সুরের গীতাঃ স্বর্ণযুগের কিন্নর কন্ঠী : ডঃ সুবীর মণ্ডল
প্রকাশিত:
১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৩
আপডেট:
৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:২৯
বিরল সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে জন্মালেও, গীতা দত্তের জীবনটা যেন সাহিত্যের ছোট গল্প। কী হওয়ার ছিল, কী হতে পারতেন কিংবা কী হলেন? ১৯৭২সালে তাঁর অকাল মৃত্যুতে এই ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আজো। উত্তরের খোঁজে পা বাড়ালে হারিয়ে যেতে হবে গোলক ধাঁধায়। এক প্রাণবন্ত ট্র্যাজেডি হয়ে বেঁচে থাকবেন স্বর্ণযুগের বাংলা গানের ইতিহাসের পাতায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে গীতা দত্তের যেমন আকস্মিক হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না, কথা ছিল না তাঁর বহু জনপ্রিয় গান চলচ্চিত্র থেকে বাদ যাওয়ার। অসাধারণ সম্ভাবনাময় এই কিন্নর কন্ঠী শিল্পীর মাত্র ৪১ বছরের কালসীমায় শেষ হওয়ার কথা ছিল না। সীমাহীন উপেক্ষা নিয়ে তাকে চলে যেতে হয়েছিল নীরবে। সেই ইতিবৃত্ত অন্বেষণে এই নিবন্ধটির অবতারণা। গীতা দত্ত (২৩শে নভেম্বর,১৯৩০ - ২০শে জুলাই,১৯৭২) একজন বাঙালী সঙ্গীতশিল্পী। তিনি মূলত ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে হিন্দি ছবিতে নেপথ্য সঙ্গীত এবং বাংলা আধুনিক গান গাওয়ার জন্য বিখ্যাত।
গীতাদত্ত কেবলমাত্র হিন্দি গানের শিল্পী ছিলেন না, বা-এই গানের জন্যই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তা-ও নয়। তাঁর সঙ্গীতের ভাণ্ডার বহু বাংলা গানে সমৃদ্ধ ছিল। বাংলা চলচ্চিত্রের বহু গান আজো তাঁকে স্মরনীয় করে রেখেছে। এ-বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলা ছায়াছবি "হারানো সুর"-এর 'তুমি যে আমার,' 'হসপিটাল'--এর 'এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়,' বা 'পৃথিবী আমারে চায়'-- এর ' নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে,' গানগুলি তো বটেই, তাঁর কিন্নর কন্ঠ বাংলা চলচ্চিত্রকে উপহার দিয়েছে, 'ইন্দ্রানী'র 'ঝনক ঝনক কাঁকন বাজে,' 'ডাকহরকরা,'ছবির 'কাচের চুড়ির ছটায়'।'সোনার হরিণ,'--এর 'তোমার দুটি চোখ,' 'স্বরলিপি'র' আমি শুনেছি তোমারি গান,' 'প্রভু শুনেছি তোমারি গান,'। চলচ্চিত্র ছাড়াও আধুনিক বাংলা গানের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অসামান্য, এখনোও আমাদের মন-প্রাণকে তৃপ্তিতে ভরিয়ে দেয় তাঁর সুরেলা কন্ঠ নিঃসৃত--"এই মায়াবী তিথি," "ঝিরিঝিরি চৈতালী বাতাসে," "একটু চাওয়া আর একটু পাওয়া," "আকাশ জুড়ে স্বপ্নমাখা," 'হৃদয় আমার যদি কিছু বলে,' এমন অনেক গান। ধানকাটার পরিবেশ নিয়ে তাঁর অন্য ধরনের গাওয়া, 'আয় রে, আয়রে ছুটে, আয় রে সবে আয় রে আয়,' গানটি বাঙালি সঙ্গীত প্রিয় মানুষ কখনো কি ভুলতে পারে?
পরম দুঃখের বিষয় হল,এত প্রতিভা নিয়ে জন্মালেও গীতা দত্তকে নানান ধরনের চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছে। 'হারানো সুর,'--এর কাজ চলছে। রয়েছেন দিকপাল সব বর্ণময় ব্যক্তিত্ব--অজয় কর, উত্তমকুমার, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং ইউনিটের কলাকুশলীরা। হঠাৎ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উত্তমকুমার কে বললেন, "তুমি দিনক্ষণ ঠিক কর। বোম্বেতে রেকর্ডিং হবে।" প্রশ্ন করলেন, কে গাইবে? হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উত্তরে বললেন, গীতা দত্ত। উত্তরটা পছন্দ হলনা ইউনিটের অনেকেরই, তাদের বক্তব্য, সুচিত্রার লিপে কেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নয়? সঙ্গে সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উত্তরে বললেন--"ভারতবর্ষে ও গান গীতা দত্ত ছাড়া আর কেউ গাইতে পারবে না।" সেই সময় সবাই বলাবলি করতে লাগল, গীতা দত্তকে দিয়ে হবে না, তাছাড়া গানটি ভালো মানের নয়, তখন উত্তমকুমার বললেন "দেখাই যাক না। তেমন হলে রবীন্দ্রসঙ্গীত দেওয়া হবে।" তারপর বাকিটা তো ইতিহাস। সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলা ও হিন্দি দু-ঘরনার মাঝের সেতুর নাম গীতা দত্ত। কেউ কেউ মনে করেন, দু'ঘরনার গানের "হাওড়া ব্রিজ", গীতা দত্ত।
কর্মজীবন মধুর হলেও ব্যক্তিগত জীবন সুখের হয় নি গীতা দত্তের। ১৯৫০ সালে গুরু দত্তের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গুরুদত্ত ছিলেন একাধারে পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা। এই চার ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন সফল। তিন বছরের বর্ণময় দাম দাম্পত্য জীবন কাটাবার পর ১৯৬৮ সালে গুরুদত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় ওয়াহিদা রেহমানের। ওয়াহিদা তখন তেলুগু ছবিতে অভিনয় করে কিছুটা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এক ফিল্ম পার্টিতে দু'জনের আলাপ হয়। পরবর্তীকালে সুন্দরী ও পরিশীলিত ওয়াহিদা রেহমানের প্রতি আকৃষ্ট হন গুরুদত্ত। তিনি তাকে মুম্বাই নিয়ে আসেন। 'সি, আই, ডি' ছবিতে খলচরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দেন। এরপর 'পিয়াসা'তে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বলিউডে গুরুদত্তের খুব ঘনিষ্ট হন। 'চৌধভিন কা চান্দ' ছবিতে ওয়াহিদা রেহমানের বিপরীতে অসামান্য অভিনয় করেন গুরুদত্ত। তাদের পর্দা-রসায়ন যেমন অনবদ্য ছিল, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁরা ছিলেন পরস্পরের সেরা ও কাছের বন্ধু। স্নিগ্ধ ও ধীরস্থির স্বভাবের ওয়াহিদা রেহমানের প্রেমে পড়ে যান ছটফটে ও আবেগপ্রবণ গুরুদত্ত। এই প্রেমের ফলে প্রথম দিকে তাদের ক্যারিয়ারেও সাফল্য যোগ হয়। ধীরে ধীরে দুজনের অভিনয়ে পরিপক্কতা আসে। কিন্তু এই ধরনের প্রেম গুরুদত্তের সাজানো গোছানো সুন্দর দাম্পত্য জীবনে কালবৈশাখীর ঝড় তোলে। সম্পর্ক বিষময় হয়। এই সময় গীতা দত্ত গুরুদত্তকে ত্যাগ করেন, আলাদা থাকতে শুরু করেন। যদিও তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে নি কিন্তু তারা দুজনে পৃথকভাবে বসবাস করতে শুরু করেন যা গুরুদত্তের মানসিক টানাপোড়েন আরও বাড়িয়ে দেয়। কারণ তিনি যেমন ওয়াহিদাকে ভালোবাসতেন তেমনি নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসতেন গভীর ভাবে। কিন্তু এই ধরনের দু নৌকায় চলা মানুষকে গীতা দত্ত মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। এই সম্পর্কে তিনি কোন মতেই মান্যতা দিতে অস্বীকার করেন। গীতা দত্ত মানসিক টানাপোড়েনে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়েন। যে সম্পর্কের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও বৈধতা নেই, তাকে বহন করে এগিয়ে চলতে চাননি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন গীতা দত্ত। নীরবে সরে দাঁড়ালেন। গুরুদত্তের দৌলতে একটার পর একটা সাফল্য পেতে লাগলো ওয়াহিদা রেহমান। সেই সময়ে গীতা দত্তকে তিনি আর পাত্তা দিতেন না। শুধু তাই নয়, গীতা দত্তের গান ছবি থেকে বাদ দেওয়ার চক্রান্তে যুক্ত হন। সুযোগ সন্ধানী ছিলেন ওয়াহিদা রেহমান। নিজের ক্যারিয়ার তার কাছে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তখন দেবানন্দ, সিনেমা জগতে অনেক নাম করেছেন, তাই ওয়াহিদা রেহমান ঝুঁকলেন দেবানন্দের দিকে। গুরুদত্ত নিজের ভুল যখন বুঝতে পারলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১৯৬৪সালের ১০ অক্টোবর মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে পান করেন। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ ও আ্যলকোহলের বিষক্রিয়ায় মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এই অসাধারণ জনপ্রিয় শিল্পী মানুষটির জীবনে নেমে আসে মৃত্যুর করলগ্রাস। গুরুদত্তের আকস্মিক মৃত্যুতে গীতা দত্তের জীবনে সাংঘাতিক মানসিক বিপর্যয় নেমে আসে, সেই সঙ্গে চরম দুর্দিনে আর্থিক সংকট নেমে আসে। এই সময় তিনি আবার সঙ্গীতের নতুন অধ্যায় শুরু করার কথা ভাবতে থাকেন। কিছু স্টেজশো এবং পূজার গান গেয়ে বাঁচার জন্য একটা চেষ্টা শুরু করলেন। এই সময় কিছু ভালো গান উপহার দিয়েছিলেন। 'বধুবরণ' ছবিতে মুখ্যভূমিকা ছিল তাঁর। 'অনুভব' ছবিতে তাঁর সঙ্গীত দর্শকদের মুগ্ধ করে। এটি তাঁর সঙ্গীত জীবনের শেষ কাজ। ১৯৭২ সালে, ২০জুলাই সিরসিস অফ লিবারে তাঁর জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হয়। তিনি চির দু্ঃখ নিয়ে চলে গেলেন অকালে, মাত্র ৪১ বছর বয়সে। ভারতের অসংখ্য সঙ্গী প্রিয় দর্শক বঞ্চিত হলো তাঁর ঈশ্বর প্রদত্ত সুরেলা কন্ঠ মাধুর্য থেকে চিরতরে। অনেক খানি খ্যাতি লাভ করলেও জীবনে কখনো সুখী হতে পারেন নি। এটাই ট্র্যাজেডি।
গীতা দত্ত একটি ধনী জমিদার পরিবারে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে (বর্তমানে শরিয়তপুর জেলা) জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের নিদারুণ পরিহাস, খোয়াগেল জমিদারিভূষণ। সব তছনছ করে দিয়ে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জাপানি বোমার ভয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে আসতে হলো অপরিচিত কোলকাতায়। আর্থিক অবস্থা এমন হল যে, গীতা দত্তকে অল্প বয়সে (১২-১৩বছর) গানের টিউশনি করে জীবন শুরু করতে হল। বাসের পয়সা বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন, যে বাড়িতে গান শেখাতেন, গরীব বলে মাটিতে বসতে বলা হতো তাকে, এই জীবনই তাঁকে মহাসঙ্গীত শিখিয়েছিল। পরিচালক, অভিনেতা গুরু দত্তের সাথে বিয়ের আগে তাঁর নাম ছিল গীতা ঘোষ রায়চৌধুরী। বিয়ের আগে গীতা রায় নামে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দে তাঁর বাবা মার সাথে বোম্বের দাদারে একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে আরম্ভ করেন।
গীতা যখন বারো বছর বয়সী ছিলেন তখন সুরকার হনুমান প্রসাদ একবার গীতার গান শুনে মুগ্ধ হন । তিনি ১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দে গীতাকে ভক্ত প্রহ্লাদ নামের একটি চলচ্চিত্রে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ দেন। এই ছবিতে গীতা কোরাসে মাত্র দুই লাইন গান গেয়েছিলেন কিন্তু তার মধ্যেই তাঁর কৃতিত্ব ফুটে উঠেছিল। পরের বছরে গীতা নেপথ্য গায়িকা হিসাবে দো ভাই ছবিতে কাজ পান এবং এই ছবিতে তাঁর গান হিন্দি ছবির জগতে গায়িকা হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রথম দিকে গীতা ভজন এবং দুঃখের গান গাওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন। ১৯৫১ সালে শচীন দেববর্মণের সুরে বাজি চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া গান তাঁর সঙ্গীতজীবনে নতুন দিক আনে। তাঁর কণ্ঠস্বরের যৌনতা এবং পাশ্চাত্য সুরে সহজে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার জন্য ১৯৫০ এর দশকে লাস্যময়ী এবং ডান্স ক্লাবের গানে তাঁকে প্রথম পছন্দ করে তোলে। শচীন দেববর্মন দো ভাই ছবিতে গীতার কণ্ঠের জাদু প্রথম ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি গীতার কণ্ঠের বাঙালী টানকে সুন্দর ভাবে ব্যবহার করেছিলেন দেবদাস (১৯৫৫) এবং পেয়াসা (১৯৫৭) ছবিতে। পেয়াসা ছবিতে আজ সাজন মুঝে অঙ্গ লাগা লে বাঙালী কীর্তন গানকে গীতা সফল ভাবে হিন্দিতে গেয়েছিলেন। শচীনদেব বর্মনের সুরকার হিসাবে শুরুর দিকের গানগুলিকে গায়িকাদের ভিতরে গীতাই সবথেকে ভালভাবে গেয়েছিলেন। ও পি নাইয়ারের সুরে গীতা সব ধরনের গানেই পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। তিনি এবং লতা মঙ্গেশকর ১৯৫০এর দশকে দুই প্রধান নেপথ্যসঙ্গীত গায়িকা ছিলেন। হিন্দি গান ছাড়াও গীতা দত্ত গুজরাটি ছবিতেও প্রধান নেপথ্য গায়িকা ছিলেন। তিনি গুজরাটি ভাষায় বিখ্যাত সুরকার অবিনাশ ব্যাসের সুরে বেশ কিছু গান গেয়েছিলেন। ১৯৫০ দশকের শেষ এবং ১৯৬০এর দশকের শুরুতে গীতা বেশ কিছু বিখ্যাত বাংলা গান গেয়েছিলেন। এই সময়ে বাংলা ছবি এবং সঙ্গীতের জগতে স্বর্ণযুগ চলছিল। তাঁর বেশিরভাগ বাংলা গানেরই সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবে তিনি নচিকেতা ঘোষ এবং সুধীন দাশগুপ্তের সুরেও কিছু গান গেয়েছিলেন। সেরা নেপথ্য গায়িকার রাজদণ্ডটা লতা মঙ্গেশকরেরও আগে এসেছিল গীতা দত্তের হাতে। এ-এক বড় প্রাপ্তি।
সেই সময় তিনিই ছিলেন তামাম ভারতের মহিলা- সিংগিং'-সুপার স্টার, লুকিয়ে চুরিয়ে আজো বলা হয় লতা কন্ঠী, আরতি কন্ঠী, সন্ধ্যা কন্ঠী। কিন্তু গীতাকন্ঠী হওয়া যায় না। তাঁর কারণ, তিনি অনুকরনীয়, তার স্বরযন্ত্রটা আসলে ঈশ্বরের নিজের তৈরি মোহনবাঁশি। স্বাধীনতার বছরেই, 'দো ভাই' চলচ্চিত্রই গীতা দত্তকে রাতারাতি সেরা তিন গায়িকার সরণিতে এনে দেয়। রোমান্টিক গানের তাঁর কচি গলাটি পেতে বাড়ির সামনে লাইন লাগালেন ছবি নির্মাতারাই। গীতা দত্তের তীক্ষ্ম বাঙালি কানকে কাজে লাগিয়ে তাঁর লোকসঙ্গীতের ধার বাড়ালেন শচীন কর্তার। পঞ্চাশ-ষাট দশক জুড়ে একা রাজত্ব কায়েম করে ছিলেন গীতা দত্ত। অসাধারণ জীবনবোধ, সেই সঙ্গে বিদ্যুতের গতিতে গান তুলতে পারার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা।" এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু" এই গানটি উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে আজো মাদকতা ছড়িয়ে দেয়। এক চির সবুজ সঙ্গীত। কখনো পুরাতন হয় না। এই হল গীতা দত্ত।
কিছু চিরদিন মনে রাখার মত গান:
শচীন দেব বর্মণের সুরে তাঁর কয়েকটি গান:
মেরা সুন্দর সপনা বীত গয়া (দো ভাই- ১৯৪৭)
ও সপনেবালি রাত (পেয়ার- ১৯৫০)
তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির (বাজি- ১৯৫১)
আন মিলো আন মিলো (দেবদাস- ১৯৫৫) মান্না দের সাথে
আজ সাজন মুঝে অঙ্গ লাগালো (পেয়াসা- ১৯৫৭)
হাওয়া ধীরে আনা (সুজাতা- ১৯৫৯)
বক্ত নে কিয়া কেয়া হাসিন সিতম (কাগজ কে ফুল- ১৯৫৯)
ও পি নাইয়ারের সুরে তাঁর কয়েকটি গান :
জারা সামনে আ (বাজ - ১৯৫৩)
বাবুজি ধীরে চলনা (আর পার - ১৯৫৪)
থান্ডি হাওয়া কালি ঘটা (মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ - ১৯৫৫)
জব বাদল লেহরায়া (ছুমন্তর - ১৯৫৬)
মেরে জিন্দেগী কে হামসফর (শ্রীমতি চারশোবিশ - ১৯৫৬)
চোর লুটেরে ডাকু (উস্তাদ - ১৯৫৭)
মেরা নাম চিন চিন চু (হাওড়া ব্রিজ - ১৯৫৮)
ক্যায়সা জাদু বালাম তুনে দারা (টুয়েলভ ও ক্লক - ১৯৫৮)
কিছু মনে রাখার মত বাংলা গান:
তুমি যে আমার (হারানো সুর, ১৯৫৮ সঙ্গীত: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)
এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায় (হসপিটাল, ১৯৬০ সঙ্গীত: অমল মুখার্জী)
নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে (পৃথিবী আমারে চায়, ১৯৫৭)
ওগো সুন্দর জানো নাকি (ইণ্দ্রাণী, ১৯৫৮)
এই মায়াবী তিথি (সোনার হরিণ, ১৯৫৯)
আমি শুনেছি তোমারি গান ।
মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও গীতা দত্তের গান সমানভাবেই সমাদৃত ও প্রাসঙ্গিক। গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা -যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, সময় পাল্টেছে, রুচির পরিবর্তন ঘটেছে এবং সেই সঙ্গে দর্শকদের মানসিকতা পালটে থাকলেও গীতা দত্তের গান এখনও ঝড় তোলে হৃদয়ের মধ্যে। সময়ের মালিন্যে কোন দিন গ্রাস করতে পারবে না তাঁর কালজয়ী গানের কলি। এক রোমান্টিক জগতে নিয়ে যায় তার সুরেলা কিন্নর কন্ঠী। আমাদের শৈশব কেটেছে গীতা দত্তের গান শুনে।আজো নতুন প্রজন্মের তরুন-তরুণীদের কাছে তাঁর গান মাদকতা সৃষ্টি করে। দেশ-কালের সীমারেখা মুছে দিয়ে তিনি অমর হয়ে থাকবেন চিরদিন আমাদের হৃদয়ের মানচিত্রে। দুই বাংলার বাঙালির প্রাণের সমস্ত উৎসব জুড়ে অন্যদের সঙ্গে গীতা দত্তের গান সমানভাবেই সমাদৃত। আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র গীতা দত্ত, শুধু এ- প্রজন্মেরও অনেক শিল্পীর অনপ্রেরণা ও প্রেরণাভূমি তিনি। স্বর্ণযুগের এই কালজয়ী এই কন্ঠ শিল্পী সবছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। দৈহিক ভাবে তাঁর মৃত্যু হলেও আত্মিক ভাবে তিনি বেঁচে থাকবেন উপমহাদেশের সঙ্গীত প্রেমিক মানুষের হৃদয়ে চিরদিন। 'এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু' এই কালজয়ী গান কোন দিন ভুলতে পারবেনা সমস্ত বাঙালি। এক নস্টালজিয়া আজো আচ্ছন্ন করে রাখে। আজো লতা মঙ্গেশকর মিস করেন তাঁকে। শচীন কর্তার নিজেই গেয়েছিলেন শুধু ফরিদপুরের গীতার জন্য সরিয়ে রাখা সেই পল্লিগীতি, যে গান আজো যেন গীতা দত্তের জন্যই বিলাপ করে। "বাঁশি শুনে আর কাজ নাই/ সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি"। গীতা দত্তকে দুই বাংলার সঙ্গীত প্রিয়মানুষ কোন দিন ভুলতে পারবেনা। উপেক্ষার অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, অভিমানী চির দু্ঃখী সঙ্গীতশিল্পী গীতা দত্তের।
তথ্যসূত্রঃ (১) আনন্দ বাজার পত্রিকার আর্কাইভস, (২) এই সময় ব্লগ "তুমি রেহেনা তুমি।"
মহানগর, (৪) "এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু"
ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প, ছোটগল্প, রম্যরচনা, চিত্রনাট্য ও ভ্রমণকাহিনীর লেখক
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
বিষয়: ডঃ সুবীর মণ্ডল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: