সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


পৃথিবীর প্রথম করোনার টিকা ‘স্পুটনিক ভি’- কৃত্রিম উপগ্রহের মতো এবারও কি চমক দেখালো রাশিয়া : মু: মাহবুবুর রহমান


প্রকাশিত:
১৩ আগস্ট ২০২০ ২০:৪৭

আপডেট:
১৪ আগস্ট ২০২০ ০৫:৪০

 

পৃথিবীর প্রথম স‍্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ আবিষ্কার করে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল তেমনি করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও রাশিয়া সবাইকে টেক্কা দিয়ে বিজয়ী হবার ঘোষণা দিয়েছে। নতুন এ করোনা টিকার নামও রাখা হয়েছে স্পুটনিকের নামানুসারে "স্পুটনিক ভি"। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ১১ই আগস্ট জানিয়েছেন, করোনার টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে রুশ বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধিকাংশ ধাপ অতিক্রম করেছেন। তারা প্রমাণ করেছেন নতুন এ করোনা টিকা নিরাপদ ও কার্যকরী। 

রাশিয়ায় মন্ত্রীদের সঙ্গে ভিডিও সম্মেলনে পুতিন নতুন এ করোনা টিকার তথ্য জানান। ওই ভিডিও সম্মেলন টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। ভিডিও সম্মেলনে পুতিন বলেন, ‘আজকের (১১ ই আগস্ট) সকালে বিশ্বে প্রথম নতুন করোনাভাইরাসের জন্য প্রথম টিকা নিবন্ধন করা হলো।’ 

পুতিন আরো জানান, করোনার নতুন টিকার প্রথম প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁর মেয়ের শরীরে। ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ় প্রয়োগের পরে মেয়ের শরীরে তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছিল। পরে আবার তা ঠিক হয়ে যায়। এখন মেয়ে সুস্থ অনুভব করছেন।  

পুরো বিশ্ব যখন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, সেই সময় রাশিয়া জানালো করোনার টিকা আবিষ্কারে তারা ইতিমধ্যে সমস্ত পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। দেশটির গ্যামেলিয়া গবেষণা ইন্সটিটিউট ও রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় যৌথভাবে নতুন এ করোনা টিকা তৈরি করেছে বলে জানায় রাশিয়া। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বে ছয়টি সম্ভাব্য টিকা মানবপরীক্ষার তৃতীয় ধাপে রয়েছে। যার মধ্যে দুটি টিকা রাশিয়ার। 

রুশ সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ওষুধের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার সময় সংক্ষিপ্ত করার আদেশ দেন। এর মধ্যে করোনার ভ্যাকসিন বা টিকার পরীক্ষার বিষয়টিও ছিল।  

বারডেনকো নামে রাশিয়ার এক হাসপাতালে এই টিকাটি মানবদেহে পরীক্ষা করা হয়।  শুরুতে গত ১৭ জুন টিকাটি ৭৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর প্রাথমিক পরীক্ষা হয়। ৭৬ জন স্বেচ্ছাসেবককে দুটি দলে ভাগ করে টিকা দেওয়া হয়। প্রথম ৩৮ জনকে লিকুইড  ভ্যাকসিন ইনজেক্ট করা হয়, বাকি ৩৮ জনকে  টিকার পাউডার দেওয়া হয়।  রাশিয়ার ক্লিনিকাল ট্রায়াল অর্গানাইজেশনের ডিরেক্টর ভেতলানা জ়্যাভিডোভা বলেছেন, একসঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল করা হয়েছে ভ্যাকসিনের। দাবি, দুই পর্যায়েই  সাফল্য মিলেছে। স্বেচ্ছাসেবকদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে  অর্থাৎ তাঁদের শরীরে করোনা প্রতিরোধী সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এবং নতুন এ টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। 

এদিকে নতুন করোনা টিকা বিষয়ক পুতিনের দাবি নিয়ে হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে গোটা দুনিয়া জুড়ে। কারণ রুশ প্রেসিডেন্টের দাবি সঠিক হলে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন সহ সবাইকে পেছনে ফেলে বাজিমাত করলো রাশিয়া। 

সমালোচনায় এগিয়ে থেকে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, রাশিয়ার ওই টিকার এখনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালই শেষ হয়নি। মার্কিন সংবাদপত্র ‘নিউইয়র্ক টাইমস-এ লেখা হয়েছে, ‘পরীক্ষার দিকে না তাকিয়ে, রাজনৈতিক এবং প্রচারের উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই সাধারণ মানুষকে টিকা দেয়ার দৌড়ে সামিল হয়েছে রাশিয়া।’ সংবাদপত্রটি আরও দাবি করেছে, নিরাপদ এবং কার্যকর টিকা তৈরির জন্য সমস্ত ধাপ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মেনে চলার পরামর্শ রাশিয়াকে আগেই দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মানা হয়নি।  

যদিও, মার্কিন সংবাদমাধ্যমের অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে মস্কোর সেচেনভ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ভাদিম তারাসভের বক্তব্য, গ্যামেলিয়া একদিনে ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলেনি। ভ্যাকসিন নিয়ে তাদের দীর্ঘ গবেষণা রয়েছে। এই গবেষণার মজবুত ভিত রয়েছে। যে অ্যাডিনোভাইরাসের কারণে সাধারণ সর্দি জ্বর হয়, তার উপর ভিত্তি করেই করোনার নতুন টিকা বানানো হয়েছে। 

গ্যামেলিয়া ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর আলেকজান্ডার গিন্টসবার্গ বলেছেন, অ্যাডেনোভাইরাসের স্ট্রেন থেকে ভেক্টর ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে। এই টিকা মানুষের শরীরে  কোনও খারাপ প্রভাব ফেলবে না। কারণ দুর্বল ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির ক্ষমতা নেই। বরং এই টিকা শরীরের বি-কোষ ও টি-কোষকে সক্রিয় করে অ্যান্টিবডি তৈরির প্রক্রিয়াকে জোরদার করবে। শরীরের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। গ্যামেলিয়ার ডিরেক্টর  আরো বলেন, প্রথম পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ হওয়ার পরে এখনও অবধি ভ্যাকসিনের ‘কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া‘ দেখা যায়নি। 

রুশ সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই রাশিয়ায় নতুন এই টিকার ধারাবাহিক উৎপাদন শুরু হবে। উৎপাদন শুরুর পর বিতরণের ব্যাপারে রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেছেন, “রাশিয়ার নাগরিকদের টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে শুরু হবে। তবে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে তাঁদেরই যাঁরা সরাসরি কোভিড আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন। অর্থাৎ স্বাস্থ্য কর্মীদের আগে টিকা দেওয়া হবে। তার পর তা দেওয়া হবে শিক্ষকদের। কারণ তাঁরা শিশুদের সংস্পর্শে থাকেন।” বিশ্বের প্রায় ২০ টি দেশ রাশিয়ার টিকা নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলেও জানান তিনি।

১৯৫৭ সালে আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে মহাকাশে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছিল রাশিয়া। প্রায় একই ধাঁচে এবার করোনা কবলিত পৃথিবীকে চমকে দিয়ে প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কারের খবরও দিল তারা। সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়ার তৈরি পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক-১’এর সাফল্য  মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে ছিলো। এবারও করোনা ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক ভি’ করোনা মহামারি থেকে বিশ্বকে রক্ষা করবে, সূচনা হবে নতুন দিনের এমন প্রত্যাশা সবার। 

 

মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top