নিউজিল্যান্ডের জাতীয় দিবস ও ঐতিহাসিক ওয়াইটাঙ্গি ট্রিটি
প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৪৩
আপডেট:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৫২
৬ই ফেব্রুয়ারি, নিউজিল্যান্ডের জাতীয় দিবস। ১৮৪০ সালের এই দিনে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হবসন নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরিদের সঙ্গে একটি সমঝোতা ছুটি স্বাক্ষর করেন। নিউজিল্যান্ডে সেই চুক্তি ঐতিহাসিক “ওয়াইটাঙ্গি ট্রিটি” বা “ওয়াইটাঙ্গি চুক্তি” নামে পরিচিত। ঐ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড বিশ্ব মানচিত্রে ব্রিটিশ কলোনি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। আর চুক্তি স্বাক্ষরের দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করে কিউইরা।
মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের আদি অধিবাসী কিংবা আদিবাসী। ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতকে এরা পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে নিউজিল্যান্ডে এসেছিলো বলে জানা যায়। মাওরি ভাষায় ‘মাওরি’ শব্দের অর্থ ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘সাদাসিধে’। বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশরা সারাবিশ্বে, এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও যুদ্ধ, নির্যাতন এবং দখলদারি করে রাজত্ব কায়েম করতে পারলেও, একমাত্র নিউজিল্যান্ডে ওরা মাওরি আদিবাসীদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে দেশটার রাজ্যভার গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। আর সেই সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪০ সালে।
নিউজিল্যান্ড ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন তবে শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। এটি অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে তাসমান সাগরে অবস্থিত। আর যার নামানুসারে তাসমান সাগর সেই ওলন্দাজ নাবিক আবেল তাসমান ১৬৪২ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়া ও পরে নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়। বলা হয়ে থাকে নিউজিল্যান্ড অঞ্চলে এটিই ছিল কোনো ইউরোপীয় অধিবাসীর প্রথম পা রাখা। নাবিক আবেল তাসমান যখন নিউজিল্যান্ডে পৌঁছেন তখনো নিউজিল্যান্ডে বসবাস করতো মাওরিরা।
১৬৪২ সালে আবেল তাসমানের জাহাজে থাকা নাবিকদের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরিদের যুদ্ধ হয়েছিলো। মাওরিদের একটি দল দূর থেকে আবেল তাসমানের জাহাজ দেখে আক্রমণকারী হিসেবে সন্দেহ করেছিল। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ‘ওয়াকা’ নামের নৌকায় যুদ্ধের সাজে এসে তারা একেবারে সশস্ত্র হয়ে আবেল তাসমানের জাহাজে হামলা করে। তাসমানের সঙ্গীরা এই আকস্মিক আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ঐ আক্রমণে আদিবাসীদের ভারি গদার আঘাতে আবেল তাসমানের চারজন সঙ্গী নিহত হয়।
আরো বিপদের আশংকায় আবেল তাসমান নিউজিল্যান্ডের যে এলাকায় পৌঁছেছিলেন সেখান থেকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে সরে যেতে চাইলেন। সেসময় তিনি মাওরিদের আরও প্রায় ১২টি ‘ওয়াকা’ নৌকা দেখতে পান। তার মধ্যে একটি নৌকা অন্যগুলোর চেয়ে সামনে এগিয়ে ছিল। পরে তিনি তার জাহাজ থেকে ক্যানিস্টার কামান নিক্ষেপ করেন। গোলার আঘাতে মাওরি নৌকাটির সামনের অংশ ডুবে যায়। এই দুর্ঘটনা ও হতাহতের জন্য আবেল তাসমান উপসাগরটির নাম দিয়েছিলেন ‘মার্ডারারস বে’ বা ‘খুনিদের উপসাগর!’
আবেল তাসমানের অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের পর সেখানে ব্রিটিশরা প্রথম স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন শুরু করে ১৭৮৮ সালে। কিন্তু ব্রিটিশরা নিউজিল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এরও প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, ১৮৩৮ সালে। এর আগে নিউজিল্যান্ডে বসবাসের সাহস পায়নি ব্রিটিশরা। কখনও মিশনারি হয়ে, কখনও ব্যবসায়ী হয়ে ব্রিটিশরা নিউজিল্যান্ডে শুধু আসা যাওয়ার মধ্যে ছিল।
১৮৩৮ সালে এক জাহাজে করে এসে প্রায় তিনশো ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান নিউজিল্যান্ডের বে-অব-আইল্যান্ডে প্রথম বসতি স্থাপন করে বলে জানা যায়। প্রথম দিকে ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ানদের সাথে আদিবাসী মাওরিদের তেমন কোনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আদিবাসী মাওরিরা দেখতে পেলো, জাহাজের পর জাহাজে করে এসে ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান বসতি দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং নামমাত্র টিপসই নিয়ে তাঁদের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে, তখন মাওরিদের টনক নড়ে।
১৮৩৯ সালের প্রথম দিকেই মাওরি আদিবাসী এবং ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ানদের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দ্বন্দ্ব থেকে বিরোধ এবং বিরোধ থেকে ছোটখাটো যুদ্ধ বাধতে শুরু করে। বছর শেষে সেই যুদ্ধ প্রকট আকার ধারণ করে। পরে ১৮৪০ সালের ২৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার এবং রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধি হয়ে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হবসন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে নিউজিল্যান্ডে উদ্ভুত পরিস্থিতির সমাধান খুঁজতে আসেন।
ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হবসন ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান। তিনি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে পা দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন, মাওরি সর্দারদের সাথে কোনো চুক্তি না করলে ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ানরা কোনোভাবেই নিউজিল্যান্ডে বসবাস করতে পারবে না। তাই তিনি মাত্র ৯ দিনের প্রচেষ্টায় অসম্ভব পরিশ্রম করে, নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে সৈন্যসামন্ত ও উপঢৌকন পাঠিয়ে এবং নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে পঞ্চাশজন মাওরি সর্দারকে কোনোমতে রাজি করান চুক্তি করতে।
১৮৪০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি সকালে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হবসন প্রায় পাঁচশো মাউরি যোদ্ধার উপস্থিতিতে পঞ্চাশজন সর্দারের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের বে-অব-আইল্যান্ডের ওয়াইটাঙ্গি হাউজে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সেই ঐতিহাসিক চুক্তির নাম “ওয়াইটাঙ্গি ট্রিটি” বা “ওয়াইটাঙ্গি চুক্তি”।
ওয়াইটাঙ্গি ট্রিট্রি-র মূল বিষয়বস্তু ছিলো, নিউজিল্যান্ডে বসবাসকারী ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান এবং আদিবাসী মাওরিদের মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা - এই পাঁচটা মূলনীতি সমভাবে থাকবে। দেশের মাটিতে সামাজিক অবস্থান এবং অধিকারও সমান হবে দুই পক্ষের। কারো কোনো আলাদা জাতিসত্তা থাকবে না অর্থাৎ মাওরিরাও ব্রিটিশ নাগরিকদের সমান মর্যাদা পাবে। এদেশের ভূমি, বন, নদী এবং সমুদ্রসীমা রাণী ভিক্টোরিয়া এবং ব্রিটিশ সরকারের অধীনে থাকবে।
ওয়াইটাঙ্গি ট্রিট্রি’র পরপরই নিউজিল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে রাণী ভিক্টোরিয়া এবং ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে যায়। আর ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হবসন নিউজিল্যান্ডের প্রথম গবর্নর নিযুক্ত হন। প্রথমদিকে অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের নিউ সাউথ ওয়েলসের অংশ হিসেবে নিউজিল্যান্ড পরিগণিত হতো। পরে ১৮৪১ সালে এক বিশেষ আইনবলে অস্ট্রেলিয়া থেকে আলাদা হয়ে ভিন্ন উপনিবেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিউজিল্যান্ড।
১৯৭৪ সালে ওয়াইটাঙ্গি ট্রিট্রি সবার বোধগম্য করে লেখার জন্য ও মাওরিদের স্বার্থ যাতে পুরোপুরি নিশ্চিত হয় সে লক্ষে নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্ট একটি কমিশন গঠন করে। সেই কমিশন ১৮৪০ সালের যে দিনটাতে ট্রিট্রিটা লেখা হয়েছিল, সেই দিনটাকে অর্থাৎ ৬ই ফেব্রুয়ারিকে নিউজিল্যান্ডের জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আর ১৯৭৪ সাল থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি নিউজিল্যান্ডের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে এবং সেদিন সরকারি ছুটি।
লেখা শেষ করবো নিউজিল্যান্ডে সরকারি ছুটি উদযাপনের রীতির কথা বলে। ২০২১ এর ৬ ফেব্রুয়ারি নিউজিল্যান্ডের জাতীয় দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি। দিনটি শনিবার আর নিউজিল্যান্ডে সাপ্তাহিক ছুটি থাকে শনি ও রবিবার। ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি যেহেতু শনিবার পড়েছে সেজন্য আগামী সোমবার ছুটি ভোগ করবে কিউইরা। অর্থাৎ সরকারি ছুটি অন্য কোনো বন্ধের দিনে পড়লেও সেটি থাকবে এবং সেক্ষেত্রে ছুটি একদিন বেড়ে যাবে।
মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক
বিষয়: মু: মাহবুবুর রহমান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: