সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনার উদ্যোগ নেই! : সালেক খোকন


প্রকাশিত:
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫০

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৬:৪৩

 

একাত্তরের একটি বিস্মৃত অপারেশনের কথা তুলে ধরেই শুরু করছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার সুবাদে একবার ঢাকার গেরিলা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টুর মুখোমুখি হই। তার মুখে শোনা অপারেশনটি এমন:

তখন ঢাকায় যাওয়া খুব কঠিন ছিল। পথে পথে ছিল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের চেকিং। ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই! তবুও আমরা ঢাকামুখী হলাম। সঙ্গে ছিল এক্সপ্লোসিভ ও গোলাবারুদ। পঁচিশ কেজি করে ভার বহন করতে হয়েছে প্রত্যেককেই। কোথাও পায়ে হেঁটে, কোথাও রিকশায়, কোথাও-বা নৌকায় এগোই। নরসিংদী আসতেই বাধা পড়ে। ওখানে একটা গ্রাম জ¦ালিয়ে দিয়েছে আর্মিরা। টহলও চলছে চারদিকে। সর্তক হয়ে একটা বাড়িতে তখন লুকিয়ে থাকি। নাওয়া-খাওয়া ছাড়াই কাটে আট দিন। মৃত্যুভয়ে কাটত প্রতিটা মুহূর্ত। তবুও সেই ভয়কেই তুচ্ছ ভেবে এগিয়ে যেতে হয় আমাদের। আমরা হাইড-আউট ক্যাম্পটি করি ঢাকার কাছে, ডেমরায়। গ্রামের নাম আমুলিয়া মেহেন্দিপুর। জামদানি শাড়ি বানাতো গোটা গ্রামের মানুষ। যথেষ্ট সাহায্য করেছিল তারা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ওই গ্রামের মানুষরা আশ্রয় দিয়েছিল আমাদের।

ক্যাম্পে আমরা চল্লিশ জন। কমান্ডে সাদেক হোসেন খোকা (প্রয়াত মেয়র)। ‘খোকা’ গ্রুপের গেরিলা হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন অফিস তখন ছিল মোমিনবাগে, রাজারবাগের উল্টা পাশে। দুটো ভাড়াবাড়িতে চলত তাদের কাজ। দেশে তখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচিত এমপিএ আর এমএনএ সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে চলে গেছেন মুক্তাঞ্চল ও ভারতে। এ সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ফন্দি আঁটে। নির্বাচিত ওইসব এমএনএ ও এমপিএ-দের পদ শূন্য ঘোষণা করে আসনগুলোতে উপনির্বাচনের গোপন প্রস্তুতি নিতে থাকে তারা। এ খবর পেয়েই সিদ্ধান্ত নিই প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন অফিসটি উড়িয়ে দেওয়ার। এতে বিশ্ব-গণমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়বে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের খবর। ফলে চাপের মুখে পড়বে পাকিস্তান সরকার। খোকা ভাইয়ের নেতৃত্বে ওই অপারেশনে অংশ নিই আমি, লস্কর, সুফি আর হেদায়েত। জায়গাটা রেকি করে আসি একদিন আগেই। ১ নভেম্বর ১৯৭১। রোজার মাস ছিল। ঢাকায় যখন ঢুকি রাত তখন ৮টার মতো। তারাবির নামাজ চলছে। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। ওই সময়েই বিল্ডিংয়ে ঢুকে ১২ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ ফিট করি আমরা। অতঃপর বেরিয়ে এসেই বিস্ফোরণ ঘটাই। গোটা ঢাকা শহর তখন কেঁপে ওঠে। বিল্ডিংয়ের এক পাশ ধসে পড়ে। আগুনে পুড়ে ছাই হয় ইলেকশন কমিশন অফিসের সব কাগজপত্র। ওখানে থাকা এক দারোয়ানও মারা যায়।

কিন্তু অপারেশন শেষ করতে বেজে যায় রাত ১২টা। পাকিস্তানি আর্মি তখন ঢাকার রাস্তায় টহলে নেমেছে। ক্যাম্পে ফেরার কোনো উপায় নেই। গলির পথ দিয়ে মালিবাগের এক মেসে গিয়ে আশ্রয় নিই আমরা। মেসটির ওপরে টিন। চারপাশে বেড়া। কর্মজীবী কিছু লোক থাকত সেখানে। ঢুকেই বলি ‘একটু আগে বিস্ফোরণের যে আওয়াজ হয়েছে সেটা আমরাই করেছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধা।’ কথা শুনে আর অস্ত্র দেখে থরথর করে কাঁপছিল তারা। প্রথম কোনো মুক্তিযোদ্ধা দেখেছে তারা। তবু রাতে আমাদের থাকার কথা শুনেও ভয় পেল না; বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আমাদের সাহায্য করল। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়াটাও তখন ছিল আরেক যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনারা টের পেলেই সবাইকে হত্যা করত। মেসের পাশেই ছিল পিডিবির একটি অফিস। সেটা পাহারা দিচ্ছে পাকিস্তানি আর্মিরা। ফলে ওই মেসে থাকাটা ছিল প্রচ- রিস্কের। ওই রাতে মেসের লোকেরা তাদের জন্য রান্না করা খাবার আমাদের খাওয়ায়। তাদের বিছানাতেই থাকতে দেয়। আমাদের বাঁচাতে রাতভর পালা করে বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারাও দিয়েছিল তারা। অতঃপর খুব ভোরে সেখান থেকে আমরা ফিরে যাই ক্যাম্পে। ওই রাতে তাদের সাহায্য না পেলে হয়তো ধরা পড়তে হতো। তাই মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের অবদানের ইতিহাসও তুলে আনা প্রয়োজন।’ নভেম্বরে একাত্তরের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি কোনো গণমাধ্যমে।

স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরেও আমরা কি পেরেছি সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস এবং একাত্তরে নানাভাবে সাহায্য করেছেন যারা, তাদের ইতিহাস তুলে আনতে। উত্তরটি অবশ্য না। বরং একাত্তরের যোদ্ধাদের অধিকাংশের বয়স এখন ষাটের ঊর্ধ্বে। অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু ঘটছে একেকটি ইতিহাসের। অথচ মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বরং বাঙালি বীর। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই মুক্তিযুদ্ধের একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। যা অনাদিকাল পর্যন্ত প্রজন্মকে আলোড়িত করবে। সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস তুলে আনা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সরকারিভাবে সেটি করা সম্ভব হয়নি এখনো। কার্যকর কোনো উদ্যোগের খবরও আমাদের জানা নেই। তাহলে কী নিয়ে আমরা উদযাপন করতে যাচ্ছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী!

তবে আশার খবরও আছে। গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা করে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সরকারি উদ্যোগ এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রস্তাবটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে তোলা হলে এখন সেটি যাবে মন্ত্রিসভায়।

২০০১ সাল। বিএনপি-জামায়াত জোট তখন ক্ষমতায়। তারা এসেই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের মন্ত্রী বানায়। তাদের গাড়িতে ওড়ে স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা। এতে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয় মুক্তিযোদ্ধারাসহ গোটা দেশ। সে সময় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি বাস্তবায়ন ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটি’। ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক সমাবেশ থেকে তারা ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানায়। যাদের ত্যাগ, রক্ত ও সংগ্রামের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম, তাদের বিশেষভাবে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতেই একটি দিবস থাকা দরকার বলে মনে করেন তারা। বিষয়টিতে সরকার আন্তরিক থাকলে এবারের ১ ডিসেম্বরকেই মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে পালন করা সম্ভব বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্টজনেরা।

মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালনের পাশাপাশি তৃণমূলের মুক্তিযোদ্ধা ও গণহত্যার ইতিহাস তুলে আনায় সরকারের এখনই বিশেষ উদ্যোগ হাতে নেওয়া প্রয়োজন। এ কাজে নিজ নিজ জায়গা থেকেই উদ্যোগী হতে পারে তরুণ প্রজন্মও। এগিয়ে আসতে পারে বেসরকারি সংস্থাগুলো।

আবার মিডিয়াতে বা গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে আমরা পাই আর সব দিবসের মতোই একটি ইভেন্ট হিসেবে, বছরে মাত্র দুই মাস। এ থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।

ইতিহাস তুলে আনার পাশাপাশি এ কাজগুলো করা গেলে মানুষের ভাবনার মাঝে যুক্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংগ্রামের ও আমাদের বীরত্বের কাহিনীগুলো। যা জেনে পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে।

ছবি: আনোয়ার হোসেন

 

সালেক খোকন
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top