চিঠি লিখতে বলেছেন এই এসএমএস- এর যুগে। বহুকালের দুঃশাসন আর দম বন্ধ হওয়া পরিবেশ কাটিয়ে এটাই আমাদের প্রথম সাফল্য।
আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বাধ্য হয়ে নয়, স্বপ্ন দেখেই এই পেশায় আমার আগমন।
প্রথম যেদিন আমি ক্লাসে যাই সেদিন আমার সামনে ৫০/৬০ টি ছোট নিষ্পাপ মুখ। আমার মাথায় তখন সমরেশ মজুমদারের কালবেলা উপন্যাসের "একতাল মাংসপিণ্ড"। বেগম রোকেয়া, সুলতানা রাজিয়া, প্রীতিলতা,রাবেয়া বসরীসহ অসংখ্য স্বপ্নের মুখ।
কোন স্বপ্নই সফল হয়নি শেষ পর্যন্ত। শাসক আর আমলাদের স্বপ্নের বাস্তবায়নে কেটে গেছে গোটা একটা জীবন। যতদিন গেছে ততই অসম্মানের বোঝা বেড়েছে।
বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয় এর অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকের সন্তান হবার কারণে দরিদ্রতা আর সামাজিক অবজ্ঞা অসম্মান বহন করেই বড় হতে হয়েছে।
সময় যত এগিয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীর "পাদটীকা" গল্পের পন্ডিতমশাইয়ের দেওয়া গাণিতিক সমস্যা আরো জটিল হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের পন্ডিতমশাইয়ের দেওয়া গাণিতিক সমস্যার সমাধান তিন আমল পার হবার পরও তার শিক্ষার্থীরা দিতে পারেনি।
আপনার জ্ঞান, প্রজ্ঞায় অভিভূত শুধু দেশই নয়,সারা বিশ্ব। আপনি কি পারবেন সেই পন্ডিতমশাইয়ের গাণিতিক সমস্যার সমাধান দিতে?
শিক্ষার নানা স্তরের মূল এবং প্রথম স্তর প্রাথমিক শিক্ষা। অন্যান্য স্তরের সাফল্য নির্ভর করে প্রাথমিক স্তরের মজবুত ভিত্তির ওপর। প্রাথমিকে অবকাঠামো এমন কি পাঠ্য পুস্তক না থাকলেও সমস্যা নেই। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীই এই স্তরের মূল উপাদান।
আমাদের দেশে অবকাঠামোগত ঝলকে চোখ ঝলসে গেলেও শিক্ষার মূল উপাদান শিক্ষকদের এই রাষ্ট্র অবজ্ঞা অবহেলা করেছে আজন্ম।
আর্থিক দীনতার সাথে দিনে দিনে যুক্ত হয়েছে সামাজিক অসম্মান, অপমান। তবে, এই দেশ দিয়েছে শিক্ষকদের একটি শিক্ষক দিবস। এই দিবস প্রতি বছর চমৎকার একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে।
শিক্ষকদের আর্থিক দীনতার প্রশ্ন উঠলেই সমাজের বিজ্ঞজনেরা বলেন, শিক্ষকতা মহান পেশা। এটাকে আর্থিক মাপকাঠিতে বিবেচনা করা উচিৎ না।
এই মহান পেশায় এ পর্যন্ত কাউকে দেখলাম না নিজের চাকুরি ছেড়ে চলে আসতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে একজন শিক্ষক পদোন্নতিবিহীন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী কেন হবেন সেটা কি একটু ভেবে দেখবেন?
প্রবাদ আছে, কথায় চিড়া ভিজে না।
আমরা ফিনল্যান্ডের উন্নত শিক্ষা কারিকুলাম এনে সগর্বে প্রচার করলাম আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত দেশের সমতূল্য। প্রশ্ন হলো, আমরা উন্নত শিক্ষা আমদানি করলাম কিন্তু উন্নত শিক্ষা কার্যকর করার জন্য যে উন্নত শিক্ষক প্রয়োজন সেটা কি অনুসরণ করেছি?
ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা। আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থানের দিক দিয়েও শিক্ষকতা সবার পছন্দের তালিকায় প্রথম থাকে।
বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষকদের দিকে লক্ষ করলে আমরা যে চিত্র দেখিঃ
১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ভিআইপি বিবেচনা করে এমন দুটি ধরণের লোক রয়েছে: বিজ্ঞানী ও শিক্ষক।
২) ফরাসী আদালতে কেবল শিক্ষকদেরই চেয়ারে বসার অধিকার রয়েছে।
৩) জাপানের পুলিশ সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার পরেই একজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করতে পারে।
৪) দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিটি শিক্ষক কেবল তার আই-কার্ড প্রদর্শন করে দক্ষিণ কোরিয়ার মন্ত্রীর সমান অধিকার পান।
৫) আমেরিকান এবং ইউরোপীয় দেশগুলিতে প্রাথমিক শিক্ষকরা সর্বাধিক বেতন পান, কারণ তারা কেবল কাঁচা মাটি পাকা করেন।
৬) ফিনল্যান্ডে টপারদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থা কী তা আর নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। সাহিত্য সমাজের দর্পন। এদেশের সাহিত্যে শিক্ষকদের জন্য বিশেষণ " সামান্য শিক্ষক।"
সমাজে শিক্ষকদের বিশ্বাস আর মর্যাদার একটা জায়গা ছিল। কালের বিবর্তনে সেটাও হারিয়ে গেছে।সময়ের সাথে সাথে মর্যাদা আর গ্রেডের দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে অনেক পেশার মানুষ। শুধু প্রাথমিকের শিক্ষক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন একই জায়গায়।
শিক্ষকদের চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও দশম গ্রেডে অনেকেই বেতন পাচ্ছন। একই শিক্ষাগত যোগ্যতা বা কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও যারা দশম গ্রেডের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা তারা হলেনঃ
ইউনিয়ন পরিষদের সচিব-- ছিল ১৪ তম গ্রেড।বর্তমানে ১০ম গ্রেড।
কৃষি উপ -পরিদর্শক এস এস সি শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ডিপ্লোমা করে ১০ তম গ্রেড।
ভূমি অফিসের তহশিলদার ১৭ তম গ্রেড থেকে বর্তমানে ১০ তম গ্রেডে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ১৬ তম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেডে।
নার্সেরা ডিপ্লোমা করে এখন ১০ তম গ্রেডে।
যে শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রাথমিকের শিক্ষকের বেতন ১৩ তম গ্রেডে তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্য পেশাজীবিদের বেতন ১০ তম গ্রেডে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন একটা 'এ' ক্যাটাগরি পত্রিকার ঝাঁড়ুদারের সমান।
আমরা উন্নয়নে রোল মডেল হতে পারি অথচ আমাদের শিক্ষা গুরুদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করতে পারি না।
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর কাছে প্রথম শ্রেণির ফলাফল কি করে আশা করেন?
যে পদে নিয়োগ সে পদেই যেতে হয় অবসরে। অবসরে যাবার পর ভিটামাটি বেচে ঘুষ দিয়ে পেতে হয় পেনশনের টাকা।
বিখ্যাত পাকিস্তানি লেখক মারহুম আশফাক আহমেদ লিখেছেন, রোমে (ইতালি) ব্যস্ত থাকার কারণে আমি সময় মতো ফি জমা দিতে পারিনি, যার কারণে আমাকে আদালতে যেতে হয়েছিল।
বিচারকের সামনে হাজির হলে, তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি বলেছিলাম যে আমি একজন অধ্যাপক, আমি ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম তাই সময় পেলাম না।
আমি শেষ করার আগে বিচারক বলেছিলেন -
A TEACHER IN THE COURT ....!
এবং প্রত্যেকে উঠে দাঁড়াল এবং আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে চালান বাতিল করে দিল, সেদিন আমি জানতে পারলাম সে দেশের সাফল্যের রহস্য।
আমাদের দেশে আমরা উন্নয়নের কথা বলি। উন্নত হবার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষকের সম্মান কোথায়?
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স করা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের শুরুর বেতন --
গ্রেডঃ
১৩ তম বেতন স্কেলঃ ১১০০০/ --২৬৫৯০/
বেসিক সেলারীঃ ১১০০০/
বাড়ি ভাড়াঃ ৪৯৫০/
চিকিৎসা ভাতাঃ ১৫০০/
টিফিন ভাতাঃ৷ ২০০/
মোটঃ৷ ১৭৬৫০/
বিএফ কর্তনঃ৷ ১১০/
রেভি. স্টাম্পঃ ১০/
মোট কর্তনঃ ১২০/
নীট প্রাপ্যঃ ১৭,৫৩০/
শিক্ষক দিবস আসে, শিক্ষক দিবস যায় কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসে না।
এই সমাজ, রাষ্ট্র স্বীকার করুক আর না করুক আমি বিশ্বাস করি আমার মেধা আর শ্রমের মূল্যায়ন করতে পারেনি এই দেশ। বরং যুগের পর যুগ আমাকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতাসীনেরা তাদের স্বৈরাচারী শাসনের হাতিয়ার হিসাবে। আমি দয়া দেখিয়ে, করুণা করে এই অসম্মানের বেতন আর চোখ রাঙানিকে সহ্য করে এ জাতিকে অক্ষরজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি।
দয়া দীর্ঘকাল দেখালে সেটাকে মানুষ দয়া না ভেবে অধিকার ভেবে নেয়। এ জাতি মনে করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ প্রাথমিকের শিশুদের মতই অবুঝ। এদের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী করে রাখলেও সমস্যা নাই।
নানা ধরণের অনিয়ম, দুর্নীতি আর নির্যাতনে প্রাথমিক শিক্ষায় লেজে গোবরে অবস্থা।
প্রতি বছর শিক্ষক দিবসে একটা করে সমস্যার সমাধান করলেও সমস্যা কমে আসতো।
রেলী, আলোচনা সভা, মানববন্ধন আর একটি প্রতিপাদ্য এসবেই সীমাবদ্ধ শিক্ষক দিবস।
এবার শিক্ষক দিবসে আমরা আপনার কাছে গুরুদক্ষিণা চাই দশম গ্রেড। পাদটীকা গল্পের পন্ডিতমশাইয়ের গাণিতিক সমস্যার সমাধান আপনাকেই করতে হবে।
শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী করে রাখা একটি দেশের জন্য লজ্জার, অসম্মানের। আশাকরি, এই লজ্জা, অসম্মান থেকে মুক্ত হবে দেশ। একটি রক্ত স্নাত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের স্বদেশকে পেয়েছি নতুন করে। এই নতুন মানবিক দেশ গড়ার দায়িত্ব আমরা তুলে দিয়েছি আপনার হাতে। আপনার কাছে আমরা দাঁড়িয়েছি আমাদের বঞ্চনার হিসাবের লিপি নিয়ে। আপনাকে শুনতেই হবে আমাদের কথা। দয়া নয়, অধিকার চাইছি।
পরিশেষে,আপনার দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
ইতি
শত শত বছর যাবৎ বঞ্চিত এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকবৃন্দের পক্ষে
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: