টিকা নেয়ার পরও কি হতে পারে করোনা? : মু: মাহবুবুর রহমান
প্রকাশিত:
২৯ মার্চ ২০২১ ১৯:২১
আপডেট:
৩ অক্টোবর ২০২৪ ২২:৫০
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হচ্ছে করোনা ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম। কিন্তু অনেক দেশেই টিকা নেয়ার পরও কেউ কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন করোনায়। প্রেক্ষিতে, অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে - টিকা নেয়ার পরও কি হতে পারে করোনা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকা নেয়ার পরও রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিশেষ করে যাদের শরীরে টিকা নেয়ার আগে থেকেই করোনাভাইরাস থাকে, তাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও অন্য কিছু কিছু কারণে টিকা নেয়ার পরও কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। তবে করোনা টিকা কত দিন করোনা প্রতিরোধে সহায়ক হবে, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, করোনা টিকার প্রতিরোধক্ষমতা প্রায় এক বছর পর্যন্ত হতে পারে।
করোনা টিকা নেয়ার পর কেন আবার অনেকে রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা কতজন আক্রান্ত হচ্ছেন তা নিয়েও চলছে গবেষণা ও জরিপ।
গত ২৩ মার্চ ২০২১ তারিখে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় টিকা নেয়ার পর করোনা আক্রান্তদের বিষয়ে একটি লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটিতে ডালাসের একটি হাসপাতালকর্মীদের ওপর পরিচালিত জরিপের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, সেখানে পূর্ণ টিকা (দুই ডোজ) গ্রহণের পর ৮ হাজার ১২১ জনের মধ্যে ৪ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় টিকা গ্রহণের দুই সপ্তাহ বা তারও পর ১৪ হাজার ৯৯০ জন কর্মীর মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে ৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
এসব জরিপে দেখা যাচ্ছে টিকা নেয়ার পর করোনা আক্রান্তের সংখ্যা খুবই নগন্য। বাংলাদেশে এখনো এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জরিপ হয়নি। করোনার টিকা সম্পর্কে আরও বিশদ জানার জন্য এ ধরনের জরিপ খুবই জরুরি। আমরা এখন নজর দেব কেন টিকা নেয়ার পরও হতে পারে করোনা - সে বিষয়ে।
টিকা নেয়ার পর ইমিউনিটি তৈরি হতে দু-তিন সপ্তাহ সময় লাগে
টিকা নেয়ার পর মানবদেহ করোনাভাইরাসের জেনেটিক উপাদানগুলো চিনে নিতে এবং অ্যান্টিবডি ও টি-সেল তৈরি করতে বেশ খানিকটা সময় নেয়। প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরির পরই কেবল এগুলো দেহকোষে করোনাভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বা শরীরে বিদ্যমান ভাইরাসকে মেরে ফেলতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের 'সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন' এর তথ্য অনুয়ায়ী, করোনা টিকা নেয়ার পর এর কার্যকারিতা শুরু হতে কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
বাংলাদেশের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা টিকা নেয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে কমপক্ষে ৩ সপ্তাহ সময় লাগে। এর আগে দেহে ইমিউনিটি তৈরি হয় না। কাজেই টিকা নেয়ার পর দেহে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির আগ পর্যন্ত যে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।
টিকা নেয়ার আগে থেকেই যদি শরীরে থাকে করোনাভাইরাস
করোনা টিকা নেয়ার আগে থেকেই যদি কারো শরীরে করোনাভাইরাস বাসা বেঁধে থাকে তবে তিনি করোনা টিকা নেয়ার পরও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। এ বিষয়ে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে করোনা টিকা নেয়ার পর যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের শরীরে করোনাভাইরাস আগেই প্রবেশ করেছিল। দেহে ভাইরাসের যে ১৪-১৫ দিন সুপ্তিকাল, সেই সময় টিকা নিয়েছিলেন তারা। সে জন্য টিকার কার্যকারিতা শুরু হওয়ার আগেই ভাইরাসের কার্যকারিতা শুরু হয়ে গেছে। ফলে তারা আক্রান্ত হয়েছেন।
বিজ্ঞানীদের মতে, গড়ে পাঁচ দিন পর্যন্ত করোনাভাইরাস আক্রান্তের শরীরে সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী করোনাভাইরাসের সুপ্তাবস্থা ১৪ দিন। তবে কিছু গবেষকদের দাবি করোনাভাইরাসের সুপ্তাবস্থা ২৪ দিন। কাজেই টিকা নেয়ার পরও যে কেউ দেহে অবস্থিত সুপ্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।
আবার এমন হতেই পারে যে টিকার ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলা করতে পারে - কিন্তু তার শ্বাসতন্ত্রের উপরের অংশ থেকে ভাইরাসটিকে তাড়িয়ে দিতে পারে না।
করোনা টিকার দুই ডোজের মধ্যবর্তী সময়
বিশ্বে এখন পর্যন্ত যতগুলো করোনা টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে তার অধিকাংশই দুই ডোজের। একমাত্র জনসন অ্যান্ড জনসনের কোভিড-১৯ টিকা একক ডোজের যেটা পাওয়া যাচ্ছে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে। যতটুকু জানা গেছে ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ দেয়ার ১৪ দিন পর এটি শতকরা ৫২ ভাগ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। মর্ডানার ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ দেয়ার ১৪ দিন পর এটি শতকরা ৫০.৮ ভাগ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে আর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রথম ডোজ দেয়ার দেয়ার পর এটি ৬৪.১ ভাগ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে।
কাজেই দেখা গেলো করোনা টিকার দুই ডোজের মধ্যবর্তী সময় আপনি পুরোপুরি সুরক্ষিত নন। এমনকি করোনা টিকার প্রথম ডোজ নেয়ার অন্তত ১৪ দিনের মধ্যে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি দেহে তৈরি হয় না। এই সময়ের পর অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু হয়, ধাপে ধাপে বাড়ে আর দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পর পাওয়া যায় টিকার পূর্ণ কার্যকারিতা। কাজেই করোনা টিকার দুই ডোজের মধ্যবর্তী সময়েও যে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
করোনার কোনো টিকাই শতকরা ১০০ ভাগ কার্যকর নয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কোনো টিকাই শতকরা ১০০ ভাগ কার্যকর নয়। জানা গেছে, ফাইজারের দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হলে করোনা প্রতিরোধে শতকরা ৯৫ ভাগ সুরক্ষা দেবে, ৫ শতাংশ ঝুঁকি। সম পরিমাণে মর্ডানার টিকা দেয়া হলে শতকরা ৯৪ ভাগ সুরক্ষা দেবে, ৬ শতাংশ ঝুঁকি। অন্যদিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৭০থেকে ৯০ ভাগ কার্যকর আর এক্ষেত্রে ঝুঁকি ১০ থেকে ৩০ শতাংশ।
যেহেতু কোনো করোনা টিকাই শতভাগ কার্যকর নয় কাজেই টিকা নেয়ার পরও কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত হতে পারেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে করোনার টিকা নিলে কখনোই আর করোনা হবে না, এই ভাবনা অমূলক। বাংলাদেশে টিকার প্রথম ডোজ দিয়েই অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানা ছেড়ে দিয়েছেন। মাস্ক ব্যবহারে, সামাজিক দূরত্ব পালনে বা হাত ধোয়ায় এসেছে শিথিলতা। এর ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলছে।
কাজেই আসুন, করোনার টিকা গ্রহণকারী কিংবা যারা এখনো টিকা পায়নি সবাই আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। মাস্ক পরিধান করা, হাত সাবান-পানি দিয়ে বারবার ধোঁয়া এবং যথাসম্ভব শারীরিক দ্রুত মেনে চলা—অন্ততপক্ষে এই তিনটি স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কোনো ঢিলেঢালা ভাব বা উদাসীনতা প্রদর্শন করা যাবে না। আর টিকা দেয়ার পরও যেহেতু কেউ শতভাগ নিরাপদ নন, তাই টিকা নেয়ার পর করোনার উপসর্গ দেখা দিলে করোনার পরীক্ষা করতে হবে ও দ্রুততম সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মু: মাহবুবুর রহমান
ফার্মাসিস্ট, নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক
বিষয়: মু: মাহবুবুর রহমান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: