সিডনী বুধবার, ১৫ই মে ২০২৪, ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি সমাচার : শ্যামল কান্তি ধর


প্রকাশিত:
১২ নভেম্বর ২০২০ ২১:২৮

আপডেট:
১৫ মে ২০২৪ ১৯:১৫

ছবিঃ হুমায়ূন আহমেদ ও বহুব্রীহি নাটকের দৃশ্য

 

১৯৮৮ -৮৯ সালের প্রতি মাসের দুই মঙ্গলবারের রাত ছিল এক বিশেষ রাত।  নয়টা  বাজার আগে অনেকেই  সব কাজ শেষ করে প্রস্তুত থাকতেন। বাড়ির কর্তা বাজার থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতেন। ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে নিত , গৃহিণীরা সংসারের সব কাজ শেষ করে রাখতেন। শহরে কিংবা গ্রামে একই চিত্র। অফিসের কেরানি থেকে শুরু করে বড়কর্তা; চেষ্টা করতেন যেভাবেই হোক রাত নয়টার আগে বাড়ি ফেরার। টিউশনি শেষে মেসে কিংবা হলে  ফেরার দেরীর আশংকা থাকলে  সেই ছাত্রটি রাত নয়টায় কোন টিউশনি রাখতনা। যাদের বাসায় টেলিভিশন নেই তারা অন্য বাড়িতে চলে যেতেন,কারন সেদিন রাত নয়টায় বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের রচনায় এবং প্রতিথযশা প্রযোজক নওয়াজীশ আলী খানের প্রযোজনায় প্রচারিত হত জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক বহুব্রীহি।  ছাব্বিশ পর্বের এই ধারাবাহিক নাটকের প্রতিটি পর্বই সমান জনপ্রিয় ছিল। সাধারণত উপন্যাস কিংবা গল্প থেকে নাটক নির্মিত হয় কিন্তু বহুব্রীহির জনপ্রিয়তার কারনে হুমায়ূন আহমেদ পরে একটি উপন্যাসও লিখেন।

হুমায়ূন আহমেদের নাটক মানেই তা হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাবে। বহুব্রীহি নাটকের মত হাসির নাটককে এখন পর্যন্ত অন্য কোন নাট্যকারের রচিত নাটক অতিক্রম করতে পারেনি এমনকি হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব অন্য কোন নাটকও পারেনি বলে আমার বিশ্বাস। বহুব্রীহি কি শুধুই হাসির নাটক ছিল? এলেবেলে নামক  একটি গ্রন্থে হুমায়ূন আহমেদ বহুব্রীহি নিয়ে একটি সরস প্রবন্ধ লিখেছেন।প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছেন “বহুব্রীহি নিয়ে আমি যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করলাম। একটি পরিবার হবে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু।  পরিবারের প্রতিটি পুরুষ আধা পাগলা ধরনের কিন্তু মেয়েগুলি সুস্থ ও স্বাভাবিক। যাত্রা দলের বিবেকের মত একটি চরিত্র থাকবে যে বিশেষ মুহুর্তে উপস্থিত হবে এবং বিবেকের দায়িত্ব পালন করবে। পরিবারের বাইরের একজন প্রেমিক বোকা ( ডাক্তার) থাকবে। এই চরিত্রটিকে ব্যালেন্স করার জন্য থাকবে একজন বোকা প্রেমিকা। পরিবারের প্রধান ব্যাক্তি একজন নিতান্তই সরল, ধর্মভীরু,  ভালো মানুষ যিনি পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যায় কাতর। সমস্যা সমাধানের তার পরিকল্পনা নিয়েই গল্প আবর্তিত হবে। মুল গল্প হাস্যরস প্রধান হলেও পাশাপাশি একটি করুণ স্রোত প্রবাহিত হবে। মাঝে নাঝে সেই স্রোত ব্যবহার করা হবে”।

পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদের পরিকল্পনার পুরোটাই বহুব্রীহিতে দেখতে পাওয়া যায়। কাহিনিতে কোন জটিলতা নেই, সহজ সরল সংলাপ হাস্যরস সৃষ্টি করেছে কিন্তু কোন অতিনাটকতা নেই। দর্শক বহুব্রীহির প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে যেন তার আশেপাশের মানুষকেই দেখতে পেলেন,আপন করে নিলেন। তাই  গুণী অভিনেতা আলী যাকেরকে দর্শকরা  অনেকদিন “মামা” হিসেবেই  চিনত। আবুল হায়াত নাকি “বাবার” চরিত্রের চেয়ে ‘মামা’র চরিত্রই পছন্দ করেছিলেন!  নাটকটিতে বহিদৃশ্যের চিত্রায়ণ তুলনামূলকভাবে কম ছিল । বিটিভির নিজস্ব স্টুডিওর সেটে তৈরি করা হয়েছিল বেড রুম, ড্রয়িংরুম,  ডাইনিং, কিচেন, বারান্দা। এই কয়েকটি কক্ষের মধ্যে আবর্তিত হত বহুব্রীহির গল্প কিন্তু কোন একঘেয়েমি আসেনি; তার প্রধান কারন অভিনেতা, অভিনেত্রীদের তুখোড় অভিনয়, বাস্তবসম্মত সেট, হুমায়ূন আহমেদের লেখা কাহিনির নিটোল  বিন্যাস, সংলাপ এবং সর্বোপরি নওয়াজীশ আলী খানের নির্দেশনা। সবকিছুর মধ্যেই আন্তরিকতা,অভিনয়  এবং মেধার এক দারুণ সমন্বয় ছিল। ভাবতে অবাক লাগে, আমরা এই বহুব্রীহির দর্শক কিভাবে এত দ্রুত  জটিল পারিবারিক প্যাঁচের বিদেশী সিরিয়ালের প্রতি এত আকৃষ্ট হলাম। এতই আকৃষ্ট হলাম যে প্রথমে বিটিভি থেকে, তারপর বাংলাদেশের  অন্য বেসরকারি চ্যানেলের নাটকগুলো থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। প্রতি সন্ধ্যার পর  এখন হয়তো এমন বাসা বাড়ি পাওয়া কষ্টকর হবে যেখানে হিন্দি কিংবা বাংলা চ্যানেলের সিরিয়াল চলছেনা। এর জন্য হয়তো শুধু আমরা দর্শক দায়ী নই। এর কারন হিসেবে অবশ্যই রয়েছে রাজনৈতিক ও বানিজ্যিকায়নের জটিল সমীকরণ। বংলাদেশের টেলিভিশন নাটক ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের এক প্রধান বিনোদন মাধ্যম।পরিবারের সবাই একসাথে বসে এইসব নাটক উপভোগ করতেন যা এক সময় বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, আগরতলার বাংলাভাষীদের কাছেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে।নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত বিটিভির নাটকে গল্প ছিল, ছিল জীবনের নির্যাস।মধ্যবিত্ত সমাজ ড্রয়িং রুমের টেলিভিশন পর্দায় খুঁজে পেত তাদেরই জীবনের প্রতিফলন। গ্রামের মানুষ খুঁজে পেত তাদেরই জীবন কথা কিন্তু এরপর রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক যে কারনেই হোকনা কেন টেলিভিশন নাটকের মানে কিছুটা ভাটা পড়ে।হতাশ হয় দর্শক।তখনই শুরু হয় প্যাকেজ নাটকের যুগ। স্বাধীন নির্মাতারা তাদের মত করে গল্প বলার সুযোগ পান।আবার নির্মিত হয় উচ্চমানের কিছু নাটক। প্যাকেজ নাটকের কল্যানে দাঁড়িয়ে যায় অনেক প্রোডাকশন হাউজ।এরপর বাড়তে থাকে আরো বেসরকারী টেলিভিশনের সংখ্যা। সাথে ভালো নাটকের সংখ্যা যেমন বাড়তে থাক, পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে অনেক নাটকের  মান। একসময় দর্শকরা ভারতীয় সিরিয়ালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো হারাতে থাকে নাটকের দর্শক।দর্শক ফেরাতে কয়েকটি টেলিভিশন  আমদানি করে বাংলায় ডাবিংকৃত বিদেশী সিরিয়াল,নাটকের স্লট বিক্রি করে দেয় বিভিন্ন এজেন্সির কাছে। সে অনেক কথা। আপাতত  আমরা ফিরে যাই বহুব্রীহিতে।

দুইঃ

বহুব্রীহির আনিস (আসাদুজ্জামান নূর) তার দুই সন্তান  নিষা ও টগরকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। চাকুরী নেই। এক সময়  অনেকে নাটকীয়তা শেষে  সোবহান সাহেবের (আবুল হায়াত) বাসায় ভাড়া থাকার ব্যাবস্থা হয় এবং সোবহান সাহেবের পরিবারের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে যায় এবং মাঝে মাঝে “বিবেকের” ভুমিকা পালন করে, সোবহান সাহেবের বিভিন্ন সমস্যার চিন্তা দূরীভুত করে। আনিস প্রচন্ড যুক্তিবাদী একজন মানুষ কিন্তু দারিদ্র‍্যের কষাঘাতে জর্জরিত। বিভিন্ন সময়ে তাকে সামাজিকভাবে হেয়, অপমানিত হতে হয়েছে। তাই মামা (আলী যাকের) যখন তার সিনেমার  চোরের চরিত্রের জন্য আনিসকে নির্বাচিত করেন এবং তার চেহারার মধ্যে একটা চোর চোর ভাব আছে বলেন তখন আনিস মুখ কালো করে বলে “নিজের সম্পর্কে জীবনে অনেক আজে বাজে কথা শুনেছি কিন্তু আমার চেহারা চোরের মত এই প্রথম শুনলাম, কোন চোর পুলিশ খেলার মধ্যে আমি নেই।” তাই আনিস মামার প্রস্তাবে রাজি হয়না কিন্তু যখন সে জানতে পারে মামার সিনেমায় যারা অভিনয় করবে তারা এক হাজার করে টাকা পাবে তখন রাজি হয়ে যায়। যদিও মামার সেই সিনেমা শেষ পর্যন্ত শেষ হয়না। মামা, কাদের (আফজাল শরীফ), মিস এষা ( লাকী ইনাম) কে নিয়ে আনিস একটি পরামর্শ কেন্দ্র খুলে। কিন্তু পরামর্শ কেন্দ্রে তেমন কেউ আসেনা। অবশ্য ডাক্তার (আফজাল হোসেন) আনিসের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তার বিয়ে এবং প্রেম সংক্রান্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পায়। এভাবে আনিস নাটকের শেষ পর্ব পর্যন্ত সোবহান সাহেবের পরিবারের একজন হিসেবেই থেকে যায়। জড়িয়ে থাকে পরিবারের বিভিন্ন ঘটনায়।

সোবহান সাহেব (আবুল হায়াত)  পরিবারের প্রধান কর্তা।  বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে তিনি কাতর। কখনো মাছ, ক্ষুধার স্বরূপ, ভালোবাসা আবার কখনো সত্য দিবস; এইসব সমস্যা সমাধানে তিনি পরামর্শক হিসেবে কাছে পান আনিসকে। তার প্রতিটি সমস্যার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা খাতা। সোবহান সাহেবের স্ত্রী (আলেয়া ফেরদৌসী)  স্বামীর এইসব কর্মকাণ্ডে কিছুটা বিরক্ত। সোবহান সাহেবের চিহ্নিত  করা সমস্যাগুলো নিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করা হলেও নাট্যকার বাস্তব কিছু সামাজিক সমস্যাকে তোলে ধরেছেন। সোবহান সাহেবের চরিত্র চিত্রনে হুমায়ুন আহমেদ একজন  সরল মনের মানুষকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন যিনি সবাইকেই সমান চোখে দেখেন, ভালোবাসায় দেখেন, তাই তিনি তার বাড়ীর গৃহকর্মে সহায়তাকারী কাদের (আফজাল শরীফ) এবং রহিমার মা (মাহমুদা খাতুন) কে পরিবারের সবার সাথে একই টেবিলে খেতে বসার সিদ্দ্বান্ত নিতে পারেন। এই দৃশ্যায়নের কারনে একজন বুদ্ধিজীবি  নাকি হুমায়ূন আহমেদের উপর খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন!! সোবহান সাহেবের হৃদয়ের বিশালতার কারনেই জেল ফেরত খুনী ডাকাত তার সাথে দেখা করার জন্য বাসায় চলে আসে। এমদাদ খোন্দকারের ( আবুল খায়ের) মত বদ লোকও তাকে “ বঠবৃক্ষ” হেসেবে অভিহিত করে। অভুক্ত মানুষের কষ্ট বোঝার জন্য তিনি নিজে উপবাস করেন। আনিসের মার্তৃহীন দুই শিশুর জন্য তার চোখে জল আসে। ভালোবাসা জনিত সমস্যার কারনে   সোবহান সাহেব একবার কাদেরের কাছে ভালোবাসার মানে জানতে চান, তখন কাদের বলে-

“ভালোবাসা একটা শরমের ব্যাপার, তয় এটা দরকার আছে”

ডাক্তার (আফজাল হোসেন) সোবহান সাহেবের সমস্যা জনিত উচ্চ রক্তচাপের কারনে এই পরিবারে  জড়িয়ে যায় । তাই মাঝে মাঝে  এই বাড়িতে তাকে বিভিন্ন অজুহাতে  আসতে দেখা যায় । কখনো সোবহান সাহেবের শরীরের খবর নিতে (কেউ না ডাকলেও), কখনো নিজের জন্মদিনের অজুহাতে। তার পেছনের কারন ছিল সোবহান সাহেবের ছোট মেয়ে মিলির (লুৎফুন নাহার লতা) প্রতি ডাক্তারের গোপন ভালোবাসা । তাই এই বাড়ীতে ঘন ঘন আসা। কিছুটা নার্ভাস টাইপ এই ডাক্তার বাড়ীতে এসে প্রতিবার কোন না কোন অঘটন ঘটিয়েছে। যেমন, বেচারা যেইনা তার হাত মিষ্টি খাওয়ার জন্য মুখের কাছে নিয়ে গেছে তখনই টুপ করে মিষ্টি  পানির গ্লাসে পড়ে গেল। তাও “ মিস মিলির” সামনে। এরকম আরো ঘটনা, যেমন রহিমার মাকে জন্মদিন উপলক্ষে সালাম করে বিব্রত হওয়া, সিনেমার শ্যুটিং এর সময় জাল সমেত  নৌকা  থেকে  পড়ে যাওয়া। সোবহান সাহেবের গল্প শোনতে শোনতে ঘুমিয়ে পড়া, মিস মিলির প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এমদাদ খোন্দকারের নাতিনের সাথে বিয়ের জালে জড়িয়ে পড়া, মামার গান শোনার টেপ রেকর্ডার ভেঙে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া। আফজাল হোসেন এই বোকা ডাক্তারের চরিত্র এমন ভাবে রূপায়ন করেছিলেন যে মেডিকেল ছাত্রদের হুমায়ূন আহমেদের  বিরূদ্ধে মিছিল বের করতে হয়েছিল। ক্ষিপ্ত ডাক্তাররা ঢাকার রাজপথে হুমায়ূন আহমেদের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন।

এতে হুমায়ূন আহমেদ দারুণ ভাবে মর্মাহত হন। তিনি লিখেন, “আমার বহুব্রীহির ডাক্তার বোকা, কিন্তু সে দরিদ্র মা’র অনুরোধে নিজের বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে থাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার,  একজন বোকা ডাক্তার দেখে ডাক্তাররা এবং হবু ডাক্তাররা আমার উপর ক্ষেপে যান। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের “ আইডেন্টিটিফাই” করতে থাকেন বহুব্রীহির ডাক্তারের সঙ্গে। অথচ ভুলে যান সোবহান সাহেবের বড় মেয়েটিও ডাক্তারী পড়ে। সে বোকা নয়। শান্ত, বুদ্ধিমতী ও হৃদয়বান একটি মেয়ে। তাঁরা সেই মেয়েটির কথা মনে না করে আফজালের কথা মনে করেন। তাঁরা তাঁদের ক্ষোভের প্রকাশ যে ভঙ্গিতে করেন তা ভাবতেও লজ্জা লাগে।

বহুব্রীহির আরেকটা প্রধান চরিত্র মামা (আলী যাকের) যে চরিত্রকে দর্শক মনে রাখবে অনেকদিন।  মামার চরিত্রের নাম ফরিদ, যিনি সিনেমা পাগল মানুষ। দুলাভাই সোবহান সাহেবের সাথে ফরিদের অম্লমধুর সম্পর্ক।  অদ্ভুত সব কর্মকান্ডের কারনে অধিকাংশ সময়ই সোবহান সাহেব  মামার উপর রেগে থাকেন। তাই সোবহান সাহেবকে কেউ মুর্খ বলেছে শুনে “মামা”র অভিব্যাক্তি হচ্ছে “পাবলিকের মুখ আপনি বন্ধ করে রাখতে পারবেননা, দুলাভাই, পাবলিক সত্যি কথা একদিন বলবেই। মামা সিনেমা পাগল মানুষ, তাই রাত জেগে কাদেরের সাথে সিনেমা দেখা তার নেশা। মাঝে মাঝে সঙ্গী হয় রহিমার মা। মামার স্বপ্ন একটা সিনেমা তৈরী করার। আমরা স্বরণ করতে পারি আশির দশকের সেইসব দিনগুলোর কথা, যখন কিছু তরুনের হাতে নির্মিত হচ্ছে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র।  সিনেমা দিয়ে সমাজ বদলের স্বপ্নচোখে তৈরী হচ্ছে অন্যরকম সব চলচ্চিত্র এবং তার বেশীরভাগেরই বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। বহুব্রীহির শেষ পর্বে আমরা দেখতে পাই মামা তার চলচ্চিত্রের প্লট খুঁজে পান এবং তা অবধারিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ।  বহুব্রীহি নাটকে মামার উপিস্থিতি মানেই হচ্ছে  আর গোমরা মুখে থাকার সুযোগ না থাকা।

নাটকটির হাস্যরসের ধারা শেষের পর্বের দিকে এসে কিছুটা সিরিয়াস বিষয়ের দিকে ধাবিত হয়। বাঙ্গালীর গৌরব মুক্তিযুদ্ধকে শেষের পর্বের দিকে গুরুত্বের সাথে তোলে ধরা হয়। সেই সময় রাজাকার শব্দটি বিটিভিতে উচ্চারণ করা যেতনা, পাকিস্তানি মিলিটারি বলা যেতনা,  বলতে হত হানাদার বাহিনী।  তাই এমদাদ খোন্দকার যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কূটক্তি করেন তখন বহুব্রীহি পরিবারের সবাই মর্মাহত হন। তাই মামা সিদ্ধান্ত নেন এমদাদ খোন্দকারকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। বাজার থেকে কিনে আনা হয় টিয়া পাখি। মামা কাদেরকে সাথে নিয়ে দিনের পর দিন টেপ রেকর্ডারে শুনাতে থাকেন “তুই রাজাকার”।  কিন্তু টিয়া  পাখির মুখে বোল ফোটেনা। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে মামা যখন নীরস মুখে বসে থাকেন, ঠিক তখনই এক টিয়া পাখি বলে উঠে “তুই রাজাকার”। অনেকদিন পর দর্শক টেলিভিশনে  ভিন্ন আঙ্গিকে রাজাকার শব্দটি শোনতে পেল। বহুব্রীহি শেষ হয় সোবহান সাহেবের গ্রামগঞ্জে ঘুরে শহীদ মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকা সংগ্রহের কাজে। তার সাথে যোগ দেন এমদাদ খোন্দকার যিনি সারাটা নাটক জুড়ে একমাত্র বদ লোকের ভুমিকা পালন করেছেন।

বহুব্রীহি নাটকে সব অভিনেতা, অভিনেত্রী তাদের সেরাটা নিংড়ে দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় “অভিনেতা অভিনেত্রীরা চমৎকার অভিনয় করলেন। বাবা, মামা, নূর, তার দুই পুত্র কন্যা, আফজাল, মিলি, আফজাল শরীফ, রহিমার মা। কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান। আলাদা ভাবে এদের কথা বলা অর্থহীন। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের প্রতিভার পূর্ন ব্যবহার করলেন”।

জটিলতার ঘোরটোপের আবর্তে নিষ্পেষিত মানুষ বহুব্রীহিতে সহজ, সরল মানুষদের দেখতে পেল। কিছু সময়ের জন্য চারিদকের জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্যই ছিল ঘরে ফেরারএই তাড়া, সরল গল্পে হারিয়ে গিয়ে কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচারও এ এক প্রচেষ্টা।  যখন আনিসের মার্তৃহীন সন্তান নিষা ও টগর মন খারাপ করে তাদের মৃত মায়ের ফেরার অপেক্ষা করে, তখন অনেকে দর্শকের চোখের কোনে জল এসেছে। তারা বিশ্বাস করে তাদের মা একদিন ফিরে আসবে।

বহুব্রীহির কয়েকটি দৃশ্যের কারনে হুমায়ূন আহমেদকে কিছু সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়। তবু হুমায়ূন আহমেদ লিখেন, “একটি বিরাট দর্শক শ্রেণীর ভালবাসাও আমি পেয়েছি। আমার সমস্ত অক্ষমতা তাঁরা দেখেছেন ক্ষমার চোখে এবং কিছুটা প্রশ্রয়েরও চোখে। এই ভালোবাসার মূল্য দেবার সাধ্য আমার নেই। যদি থাকত বড় ভালো হত।”

 

তথ্যসূত্রঃ এলেবেলে, হুমায়ূন আহমেদ, সময় প্রকাশনী, অক্টোবর ১৯৯৩।

 

শ্যামল কান্তি ধর
লেখক ও ব্যাংকার

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top