সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১


ভয়েস রেফারেন্ডাম ও সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি (দ্বিতীয় পর্ব)


প্রকাশিত:
৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:১২

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:০২

টিটো সোহেল : এখন দেখা যাক ভয়েস রেফারেন্ডাম ও অস্ট্রেলিয়ান সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি বলতে আসলে কি প্রস্তাবিত হয়েছে। বর্তমান ভয়েস রেফারেন্ডাম আন্দোলনের শুরু হয়েছে ২০১৭ তে হৃদয় সঞ্চারিত উলুরু বাণী (Uluru Statement from the Heart) থেকে। সারা অস্ট্রেলিয়া থেকে ২৫০ জন প্রবীণ আদিবাসী উলুরুতে সমবেত হয়ে এই বাণীতে স্বাক্ষর করে। উলুরু বাণী বা উলুরু ছয় দফার (বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার মতো) অংশ হচ্ছে: স্বীকৃতি (Voice), সত্য (Truth) এবং চুক্তি (Treaty) যা সমন্বিত হবে মাকড়াতা (Makarata) তে |

সহজ বাংলায় ভয়েস হলো:
১ অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি
২ একটি উপদেষ্টা কমিটি যাতে ১২-২০ জন সদস্য সারা অস্ট্রেলিয়া থেকে নির্বাচিত হবে
৩ কমিটির প্রধান কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র আদিবাসী নীতিমালায় উপদেশ প্রদান করা
৪ অন্য নীতিমালায় (non-Aboriginal affairs) উপদেশ প্রদান করা এ কমিটির এক্তিয়ারের বাইরে
৫ এ কমিটির কোনো বাজেট নেই
৬ এ কমিটি কোনো কর্মসূচি হাতে নিতে পারবে না বা কোনো সেবা প্রকল্প চালাতে পারবে না
(সূত্র: ড: শিরিন মরিস, Dr Shireen Morris, Macquarie University)

এখন আলোচনা করা যাক কেন বাঙালিদের ভয়েস সমর্থন করা উচিত:
১ এদেশের অভিভাসী হিসেবে ভয়েস সমর্থন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব
২ বাঙালির সাথে আদিবাসীদের রয়েছে নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্য
৩ আমরা কৃষ্ণ বর্ণের
৪ আমাদের আধ্যাতিকতায় রয়েছে মিল: বাঙালির আদি দেবতা হচ্ছে মনসা আর আদিবাসীদের আদি দেবতা হচ্ছে রংধনু সর্প
৫ আরবদের আগে বাঙালি ধৰ্ম ছিল প্যাগান এবং খৃষ্টানদের আগে আদিবাসীদের ধৰ্ম ছিল প্যাগান
৬ ভারতীয়দের রয়েছে কৈলাশ পর্বত আর আদিবাসীদের হলো উলুরু
৭ আদিবাসীদের সাথে রয়েছে বাঙালি আদিবাসীদের যথেষ্ট মিল যেমন সাঁওতাল, গারো ও মুন্ডাদের সাথে



তবে বাঙালির সাথে আদিবাসীদের সবচেয়ে মিল রয়েছে ইতিহাসের দিক দিয়ে। আমাদের ইতিহাস হলো উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাস। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের শুরু হয় বাংলা থেকে, পলাশীর প্রান্ত হতে ১৭৫৭ সালে। কিন্তু বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ১৮০০ সাল থেকেই।ঘোষ, বোস, সেনের নেতৃত্বে গড়ে বাংলার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন।এই ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে ১০,০০০ বাঙালি তরুণ তরুণী (ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, বারীন, প্রীতিলতা)যোগ দেয় এবং আত্ম বলিদানের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসন অসম্ভব করে তোলে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পরে (১৯৪৭) পূর্ব বাংলার বাঙালিরা(বাংলাদেশ)পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রথমে ভাষা ভিত্তিক স্বাধিকার (১৯৫২) ও পরে স্বাধীনতার আন্দোলনে (মুজিব, তাজ ) অংশগ্রহণ করে।নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করে।
অস্ট্রেলিয়াতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আরো নির্মম আকার ধারণ করে।যেহেতু আদিবাসীরা এখানে একটি মানবতাবাদী, পরিবেশগতভাবে সাস্টেইনাবল এবং শান্তিবাদী সমাজে অভ্যস্ত ছিল, ব্রিটিশরা দশ বছরের মধ্যেই গণহত্যা চালিয়ে আদিবাসীদের সংখ্যা ৩% এর নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ আদিবাসীরা অদ্যাবধি ব্রিটিশ শাসন মেনে নেয় নি।সিডনির সব আদিবাসীরা (Dharug, Western Sydney) এখনো বলে যে “আমাদের সার্বভৌমত্ব এখনো অক্ষুন্ন”।



গোত্রভুক্ত ও দলবদ্ধ প্রতিবাদের সাথে সাথে গড়ে ওঠে বিপ্লবী আন্দোলন। সিডনিতে লা পেরোজ থেকে গেরিলা আন্দোলন গড়ে তোলে পেমালয় (Pemulwuy)। বোটনি বে থেকে জলধারা অনুসরণ করে গেরিলা আন্দোলন গড়ে তোলে পরমআত্মা (Parramatta) পর্যন্ত।পেমালয়, সূর্য সেনের মতো, শত শত আদিবাসী তরুণদের এই গেরিলা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে এবং দশ বছর ধরে এই বিপ্লবী গেরিলা সংগ্রাম চালিয়ে যায়।
ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের পূর্বের বাঙালির সমাজ কাঠামোর সাথে আদিবাসীদের সমাজ কাঠামোর সাথে রয়েছে ভীষণ মিল। বাংলার বাউলদের মতো আদিবাসীরা জমির মালিকানায় বিশ্বাস করে না। আদিবাসীরা মনে করে মানুষ এসেছে মাটির থেকে এবং মাটিতেই ফিরে যাবে।বাউলদের মতো এরাও ছিল যাযাবর গোছের। কোথাও বেশিদিন শিকড় এরা গাড়েনি।দেশ থেকে দেশে এরা প্রতি বছরই স্বল্প মেয়াদি আবাস গড়ে তুলতো।এর মূল কারণ ছিল প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা।এদের সমাজে ছিল না কোনো দাসপ্রথা বা জাতপ্রথা (বামুন/ নমশুদ্র, আশরাফ / আতরাফ)কারাগার, পুলিশ, মুদ্রা ও জেল জরিমানা।সমাজে ছিল সমতা, শ্রী চৈতন্যের দর্শনের মতো। নারীদের ছিল সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা।ছিল না অমানবিক সতী প্রথা। নারীদের সমাজের বোঝা মনে করা হতো না। সামাজিক সমতার কারণে ছিলোনা ভিক্ষা ব্যবস্থা বা গৃহহীনতা।



ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের কারণে আদিবাসীদের সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পরে।জমি থেকে উচ্ছেদ করে প্রায় সকল আদিবাসীদের পাঠিয়ে দেয়া হয় মিশনে। সারাদিন হাড়ভাংগা পরিশ্রম করানো হয় কোনো মজুরি ছাড়াই। আদিবাসী বাচ্চাদের সরিয়ে নেয়া হয় বাবা মার কাছ থেকে। নিয়মতান্ত্রিক শোষণের মাধ্যমে আদিবাসীদের অবস্থা এতটাই খারাপ করা হয় যে গত পঞ্চাশ বছর ধরে "বৈষম্য নির্মূল" (Closing the Gap)সামাজিক প্রকল্প চালিয়েও আদিবাসীদের অবস্থার একটুও উন্নতি করা সম্ভব হয়নি। আদিবাসীদের গড় আয়ু আমাদের চেয়ে দশ বছর কম। আদিবাসীদের ছেলেমেদের স্কুল শেষ করার হার আমাদের ছেলেমেয়েদের চেয়ে ৬০% কম। আদিবাসীদের মৃত্যুর মূল কারণ গুলো হচ্ছে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ। ৯৫% আদিবাসীরা বাস করে সরকারি আবাসনে। আর আমরা থাকছি আমাদের বিশাল বাড়িতে, চালাচ্ছি দামি গাড়ি, এক জেনারেশনে ছেলেমেয়েরা হয়ে যাচ্ছে ডাক্তার, প্রকৌশলী বা হিসাব রক্ষক। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়াতেই এই উত্তরায়ণ সম্ভব।


আমরা আসলেই আছি একটি স্বপ্নের দেশে বা সব সম্ভাবনার দেশে। একমাত্র আদিবাসীরা ছাড়া।
আগামী শনিবারে গণভোটের মাধ্যমে আমরা এদেশের আদিবাসীদের এই সমৃদ্ধির অন্তর্ভুক্ত করতে পারি: হ্যা ভোটের মাধ্যমে।
গণভোটে হ্যা ভোটের মাধ্যমে আদিবাসীদের অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানে স্বীকৃতিদান আমাদের নৈতিক কর্তব্য। এই নৈতিক কর্তব্য সকল অভিবাসীদের: আরব, আফ্রিকান, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয়। গত দুমাসে উপরোক্ত সকল কমিউনিটি হ্যা ভোটে সমর্থন দিয়েছে।
আসুন আমরা সবাই শনিবারে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপারে ইয়েস লিখে হ্যা ভোটের মাধ্যমে এদেশের আদিবাসীদের এদেশের সংবিধানে স্বীকৃতি জানাই।

 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top